প্রখ্যাত আলেম শায়খুল হাদিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশর উপদেষ্টা সিলেটের জকিগঞ্জের কৃতিসন্তান আল্লামা মুকাদ্দাস আলী (বারগাত্তার মুহাদ্দিস ছাহেব) আর নেই। বুধবার (৮ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বার্ধক্যজনিত কারণে সিলেটের জকিগঞ্জস্থ নিজ বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহে রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। তাঁর ইন্তেকালে সিলেটজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
ওইদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় জকিগঞ্জের সোনাসার সংলগ্ন পূর্ব মাঠে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে তাঁকে তাঁর কর্মস্থল মুন্সিবাজার ফয়জে আম মাদ্রাসায় শায়েখ আব্দুল গফ্ফার মামরখানি (রহ.)-এর কবরের পাশে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। জানাজার নামাজে সাবেক এমপি মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীসহ দেশের প্রখ্যাত আলেম, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধিসহ হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে।
পারিবারিক সূত্রে জানায়, ব্যক্তিগত জীবনে আল্লামা মুকাদ্দাস আলী (রহ.) আট সন্তানের জনক। তার মধ্যে তিন মেয়ে শৈশবেই মারা যান। বর্তমানে তিন ছেলে এবং দুই মেয়ে রয়েছেন। তাঁর ছেলেরা আলেম ও হাফেজ এবং শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন। এদিকে শায়খুল হাদীস আল্লামা মুকাদ্দাস আলীর ইন্তেকালের খবর শুনে তাঁকে শেষবারের মতো একবার দেখতে সকাল থেকে সোনাসার গ্রামের বাড়িতে আসতে থাকেন আলিম উলামাসহ হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ। তাঁর শেষ বিদায়ে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সৃষ্টি হয় হৃদয়বিদারক এক দৃশ্যের। জানাজায় অংশ নেওয়া লোকজনের কান্না আর আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ।
জনা যায়, শায়খুল হাদীস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী একজন নিভৃতচারী বুজুর্গ ছিলেন। পার্থিব দুনিয়ার তাঁর মধ্যে মোহ-মহব্বত ছিল না। কিতাব অধ্যয়নেই ছিল সব আনন্দ-আহ্লাদ। প্রশান্তি পেতেন সাদা কাগজের কালো হরফের পবিত্র কোরআন মাজিদের আয়াত, তাফসির ও হাদিসের বাণী বিশ্লেষণে। জীবনের শেষ সময়ে বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লেও কিতাবের মায়া এবং ছায়ায় ছিলেন ফুরফুরে। একদিকে যেমন ইলমে হাদিসের ওপর অগাধ পাণ্ডিত্য, অন্যদিকে নিভৃতচারিতা ও বুজুর্গিতে অতুলনীয় ছিলেন মহান এই বুজুর্গ। তিনি তাঁর কর্মময় জীবনে হাদিসশাস্ত্রের সবচেয়ে বিশুদ্ধ সংকলন সহিহ বুখারী শরীফ একাধারে দীর্ঘ ৬৯ বছর শিক্ষাদানের বিরল দৃষ্টান্ত করেছেন। তাঁর রয়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। এমনকি অনেক শীর্ষ আলেমও তাঁর কাছ থেকে হাদিস শাস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা জানান, আল্লামা মুকাদ্দাস আলী কিংবদন্তিতুল্য একজন শায়খুল হাদিস হওয়ার পাশাপাশি একজন উঁচুমাপের বুজুর্গও ছিলেন। দেওবন্দে দাওরা শেষ করেই ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যিদ আসআদ মাদানি (রহ.)-এর হাতে আত্মশুদ্ধি ও সুলুকের বায়াত হন। এরপর দেশে ফিরে আসায় যোগাযোগ অসুবিধার কারণে ফেদায়ে মিল্লাতের নির্দেশে শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর অন্যতম খলিফা কায়েদে উলামা মাওলানা আবদুল করীম শায়খে কৌড়িয়ার হাতে বায়াত হন এবং ১৩৮৩ হিজরির ২৭ রমজান খেলাফত লাভ করেন। এরপর থেকে হাদিসের পাঠদানের পাশাপাশি আধ্যাত্মচিকিৎসায় মনোযোগ দেন। বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক মেহনতের লক্ষ্যে একটি খানকা চালু করেছিলেন তিনি। বর্তমান সিলেটে খানকাওয়ারি মেহনতের ধারাটি জকিগঞ্জের মুনশিবাজার মাদ্রাসা মসজিদেই কেবল চালু আছে। আর খানকার পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে ছিলেন আল্লামা মুকাদ্দাস আলী। প্রতিবছর রমজানের শেষ দশকে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন জকিগঞ্জ ছুটে যেতেন তার সাহচর্যে থেকে ইতেকাফ করার জন্য।
ইতোমধ্যে আধ্যাত্মিক তরিকায় বেশ কয়েকজন ব্যক্তিত্বকে তিনি খেলাফত প্রদান করেছেন। তাদের অন্যতম হলেন কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়ার শায়খুল হাদিস মাওলানা শফিকুর রহমান জালালাবাদী। তিনি প্রতিবছর রমজানের শেষ দশকে কিশোরগঞ্জ থেকে ছুটে আসতেন শায়খের সাহচর্যে ইতেকাফের জন্য।
মন্তব্য করুন