মো. আব্দুল বাছিত
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩:১৯ অপরাহ্ন
অনলাইন সংস্করণ

কোটা সংস্কার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও একটি নতুন বাংলাদেশ

পৃথিবীতে দুটি শ্রেণির আন্দোলনকে সবচেয়ে প্রভাবশালী হিসেবে গণ্য করা হয়। একটি শ্রমিকদের আন্দোলন এবং অপরটি ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র এবং শ্রমিকদের আন্দোলন পৃথিবীর যেকোনো দেশের ইতিহাসের গতিপথকে বদলে দিতে পারে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের রয়েছে এক সোনালী অধ্যায়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ‘৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন, ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০’এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ২০২৪ সালে এসে সেই ছাত্রদের আন্দোলন একটি নতুন ইতিহাসের সূচনা করলো। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-ব্যবসা-বাণিজ্য-আইন-বিচার-চিকিৎসাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে যখন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি, মানুষ যখন মুক্তির অন্বেষায় পথ চলছে—এমন সময়ে মুক্তির কাণ্ডারি হিসেবে আবির্ভূত হলো ছাত্রসমাজ। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দানা বেঁধে ওঠা প্রতিবাদী কণ্ঠ একটি দেশের ইতিহাসকে নতুন করে রচিত হলো। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্ত হলো বাংলাদেশ। কোটা সংস্কার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও একটি নতুন বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের পথচলা। এই প্রত্যয় নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন। তাহলে শুরু থেকে শুরু হয়ে যাক….

 

কোটা কাকে বলে?

কোটা বলতে কোনো কিছুর নির্দিষ্ট একটি অংশকে বোঝায় যা সাধারণত একটি গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ থাকে। মূলত সমাজের পিছিয়ে পড়া বা অনগ্রসর মানুষগুলোকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে পড়াশোনা, চাকরিসহ নানা ক্ষেত্রে কোটার ব্যবস্থা থাকে।

 

কোটা ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

কোটা ব্যবস্থা বাংলাদেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। পাকিস্তান আমলে অর্থাৎ ১৯৪৯ সাল থেকে কোটার প্রচলন ছিল। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কোটা সিস্টেম চালু হয়। এখানে ২০% ছিল মেধার ভিত্তিতে, ৪০% ছিল বাঙালিদের জন্য বরাদ্দ, পাঞ্জাব ও বাহাওয়ালপুরের জন্য ২৩%, সিন্ধু, বেলুচ ও সীমান্ত প্রদেশের জন্য ১৫% ও করাচির জন্য ২% চাকুরি বরাদ্দ থাকে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবের আমলে চালু হওয়া প্রথম কোটা ব্যবস্থায় বাংলাদেশ পাকিস্তানের অনুসরণ করে। অর্থাৎ ২০% মেধা আর বাকিটা জেলা কোটা। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশন ও দফতরে নিয়োগ এবং কোটা বণ্টনের বিষয়ে ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সরকার একটি নির্বাহী আদেশ জারি করে। এতে এসব প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ মেধা এবং বাকি ৮০ শতাংশ জেলা কোটা রাখা হয়। এই ৮০ শতাংশ জেলা কোটার মধ্য থেকেই ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধা এবং ১০ শতাংশ কোটা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অর্থাৎ কোটার বড় একটি অংশই বরাদ্দ করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। এর চার বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মতো কোটা বণ্টনে পরিবর্তন আনেন জিয়াউর রহমান। এ সময় মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো হয় এবং শুধু নারীদের জন্য আলাদা করে কোটার ব্যবস্থা করা হয়। সেসময়ে মোট কোটার ৪০ শতাংশ মেধা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী এবং বাকি ১০ শতাংশ কেবলই জেলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়।

 

১৯৮৫ সালে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে আবারো কোটা সংস্কার করা হয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের কোটায় অন্তর্ভুক্ত করে  মেধার ভিত্তিতে ৪৫ শতাংশ এবং জেলাভিত্তিক কোটা হবে ৫৫ শতাংশ। এই জেলাভিত্তিক কোটার মধ্য থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ, নারীদের ১০ শতাংশ এবং উপ-জাতীয়দের জন্য পাঁচ শতাংশ পদ সমন্বয় করা হয়। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটায় চাকরি পাওয়ার সুবিধার্থে শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে ৩০ শতাংশ করা হয়। ২০০২ সালে খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে আরেকটি পরিপত্র জারি করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ কোটা বণ্টনের বিষয়ে আগের জারি করা পরিপত্র বাতিল করা হয়। ২০০২ বলা হয়, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত ৩০ শতাংশ কোটা অন্য প্রার্থী দ্বারা পূরণ না করে সংরক্ষণ করার যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল, তা সংশোধনক্রমে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে ২১তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত ৩০ শতাংশ কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে উক্ত কোটার শূন্যপদগুলো (ক্যাডার ও নন-ক্যাডার) মেধাভিত্তিক তালিকায় শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদেরকে দিয়ে পূরণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৩০ শতাংশে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা তালিকার প্রার্থী থেকে নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়।

 

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করে ২০০৯ সালে এই নির্দেশনা বাতিল করে। একইসাথে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য নির্ধারিত কোটা পূরণ করা সম্ভব না হলে পদ খালি রাখার নির্দেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। কোটায় পরবর্তী পরিবর্তন আসে ২০১১ সালে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদেরও ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সবশেষ ২০১২ সালে এক শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশের বেশি কোটা রয়েছে যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক কোটা ১০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০% বরাদ্দ রেখে সকল নাগরিকের সমান সুযোগের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের পরিপত্র জারির আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা, জেলা, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী- এই পাঁচ ক্যাটাগরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল।

 

আন্দোলনের সূচনা

সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে কোটার পরিমাণ বেশি থাকায় এটি নিয়ে বরাবরই অসন্তোষ ছিল। আর কোটা আন্দোলন প্রথমবারের মতো বড় আকারে রূপ নেয় ২০১৮ সালে। ওই বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিল এবং এর পুর্নমূল্যায়ন চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ও দুই সাংবাদিক। এতে কোটা পদ্ধতিকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলেও উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মার্চ মাসে এসে ওই রিটটি খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। এদিকে আদালতে রিট করার পরপরই কোটা সংস্কার আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এ সময় কোটা সংস্কারের উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ নামে একটি প্লাটফর্মও গঠন করা হয়। রিট খারিজ হওয়ার পর কোটা পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন করা হবে না মর্মে আদেশ জারি করা হয়। তবে কোটা কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা আনে সরকার। তবে কোটা সংস্কারের ক্ষেত্রে দাবি আদায়ে অনড় থাকে শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি ছিল ৫ টি :

১. সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বর্তমান কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা।

২. কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া।

৩. সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ।

৪. কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না রাখা।

৫. চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা।

 

এদিকে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন।  ২০২৪ সালের ৫ জুন আদালত আগের মতো কোটা বহাল থাকবে বলে রায় দেয়ে। এদিকে হাইকোর্টের ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। সেই আবেদন গত ৪ জুলাই শুনানির জন্য এলে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল করতে নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। এরই মধ্যে ১ জুলাই থেকে কোটা বাতিলে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। এই সময়ই কোটা সংস্কার আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তীব্র আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে এই সংগঠন কেন্দ্রীয়ভাবে এবং দেশের  বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে সমন্বয়ক দল গঠন করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে যারা এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-নাহিদ ইসলাম, রিফাত রশিদ, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার, আরিফ সোহেল প্রমুখ। তাঁদের নেতৃত্বে ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকায় গণপরিবহন বন্ধ এবং রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি চালায় এবং পরবর্তীতে সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হয় যা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি নামে পরিচিত। বাংলা ব্লকেড চলাকালীন রাজধানীতে শুধু মেট্রো রেল চালু ছিল। পরবর্তী দিনগুলিতেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একই কর্মসূচিত পালিত হয়। এইসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ ও পুলিশি হামলার শিকার হয়। ১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। এদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদেরকে ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ হিসেবে অভিহিত করেন। তার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’ এবং ‘চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার’ স্লোগান দেয়। এর পরেরদিন ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ আনেন। পরবর্তী দিনগুলিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন চলে। ১৭ জুলাই রাতে তারা ১৮ জুলাইয়ের জন্য ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা করে।

 

১৯ জুলাইতেও সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অবরোধ চলে। এদিন মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আটক করা হয়। ওই সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিনজন প্রতিনিধির সাথে সরকারের তিনজন প্রতিনিধির অনুষ্ঠিত বৈঠকে তারা সরকারের কাছে ‘আট দফা দাবি’ জানান। তারা হলেন- সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সহ-সমন্বয়ক তানভীর আহমেদ। ২০ জুলাই সরকারের তিনজন মন্ত্রীর যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সেই বৈঠক ও বৈঠকে উত্থাপিত দাবি নিয়ে নেতৃত্বের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়।

 

২১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি পক্ষ ‘৯ দফা’ দাবি জানিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২২ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম চার দফা দাবি জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত করেন। তিনি জানান, ‘আমাদের চার দফার মধ্যে রয়েছে-৪৮ ঘন্টার মধ্যে ইন্টারনেট চালু, ক্যাম্পাসগুলো থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রত্যাহার করে ক্যাম্পাস চালু, সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা প্রদান এবং কারফিউ প্রত্যাহার। যারা নয় দফা দাবি ও শাটডাউন অব্যাহত রেখেছে তাদের সাথে আমাদের নীতিগত কোনো বিরোধ নেই। নিজেদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ না থাকায় আমরা তাদের সাথে কথা বলতে পারছি না’। ১৯ জুলাই থেকে নিখোঁজ থাকার পর ২৪ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া যায়। ২৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আটটি বার্তা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে হতাহতদের তালিকা তৈরি, হত্যা ও হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়ার চাপ তৈরি করা।

 

২৬ জুলাই নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদাপোশাকের এক দল ব্যক্তি। ২৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংগঠনের আরও দুই সমন্বয়ককে হেফাজতে নেয় গোয়েন্দা শাখা। তারা হলেন সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। পরে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে ২৮ তারিখের (রোববারের) মধ্যে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামসহ, আসিফ মাহমুদসহ আটক সকল শিক্ষার্থীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও শিক্ষার্থী গণহত্যার সাথে জড়িত মন্ত্রী পর্যায় থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সকল দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আল্টিমেটাম দেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। একই সাথে রোববার সারা দেশের দেয়ালগুলোতে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়। ২৮ জুলাই রাত ১০টার দিকে পুলিশি হেফাজতে থাকা ৬ সমন্বয়ক আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। কিন্তু পুলিশে আটক হওয়া অবস্থায় পুলিশের অফিসে বসেই বাকি সমন্বয়কারীদের সাথে যোগাযোগ না করে এমন ঘোষণা দেওয়ায় এই ঘোষণাকে সরকার ও পুলিশের চাপে দেওয়া হয়েছে বলে আখ্যায়িত করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বাকিরা।

 

৩১ জুলাই হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে ৩১ জুলাই বুধবার সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ (ন্যায়বিচারের জন্য পদযাত্রা) কর্মসূচি পালন করে। ১ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে বেলা দেড়টার একটু পরেই ছেড়ে দেওয়া হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২ আগস্ট শুক্রবার ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন যে আন্দোলন প্রত্যাহার করে ডিবি অফিস থেকে প্রচারিত ছয় সমন্বয়ককের ভিডিও বিবৃতিটি তারা স্বেচ্ছায় দেননি।

 

৩ আগষ্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দেওয়া হয় অসহযোগ আন্দোলনের রূপরেখা। এই রূপরেখায় ১৫টি বিষয়ে দেশের ছাত্রসহ আপামর জনতাকে সচেতন করা হয়। পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহবান করেন। ৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে সরকার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলন ঘোষণা করা হয়। শুরুতে ৬ আগস্ট ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তবে এই পরিস্থিতি বিবেচনায় সম্বনয়করা কর্মসূচি একদিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট ঘোষণা করে। আন্দোলনকে ঘিরে ৫ আগস্ট অনেক জেলায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, এতে ৯৮ জন সাধারণ মানুষ ও পুলিশ নিহত হয়।

 

৫ আগস্ট ভোর থেকে রাজধানী ঢাকায় তথা শেখ হাসিনার বঙ্গভবনের আশেপাশে লক্ষ লক্ষ ছাত্রজনতা এবং সাধারণ মানুষ জড়ো হন। শেখ হাসিনা ১ দফা দাবির প্রেক্ষিতে সম্মিলিত ছাত্র-জনতার এক গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করেন এবং দেশত্যাগ করেন। এর মাধ্যমে তার ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের দুঃশাসনের অবসান হয়।

 

শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সেনাপ্রধান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা জানান। সেইদিন রাষ্ট্রপতিও জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া তার ভাষণে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা জানান ও পরদিন এই লক্ষ্যে সংসদ ভেঙ্গে দেন। ৭ আগস্ট রাষ্ট্রপতির সাথে তিন বাহিনী প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠকের পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৮ আগস্ট শপথগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। এই নতুন সরকারে ২২ জন উপদেষ্টা রয়েছেন, যাদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন।

 

২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে ১৬ জুলাই থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত গুলি, সংঘর্ষ ও সহিংসতায় কমপক্ষে ৬২৬ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত নিহত হন কমপক্ষে ৩৫৪ জন। আর ৫ থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত নিহত হন কমপক্ষে ২৭২ জন। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতাল ও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মৃত্যুর এই হিসাব পেয়েছে প্রথম আলো। তবে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত বিক্ষোভ ও পরবর্তী সহিংসতায় কমপক্ষে ৬৫০ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও অস্থিরতা বিষয়ে প্রাথমিক বিশ্লেষণ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন ১৬ আগস্ট জেনেভা থেকে প্রকাশিত হয়। তবে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইট্স সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ৮১৯ জন মানুষ মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ২৫ হাজারের মতো। অসংখ্য অগণিত মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমেই দুঃশাসনের অবসান হয়েছে।

 

৫ আগস্ট বাংলাদেশের ছাত্রজনতা একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সাধারণ ছাত্রজনতা একটি গণ-অভ্যুত্থানকে সফল করলো। এই আন্দোলনে যেমন একধরনের সুশীল শ্রেণির প্রবল বিরোধিতা ছিল, তেমনই একটি গণদাবির প্রেক্ষিতে দেশের আপামর জনতা ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে সূচিত হয় একটি নতুন ইতিহাস। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে চলা অপশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, নৈরাজ্য, গুম-হত্যা-খুন এবং রাহাজানির অবসান ঘটে বাংলাদেশের জমিন থেকে। এরপর দ্রুতই দেশের পট পরিবর্তন হতে থাকে। শেখ হাসিনার পলায়নপর মানসিকতা একটি ঐতিহ্যবাহী দলকে মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংসের মধ্যে ফেলে দেয়। অসংখ্য অগণিত বিদেশে পালিয়ে যান। এমপিদের অনেকেই পূর্বে গা ঢাকা দিয়েছেন। আওয়ামী সরকার একটি ঘৃণ্য ইতিহাস সৃষ্টি করে। পৃথিবীর ইতিহাসে পুরো পার্লামেন্টের পলায়ন যেন নতুন কোনো ঘটনা। এরপর চারদিকে চলতে থাকে পদত্যাগ। মন্ত্রী-এমপিরা গ্রেফতার হচ্ছেন। বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে-একটি গোষ্ঠী কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ আর উন্নয়নের বুলি আওড়িয়ে বছরের পর বছর ধরে একটি জাতির ধ্বংস অনিবার্য করতে ভূমিকা রাখছে। ছাত্রজনতা একটি নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। ছাত্রদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এটাই প্রত্যাশা সবার।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

Facebook Comments Box

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৫ বাংলাদেশিসহ ৪ শতাধিক শিক্ষার্থীর ‘স্টুডেন্ট ভিসা’ বাতিল করল যুক্তরাষ্ট্র

ফিলিস্তিনের সমর্থন ও ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভে একযোগে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্র

শাকিব খানের নতুন সিনেমা “বরবাদ” মুক্তি পাচ্ছে ১৮ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়

যুক্তরাষ্ট্রে ঝড়ে মৃত্যু ১৬ ও ভয়াবহ বন্যার শঙ্কা

ইরানের বিরুদ্ধে হামলায় পিছু হটে আলোচনার প্রস্তাব ট্রাম্পের

চীনের করা পাল্টা শুল্কারোপে মার্কিন শেয়ার বাজারে ধস

নাসা মানব অনুসন্ধান রোভার চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশের দলের অংশগ্রহণ ও উদ্ভাবনী চিন্তার আলোচনা

ট্রাম্পের করা শুল্ক বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার পোশাক ব্যবসায়ীদের ওপর বড় ধাক্কা

শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে এবার পাল্টা হুমকি চীনের

ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের তালিকায় রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার নাম নেই কেন

১০

স্বল্প আয়কারী বাড়ির মালিকদের আর্থিক সহায়তা

১১

মিশিগান সীমান্তে মাদক আটক

১২

মার্কিন সিনেটে এবার টানা ২৫ ঘণ্টা বক্তব্যের রেকর্ড

১৩

যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মানছে না রাশিয়া

১৪

ট্রাম্প-নীতির তীব্র নিন্দা জানিয়ে এবার যা বললেন হিলারি

১৫

ইউএসএআইডি বন্ধ করতে এবার ট্রাম্প প্রশাসনের আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা ঘোষণা

১৬

যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক প্রসঙ্গে কানাডা প্রধানমন্ত্রী

১৭

চাকরি হারাচ্ছেন মার্কিন স্বাস্থ্য বিভাগের ১০ হাজার কর্মী

১৮

ইস্তাম্বুলের মেয়র ইমামোগলুকে গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

১৯

ভারতে ভিসা জালিয়াতির বিরুদ্ধে এবার কড়া পদক্ষেপ মার্কিন দূতাবাসের

২০