মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বপ্ন নিয়ে অনেকেই পাড়ি জমান বিভিন্ন সূত্রে। অজস্র স্বপ্ন বাস্তবায়ন তো দূরের কথা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। তবে কেউ কেউ ব্যতিক্রম। তেমনি একজন সারাহ হোসেন। স্বপ্ন দেখেছেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সঠিক পথে হেঁটেছেন, অতঃপর সফল হয়েছেন। সম্ভ্রান্ত ঘরে জন্ম। পিতা ইঞ্জিনিয়ার হোসেন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের খ্যাতনামা বিদ্যাপীঠ সিলেট সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। মাতা জাহানারা হোসেন সিলেটের বড়লেখার উপজেলার সুজানগরের বনেদি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। মায়ের অনুপ্রেরণা-উৎসাহ সারাহ হোসেনকে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। সারাহ হোসেনের জন্ম বাংলাদেশের সিলেট শহরে। নব্বই দশকের শেষদিকে আমেরিকায় স্থায়ী বসবাসের জন্য আসা। নার্সিং বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বর্তমানে রেজিস্টার্ড নার্স হিসেবে কর্মরত আছেন নিউইয়র্ক-প্রিসবিটেরিয়ানের মরগান স্ট্যানলি শিশু হাসপাতালে। একাধারে তিনি একজন রিয়েলটর এবং রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টর। নিউইয়র্কের ওজন পার্কে রয়েছে বাড়ি।
সারাহ হোসেন যখন রিয়েলেটর হিসেবে রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ করেন তখন এই খাতে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিলো একেবারেই হাতেগোনা। শুরুতে নিজের কমিউনিটির অনেকের নিকট হতে এ বিষয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপও শুনতে হয়েছে। সারাহ হোসেন জানেন ধৈর্য্যের সঙ্গে কঠিন বিষয়ের মোকাবিলা। সকল প্রতিকূলতা দূরে সরিয়ে তিনি তাঁর গন্তব্যে পৌঁছেছেন, স্বপ্নকে করেছেন জয়।
আমেরিকায় পাড়ি দিয়ে যখন ভাড়া বাসায় থাকতেন সেইসময়ে বাড়ির মালিক হওয়ার স্বপ্ন উঁকি দেয় নিজের মনে। নিজের প্রচেষ্টায় ২০০৯ সালে নিউইর্য়কের ওজন পার্কে প্রথম বাড়ি ক্রয়ের মধ্যদিয়ে সারাহ হোসেন কেবল প্রথম বাড়ির মালিক হননি বরং একই সঙ্গে ব্যবসায়িক চিন্তার দুয়ারও খুলে যায়।বাড়ি মালিক হওয়ার স্বপ্ন পূরণের পাশাপাশি শুরু করেন রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ। সময়ের পথ পরিক্রমায় তিনি একজন লাইসেন্স প্রাপ্ত সফল রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টর। সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন উইনজোন রিয়েলটি ইনকের সাথে। বাঙালি কমিউনিটির নারীদের অগ্রযাত্রায় তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
যুক্তরাষ্ট্রে করোনা পরিস্থিতি এখনও নিঃশেষ হয়নি, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাড়ির দাম বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে সেই প্রেক্ষিতে এই মুহূর্তে বাড়ি না কেনার পরামর্শ দেন লাইসেন্স প্রাপ্ত রিয়েলেটর সারাহ হোসেন। তিনি বলেন, অধিকাংশ মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় আর্থিক সিদ্ধান্ত বাড়ি কেনার সময়ে নিতে হয়।
অভিবাসীরা আমেরিকায় এসে স্বাভাবিকভাবেই নিজের একটি বাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখেন। বাংলাদেশিরাও স্বপ্নপূরণের তালিকার শুরুতেই রাখেন বাড়ি কেনার বিষয়টিকে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, বাড়ি কিনতে গিয়ে আইনি বিষয়ে পর্যাপ্ত ধারণা না থাকায় অনেকেই প্রতারণার শিকার হন যা খুবই দুঃখজনক। এ ক্ষেত্রে তিনি বলেন, শুধু বাড়ি বিক্রি করতে এজেন্ট/ব্রোকারের প্রয়োজন এমন ভাবনা সঠিক নয় বরং বাড়ি কিনতেও এজেন্ট নিয়োগ করা অত্যাবশ্যক।
রিয়েল এস্টেট এজেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় বাড়ির দাম, ট্যাক্স, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিল, ইনস্যুরেন্স ইত্যাদি সম্পর্কে একটি ধারণা নিন। এটি বাজেট তৈরিতে সহায়তা করবে। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের ঋণ প্রকল্প রয়েছে। উপযুক্ত ঋণ প্রকল্পটি গ্রহণ করুন। বাড়ি পছন্দ হলে সিটির আইনের কোনো ভায়োলেশন কিংবা কোনো উন্নয়নকাজ অথবা পরিবর্তন করা হলে, তাতে ভবন বিভাগের অনুমোদন রয়েছে কিনা; কিংবা অভিযোগ আছে কিনা তা খোঁজ করুন। এ ব্যাপারে এজেন্টের সহায়তা নিতে পারেন। বাড়ির সার্টিফিকেট অব অকুপেন্সি বা দখলাধিকার যাচাই করুন। আপনার আর্থিক প্রস্তাব গৃহীত হলে চুক্তিপত্র সম্পাদনের আগে অবশ্যই বাড়ি ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিন।
কমিউনিটি এক্টিভিস্ট সারাহ হোসেন নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন মানুষের সেবায়, দেশের কল্যাণে। ইংরেজি নববর্ষ ২০২৩ সালের শুরু দিন তিনি নিজের বেতনের টাকা প্রদান করেছেন বাংলাদেশের একটি মাদরাসায়। নতুন বছর উপলক্ষে মাদ্রাসার ছাত্রদের মাঝে ১২০ কপি পবিত্র আল কোরআন শরীফ, ১৮০ পিছ মিসওয়াক এবং তিনশত মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করেন। নিজ জন্মভূমির প্রতি অগাধ ভালোবাসা, মায়াটান বিদ্যমান সারাহ হোসেনের হৃদয়ে।
যেকোনো সঙ্কটে তিনি পাশে থাকার চেষ্টা করেন। করোনা কালীন সময়ে নিজ উদ্যোগে বহু মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত সিলেটের মানুষের সঙ্কট উত্তরণেও ত্রাণ ও আর্থিকভাবে সহায়তার মাধ্যমে তিনি পাশে ছিলেন।
সারাহ হোসেন বাংলাদেশের পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার সংগঠন গড়ছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে দরিদ্র শিশুরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পথশিশু হিসেবে পরিগণিত হয়। উন্নত দেশগুলোয় দেখা যায়, প্রত্যেক শিশুর দায়িত্ব রাষ্ট্র কোনো না কোনোভাবে পালন করে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে এখনো এটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রযন্ত্র এদের সম্বন্ধে অসচেতন। ফুটপাত, পার্ক, ট্রেন ও বাসস্টেশন, লঞ্চঘাট এসব জায়গায় পথশিশুর অবাধ বিচরণ। অবহেলা, অনাদরে, খেয়ে না-খেয়ে তাদের দিন কাটে। তারা মাদকাসক্ত হচ্ছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শিশু সনদ, শিশু আইনসহ দেশের প্রচলিত আইনে প্রতিটি শিশু তাদের সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশ লাভের জন্য শিক্ষা, খেলাধুলা, খাদ্য ও পুষ্টি, বিনোদন পাওয়ার অধিকার রাখে।
শিশুদের সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে এসব সনদ ও আইনে । কিন্তু আমাদের দেশের পথশিশুরা এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত। বঞ্চিত এই পথশিশুদের সুরক্ষা নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন সারাহ হোসেন।
স্রষ্টার প্রতি যেমন রয়েছে পরম বিশ্বাস, সৃষ্টির প্রতিও রয়েছে অগাধ ভালোবাসা। সারাহ হোসেন; সৃষ্টির সেবায়, সুকর্মে নিবেদিত থাকতে চান আজীবন।
মন্তব্য করুন