বর্তমানে সিলেটসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বনভূমি উজাড় করে স্বল্পমেয়াদী ফলের গাছ রোপণ করে পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমি একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে মনে করি, বনভূমি ধ্বংস করা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এটি জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনতে পারে।
বনভূমি ধ্বংসের পরিবেশগত প্রভাব
বনভূমি কাটার ফলে পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দেয়—ভূমিধস, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং খাদ্য শৃঙ্খলে সংকট তৈরি হয়। বনভূমি শুধু গাছের সমষ্টি নয়, এটি একটি সুসংহত বাস্তুতন্ত্র, যেখানে অসংখ্য প্রাণী, কীটপতঙ্গ, ছত্রাক, এবং মাইক্রোঅর্গানিজম বসবাস করে। এই বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হলে—
১) বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যায়, ফলে অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ে।
২) কার্বন শোষণ কমে যাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তন আরও ত্বরান্বিত হয়।
৩) ভূমিধস ও নদীভাঙনের মতো দুর্যোগ বাড়তে পারে।
দীর্ঘমেয়াদী ফলের গাছ বনভূমির বিকল্প নয়
অনেকে যুক্তি দেন যে, বনভূমি কেটে যদি সেখানে পেয়ারা, আনারস বা অন্যান্য ফলের বাগান গড়ে তোলা হয়, তবে তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হবে না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন—
১) জীববৈচিত্র্যের উপর প্রভাব: বনভূমির গাছ ও উদ্ভিদপ্রজাতির বৈচিত্র্য অনেক বেশি, যা বিভিন্ন স্তরের প্রাণীদের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান তৈরি করে। ফলের বাগান সাধারণত এক বা দুই ধরনের গাছ নিয়ে গঠিত হয়, যা অনেক প্রাণীর বেঁচে থাকার উপযোগী নয়। ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে কমে যায়।
২) পরাগায়ন সংকট: বনভূমি উজাড় করলে মৌমাছি ও অন্যান্য পরাগায়নকারী কীটপতঙ্গের সংখ্যা কমে যায়, যা কৃষিক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। অনেক ফসল উৎপাদনের জন্য স্বাভাবিক পরাগায়ন প্রয়োজন, যা বনভূমি সংলগ্ন এলাকায় সহজেই ঘটে। কিন্তু বন কেটে ফেললে এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয়।
৩) মাটির উর্বরতা হ্রাস: বনভূমির গাছপালা মাটির আর্দ্রতা ও পুষ্টি ধরে রাখতে সাহায্য করে। দীর্ঘমেয়াদী ফলের গাছ লাগানো হলেও, তা বনভূমির মতো একই পরিমাণ জৈবপদার্থ উৎপাদন করে না, ফলে মাটির গুণমান দ্রুত কমে যেতে পারে।
৪) জলবায়ুর উপর প্রভাব: বনভূমি কেটে একক-প্রজাতির ফলের গাছ লাগালে জলবায়ুর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বনভূমি যে পরিমাণ কার্বন শোষণ করে, ফলের বাগান সেটি করতে পারে না। ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যায়, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
কৃষিক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রভাব
বনভূমি উজাড় করার ফলে কৃষির উপর বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে—
১) মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন: বনভূমি আর্দ্রতা সংরক্ষণ ও বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক ধারা বজায় রাখতে সাহায্য করে। বন কেটে ফেলা হলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও ধরণ পরিবর্তিত হতে পারে, যা কৃষিকাজে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
২) মাটির ক্ষয় ও উর্বরতা হ্রাস: বনভূমি মাটিকে স্থিতিশীল রাখে, কিন্তু বন কেটে কৃষি জমি তৈরি করলে মাটির ক্ষয় বেড়ে যায়, ফলে উর্বরতা কমে যায়।
৩) পানি সংকট: বনভূমি ভূগর্ভস্থ পানির পুনঃসংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বন উজাড় হলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যেতে পারে, যা কৃষিকাজের জন্য বড় বাধা সৃষ্টি করবে।
পরিবেশবান্ধব সমাধান
পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে বনভূমি ধ্বংস না করে কিছু বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে—
১) পরিত্যক্ত বা অনাবাদী জমি ব্যবহার: বনভূমি উজাড় না করে অনাবাদী বা অপর্যাপ্ত ব্যবহৃত জায়গাগুলোকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।
২) ইকো-ট্যুরিজম প্রসার: বনভূমি সংরক্ষণ রেখে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুললে, বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য টানবে আরও বেশি পর্যটককে, যা দীর্ঘমেয়াদে বেশি লাভজনক হবে।
৩) বন পুনরুদ্ধার: যেখানে বন ইতোমধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে, সেখানে নেটিভ গাছ লাগিয়ে বন পুনরুদ্ধার করা উচিত, যাতে বাস্তুতন্ত্র আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে।
বনভূমি ধ্বংস করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, তা স্বল্পমেয়াদী হোক বা দীর্ঘমেয়াদী ফলের গাছের বাগান তৈরির জন্য হোক। এটি শুধু পরিবেশ নয়, কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। আমাদের উচিত টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব পর্যটন ও কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা একটি সুস্থ, সবুজ ও বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে পারি।
“গাছেরও প্রাণ আছে, আপনি যদি গণহারে গাছ কাটেন তাহলে আপনি ফেসিস্ট”
মন্তব্য করুন