‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’ গানটি খুব প্রিয় ছিলো ফজলু ভাইয়ের। বৃষ্টির দিনে অসংখ্যবার তাকে গুনগুন করে গাইতেও দেখেছি। সেই শ্রাবন দিনেই আমাদের অগ্রজ কবি ফজলুল হক চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বিয়ানীবাজারের পিতৃভূমিতে। শ্রাবণধারা যদি সব দুঃখ ধুয়ে নিয়ে যেতো তাহলে আর বলার কিছু ছিলো না।
কবি কি আগে থেকেই প্রস্থানের খবর জেনে গিয়েছিলেন? আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে নিজের একটি ছবি পাঠিয়ে লিখলেন, ‘ছবিটি রেখে দিও, হয়তোবা কাজে লাগানো যাবে, কোন একদিন।’ আর ১৩ জুলাই তার নিজহাতে দুই প্রিয়জনকে লেখা চিরকুট আসলেই আমাদেরকে ব্যথিত করে। শেষ দুই লাইনে তিনি লিখেছেন, ‘‘জীবন খরচ করে জেনে গেলাম ‘দুঃখের তপস্যা এ জীবন’’।
অবসরপ্রাপ্ত ছোট চাকরিজীবী ফজলুল হকের জীবনে সংকট ছিলো, বিশেষ করে তিন সন্তানকে পড়ালেখা করাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন। তবে একই সঙ্গে ছিলো প্রবল আত্মসম্মানও। কাউকে মুখ ফুটে কোনোদিন নিজের কষ্টের কথা জানাতে চাননি। ফলে সাম্প্রতিক অসুস্থতার খবরে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সহযোগিতার আহবান জানালে সবচেয়ে বেশি বিব্রত হয়েছিলেন তিনি নিজে। সিলেটে তাকে দেখতে গেলে বাকশক্তি ক্ষীন অবস্থায় আস্তে আস্তে কানে কানে বলেছিলেন, এখনও জানি না কী হয়েছে, কত টাকা লাগবে? এই অবস্থায় ফেসবুকে হাত পেতে ফেললে আমার মান-সম্মান আর কিছু থাকে ! অবসরে গিয়ে যে টাকা পেয়েছি আমি চাই তা দিয়েই চিকিৎসা শুরু হোক। যদি একান্ত বিপদে পড়ি তখনও ফেসবুকে নয়, আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাদেরকে জানাবো।’ আরেকটি আকুতি ছিলো ‘ টাকা চাই না, আমাকে ঢাকায় নিয়ে ভালো ডাক্তারের হাওলা করো। এই ক্ষেত্রে আমি তোমার উপরই নির্ভর করতে চাই।’
ফজলু ভাইকে ঢাকায় আনা হলো। ডাক্তার দেখানো হলো। পরীক্ষা নিরীক্ষাও শুরু হলো। প্রাথমিকভাবে ধরা পড়লো টিবি হয়েছে। ব্যবস্থাপত্র নিয়ে তিনি সিলেট গেলেন। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে বলেও জানলাম। কথা ছিলো আবার আসবেন ২৪ জুলাই কিন্তু জ্বরের কারণে আসতে পারেননি। আর সর্বশেষ ২৬ জুলাই মস্তিষ্কে মারাত্বক রক্তক্ষরণে তিনি চলে গেলেন সবকিছুর উর্ধ্বে। এতো তাড়াতাড়ি এভাবে যেতে হয়? চিকিৎসার যে দায়িত্ব নিয়েছিলাম সেটাতো শেষ হলো না। কবির শুভাকাঙ্খীদের আমি কি জবাব দেবো? ফজলু ভাইয়ের জন্য অনেকেই অনেক কিছু করতে চেয়েছেন। ফেসবুকেও দেখছি শোকের বন্যা। সবার উদ্দেশ্যেই বলি, দায়িত্ব পালনের আসল সময় কিন্তু এখন। কবির তিন সন্তানের একজন এখনও কলেজ পর্যায়ে, আর বড় দুজনের একজন চুয়েটে আর একজন মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তারা অত্যন্ত মেধাবী। শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে তাদের লেখাপড়া চালানোর পথ সুগম করতে পারলে আমাদের একটা দায়িত্ব শেষ হবে। তিনটি কবিতার বই আছে ফজলু ভাইয়ের, আছে অগ্রন্থিত আরও কিছু রচনা। সব মিলে তার রচনা সমগ্র প্রকাশ করা গেলে আরেকটি দায়িত্বও শেষ হবে।
দান নয়, আমরা দায়িত্ব পালন করতে চাই। কবি ফজলুল হকের প্রিয়জন ও শুভাকাঙ্খি সবার প্রতি বিনীত অনুরোধ আসুন আমরা সবাই মিলে কথা বলি, উদ্যোগ নেই, দায়িত্ব পালন করি।
মন্তব্য করুন