রুহুল হুদা মুবিন ভাই। নামটি উচ্চারণ করলেই আমার হৃদয়ে এক অনন্য শ্রদ্ধার আবেশ জাগ্রত হয়। তিনি ছিলেন একজন পরিশীলিত, আদর্শবান, এবং নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তাঁর জীবন ছিলো আলোকিত এক অধ্যায়, যা মিশিগানের বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।
আমি আজও স্পষ্ট মনে করতে পারি, বাংলা সংবাদ পত্রিকা প্রকাশের প্রাক্কালে তাঁর সঙ্গে আমার পরামর্শের মুহূর্তগুলো। মিশিগানে বাংলা ভাষার একটি নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা নিয়ে যখন আমি তাঁর কাছে যেতাম, তিনি ছিলেন আমার পরম অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর মা একজন গুণী লেখিকা এবং তাঁদের পুরো পরিবার অত্যন্ত শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা। এ কারণে তিনি অনুধাবন করতে পারতেন একটি পত্রিকার গুরুত্ব এবং এর মাধ্যমে কমিউনিটির অগ্রগতির সম্ভাবনা। পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি, আমি তখন জেনারেল মোটরসে (GM) একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতাম। ওয়ারেনের সিডিআর মসজিদ, যা GM ইঞ্জিনিয়ারিং টেক সেন্টারের কাছেই, সেখানে নামাজ পড়তে যেতাম। তাই প্রায় প্রতিদিনই রুহুল হুদা মুবিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হতো। বিশেষত শুক্রবার জুমার নামাজের পর আমাদের অনেক কথা হতো। তিনি সবসময় কমিউনিটির উন্নতি নিয়ে ভাবতেন এবং কমিউনিটি এগিয়ে যাক সেটাই চাইতেন। বিশেষ করে ইসলামের খেদমতে তিনি সর্বদা সক্রিয় ছিলেন।
প্রতি বছর রমজান মাসে তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে কুরআন এবং বিভিন্ন উপহার বাক্স তৈরি করে আমাকে দিয়ে বলতেন, “এগুলো তোমার GM-এর অমুসলিম সহকর্মীদের দিয়ো।” আমি এখনো স্পষ্ট মনে করতে পারি, একবার আমি আমার এক আমেরিকান অমুসলিম সহকর্মীকে তাঁর দেওয়া একটি উপহার দিয়েছিলাম। সহকর্মীর আনন্দিত মুখ এবং কৃতজ্ঞতাপূর্ণ প্রতিক্রিয়া আমাকে ভীষণ ভালো লেগেছিল। এটি ছিলো ইসলামিক আদর্শের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেওয়ার এক অনন্য উদাহরণ। পত্রিকা প্রকাশের কয়েকদিন পর, একদিন একটি কমিউনিটি ইভেন্টে আমাদের দেখা হলো। তিনি নিজে থেকেই আমাকে বললেন, “বাংলা সংবাদ”-এ আমরা একটি বিজ্ঞাপন দিতে চাই। শুধুমাত্র ব্যবসার জন্য নয়; কমিউনিটিতে এ রকম একটি পত্রিকা প্রকাশ করছো, সেটাকে সহায়তা করার জন্য আমি সামান্য কন্ট্রিবিউট করতে চাই। কথাটি আমার এত ভালো লেগেছিল যে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
এরপর, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপানোর আগেই তিনি আমাকে বিজ্ঞাপনের বেশিরভাগ টাকা অগ্রিম দিয়ে দিলেন। তখনও কিছু টাকা বাকি ছিল। আমি ভেবেছিলাম, সেটি আর তাকে না বলে আমার মার্কেটিং টিমকে ডিসকাউন্ট দিতে বলি। কিন্তু একদিন হঠাৎ দেখি, আমাদের অফিসে তিনি একটি চেক পাঠিয়েছেন, যেখানে বাকি থাকা টাকাটাও মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোন দিয়ে বললাম, “ভাই, এটা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।” তিনি হেসে বললেন, “কি বলো ইকবাল, এটা তোমার প্রাপ্য।” সেদিন আমি উপলব্ধি করেছিলাম, তিনি কী অসাধারণ নীতি এবং আদর্শের মানুষ।
আমার বাবা বলতেন, “আসল ভালো মানুষ তাকে বলা যায়, যিনি টাকা-পয়সার লেনদেনে সততা দেখান। সাধারণ ভালো বা খারাপ মানুষ চেনা কঠিন, কিন্তু লেনদেন করলেই বোঝা যায় মানুষের আসল চরিত্র।” রুহুল হুদা মুবিন ভাইয়ের সঙ্গে এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে, তিনি ছিলেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত। রুহুল হুদা মুবিন ভাইয়ের মতো মানুষ সমাজে বিরল। তাঁর আকস্মিক মৃত্যু আমাদের কমিউনিটিতে এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে ইসলামিক শিক্ষা ও কল্যাণমূলক কাজে তাঁর অবদান কখনো ভোলার নয়। আজ আমরা তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তাঁর আদর্শ এবং কর্ম আমাদের জন্য চির অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন এবং তাঁর পরিবারকে ধৈর্য ও শক্তি দিন।
এই লেখাটি লিখতে পেরে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। মহামহিম আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যিনি আমাকে এমন একটি সুযোগ দিয়েছেন, যেখানে আমি আমার হৃদয়ের প্রিয় মানুষটির প্রতি আমার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে পেরেছি। বাংলা সংবাদ পত্রিকার পুরো দুই পাতা তাঁকে উৎসর্গ করে আমি আনন্দিত ও সম্মানিত বোধ করছি। আমাদের নতুন প্রজন্ম তাঁর নীতি এবং আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক—এই আমাদের একান্ত কামনা। তিনি আজ আমাদের মাঝে না থাকলেও তাঁর কাজের মাধ্যমে তিনি আমাদের হৃদয়ে চিরজীবী হয়ে থাকবেন।
রুহুল হুদা মুবিন ভাই, আপনি ছিলেন আমাদের প্রেরণা। আপনি আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় চির অম্লান হয়ে থাকবেন।
মন্তব্য করুন