রুহুল হুদা মুবিন। ছিলেন এক উজ্জ্বল প্রদীপ শিখা। যে শিখা নিভে যায় এক বছর আগেই।স্ত্রী , একমাত্র ছেলে রাইয়ান হুদা, মা-বাবা, পরিবার ও কমিউনিটির সবার মাঝে তাঁর মৃত্যু সংবাদটি ছিল অনেকটা মধ্য দুপুরে পূর্ণ সূর্যগ্রহণের অন্ধকারের মতো। তাঁর জীবন যে এত আলোকিত সুন্দর ছিল তা মৃত্যুর পরই আমরা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারি। মিশিগানের পুরো বাংলাদেশী কমিউনিটিতে ছিল হাহাকার।
দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার চেহারাই তাঁর মৃত্যু সংবাদে মলিন হয়ে যায়। মানুষের ঢল নামে জানাজায়। আল ফালাহ মসজিদের ভেতর কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে বাইরেও ছিলেন মানুষ। জানাজার নামাজ শেষে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়- স্বজন ছাড়াও কমিউনিটির অনেক মানুষ তাঁকে শেষ বিদায় জানাতে গোরস্থানে যান। আমেরিকার ব্যস্ত জীবনে জানাজার পরে কাফন-দাফনে অনেকেই ই”ছা থাকলেও শরীক হতে পারেন না ব্যস্ততার কারণে। কিন্ত মুবিন ভাইয়ের দাফনের দৃশ্যও ছিল ব্যতিক্রম। এখানেও মানুষের ঢল ছিল। সবার চেহারার অভিব্যক্তি ছিল যেন তারা সবাই তাদের আপনজন হারিয়েছেন। তাঁর জীবনের স্বার্থকতা এখানেই যে, তিনি নিরবে নিভৃতে আপনজন হিসেবে সবার হৃদয়ের গহীনে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন।
আমার সঙ্গে মুবিন ভাইয়ের পরিচয় ১৯৯১ সালে। এস.এস.সি পাশ করে সিলেট শহরে এসেছি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য। সিরাজুল ইসলাম শাহীন ভাই একদিন সন্ধ্যার পরে নিয়ে গেলেন মুবিন ভাইয়ের দরগামহল্লাহর বাসায়। বললেন, তোমার ব্যাচের দুজন আছে এখানে। চলো তাদের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেই। মুবিন ভাই ও শাহীর সঙ্গে পরিচয় হলো তাদের বাসার ড্রয়িংরুমে। কিন্তু প্রথম দিন তারা দুজনই আমাকে খুব একটা ইমপ্রেস করতে পারেনি। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথা শুনছিলাম তাদের বাবা এডভোকেট সুলনুজ্জামান সাহেবের।
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের মতো মানুষেরা কীভাবে মুসলিম বিশ্বের সম্ভাবনা নষ্ট করছেন তা নিয়ে তিনি আলাপ করছিলেন। তাঁর কথা বলার মধ্যে যে আবেগ ও জজবা থাকতো তা যেকোনো ব্যক্তিকেই মনযোগী শ্রোতা হিসেবে ধরে রাখতো। কিছুদিন আগে তিনিও দুনিয়ার সফর শেষ করে ছেলের সঙ্গে আল্লাহর দরবারে চলে গেছেন। মুবিন ভাইয়ের দাফনের দিন কবরের পাশে হুইল চেয়ারে বসে ফ্যালফ্যাল করে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন। আর জিজ্ঞেস করছিলেন, তুমি কি আমার ছেলেকে চিনতে? জ্বী চিনতাম বলার সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইতেন আমার ছেলে রুহুল হুদা মুবিনের ব্যবহার কেমন ছিল? সে তো আপনাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে নাই? না, কখনও কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন নাই- এই উত্তর শুনার পর তিনি মুবিন ভাইয়ের জন্য দোয়া চাইতেন। কিছু সময় পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর চেহারার দিকে তাকিয়েছিলাম। ছেলে হারানো এক বাবার কাছে আমি চুপি চুপি গিয়ে বললাম, আমার জন্য আপনি একটু দোয়া করবেন। তিনি হাত তুলে দোয়া করলেন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর আমিও দোয়া করেছিলাম- হে আল্লাহ, পিতা-পুত্র দুজনকেই কবরে জান্নাতি চাদরে ঢেকে রাখো।
এরপর মুবিন ভাইয়ের সঙ্গে প্রায়ই কলেজে দেখা হতো। তিনি ছিলেন ইংলিশ অনার্সের ছাত্র। আর উনার ছোট ভাই শাহী ছিল আমাদের সঙ্গে অর্থনীতি অনার্সে। শাহীর সঙ্গে ঘনিষ্টতা বেড়ে যাওয়ায় শাহীর বড় ভাই হিসেবে উনাকে সব সময়ই মুবিন ভাই বলতাম। সম্পর্কটা ছিল ভাই-বন্ধু এরকম। অনার্স শেষে চলে গেলেন লন্ডনে। সেখানেও তিনি সাংবাদিকতা ও সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। তারপর পরিবারের সঙ্গে তিনি চলে এলেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে। পড়াশোনা শেষে দেশে ব্যাংকিং সেক্টরে একযুগেরও বেশি সময় চাকরি করে আমাকেও আসতে হলো মিশিগানে। সময় আবারও দুজনকে মিলিয়ে দিলো একই জায়গায়। মিশিগানে আসার পর আবার দুজনের দেখা হয় অনেক বছর পর। একইসঙ্গে আমি তাঁর মধ্যে দেখতে পাই নতুন এক মুবিন ভাইকে। বিদেশে প্রথম আসার পর কষ্টের দিনগুলোকে কীভাবে আমি অতিক্রম করতে পারি তা নিয়ে তাঁর পেরেশানি আমাকে অবাক করে।
আমাকে ফোন দিয়ে তিনি জানতে চাইতেন আমার কেমন চলছে। আমার মতো মধ্য বয়সে যারা দেশে চাকরি-বাকরি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান তাদের প্রথমদিকের প্রবাস জীবন বেশ কঠিন হয়। বিশেষ করে টাকা পয়সা ছাড়া খালি হাতে যারা আসেন। আমারও আশা ছিল একইরকম। প্রথম ৭/৮ মাস কাজ করে পরিবার চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। ফ্যাক্টরি-কফিশপ এসব কাজে যে আমার কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারতেন মুবিন ভাই। একদিন বললেন, মাহমুদ তুমি ফার্মেসী টেকনিশিয়ানের ট্রেনিংটা করে নাও। এরপর শাহীর ফার্মেসীতে কাজ শুরু করতে পারো। আমি চিন্তা করবো বলে তাঁকে জানালেও এদিকে আগাইনি। মন সায় দেয়নি।
তারপর আমি শুরু করলাম রিয়েল এস্টেট এজন্ট হিসেবে কাজ করা। এই ব্যবসায় যার যতো পরিচিতি তার ব্যবসা ততো ভালো। আমি নিজের গন্ডির বাইরে যেতে খুব স্বাচ্ছন্দবোধ করিনা। এছাড়া মিশিগানেও তখন নতুন। এমতাবস্থায় মুবিন ভাই আবারও ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন কেমন চলছে আমার ব্যবসা। আমি তাকে আমার সমস্যাটি বললাম। কয়েকদিন পর তিনি আমার জন্য পরিকল্পনা নিয়ে হাজির। তাঁর একটি প্রোগ্রামের লিফলেট বিলি করা দরকার হ্যামট্রামিক সিটিতে যেখানে বেশিরভাগ বাংলাদেশীর বসবাস। তিনি বললেন, কিছু টাকা আমাকে দেবেন এই লিফলেট বিলির জন্য এবং সঙ্গে আমার ভিজিটিং কার্ড নিয়ে ঘরে ঘরে যেতে পারি যাতে আমার পরিচিতি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এবারও আমি তাঁর প্রস্তাবটি বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দেই। কিš‘ আমার চাকরি ও ব্যবসা নিয়ে মুবিন ভাইয়ের এই চিন্তার বিষয়টি আমাকে গভীরভাবে আন্দোলিত করে। অন্যের ভালোর জন্য স্বার্থহীন চিন্তার মানুষ আজকাল বিরল হলেও মুবিন ভাইয়ের মতো কেউ কেউ এখনও আছেন- একথা ভাবলেই ভালো লাগে। চোখের সামনের সব অন্ধকার সরে যায়।
অসু¯’তার খবর দেরিতে পাওয়ার কারণে মুবিন ভাইয়ের সঙ্গে হাসপাতালে দেখা হয়নি। আমি যখন হাসপাতালে যেতে চাই তখন তিনি আইসিইউতে। আইসিইউ থেকে ফিরেন লাশ হয়ে। লাশ দেখতে ও জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য গেলাম আল ফালাহ মসজিদে। লাশের খাটিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে শাহী আমাকে বললো- “তোমার লেখা ভাই খুব পছন্দ করতেন। তোমার কথা আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন।” শাহীর সঙ্গে কথা বলছি আর চারদিকে জানাজায় শরীক হতে আসা শত শত মানুষের দিকে মসজিদের চারপাশে তাকাচ্ছিলো। সমানে দাঁড়িয়ে আছে রাইয়ান হুদা, মুবিন ভাইয়ের একমাত্র ছেলে। লম্বা এবং হালকা-পাতলা গড়নের ছেলে। চোখ মেলে সে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিš‘ তার দৃষ্টি কোথাও ফোকাস করছে বলে মনে হয়নি। আমার চোখের পানি খুব কষ্ট করে আটকে রেখে আমি রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি নিশ্চিত সে তাকাচ্ছিল কিন্তু কোনো কিছুই দেখছিল না। তার চোখে ছিল বিশাল শূন্যতা। প্রখর আলোর মধ্যে সবকিছু অন্ধকার। মহান আল্লাহ নিশ্চয়ই তার আলোকিত পিতার ঈমান এবং সৎকর্মের বদৌলতে তার জীবনের সব অন্ধকার দূর করে চলার পথ আলোকিত করে দিবেন।
মানুষকে বলা হয় জীবন ফুলের মতো সুন্দর করার জন্য। রুহুল হুদা মুবিন ভাইয়ের জীবন ছিল ফুলের চেয়েও সুন্দর। ফুল যখন ফুটে তখন তার সৌন্দর্য্য ও সুবাস দুটো দিয়েই মানুষকে বিমোহিত করে। কিš‘ ঝরে যাওয়ার পর আর কিছু থাকে না। মুবিন ভাই যতদিন বেঁচে ছিলেন মানুষের সেবা ও ভালো কাজের মাধ্যমে জীবনকে ফুলের মতো সুন্দর করে রেখেছিলেন। আর মারা যাওয়ার পর মানুষের হাহাকার ও কান্নায় যেন তার রেখে যাওয়া সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে। এ যেন এক প্রশান্ত আত্মা- স্ত্রী-সন্তান রেখে তাঁর মা’বুদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আজীবন স্বপ্নকে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অবাক বিস্ময়ে আমরা সবাই তাঁর যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে আছি। নিশ্চয়ই মহান মা’বুদ তাঁর এই ব্যাকুল আত্মাকে গ্রহন করেছেন পরম মমতায়। কবরে রেখেছেন ঐ শিশুর মতো যে তার মায়ের কোলে দুধপান করে ঘুমিয়ে পড়ে। হে আল্লাহ, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি তোমার এই বান্দার জীবনের লক্ষ্য ছিল তোমার সৃষ্টি অর্জন করা। তুমি তাঁর কবরকে জান্নাতের সুবাস দিয়ে সুবাসিত করে রেখো। আমাদের সকল মৃতদের ক্ষমা করো এবং আমাদেরকে সৎকর্মশীল হিসেবে জীবনযাপনের তৌফিক দিও। আমীন।
লেখকঃ মাহমুদ রহমান
মন্তব্য করুন