আমাদের অনেকে তাকে বলেন রাজনীতির রহস্য পুরুষ। কেউ কেউ তাকে বলেন কাপালিক। অবলীলায় সকল সমালোচনা উপেক্ষা করেন তিনি।
অপরিমেয় মানসিক প্রশান্তির অধিকারী এই বীর বাঙালি আর কেউ নন তিনি সকলের প্রিয় সিরাজুল আলম খান দাদাভাই। এক অনন্য সাধারণ বাঙালি। ইতিহাস তাকে বাঙালির দেদীপ্যমান ‘বাতিঘর’ হিসেবে ইতিহাসের ঐতিহাসিকতায় ধারণ করবে।
৮২ বছর বয়সে মারা গেছেন সিরাজুল আলম খান। দীর্ঘদিন থেকে উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রামণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) চির বিদায় নেন জাসদের অন্যতম এই প্রতিষ্ঠাতা। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা সংবাদ’ পত্রিকা পরিবারের পক্ষ থেকে সিরাজুল ইসলাম খান দাদাভাই’র প্রতি রইল শ্রদ্ধা।
সিরাজুল আলম খান হচ্ছেন বাঙালি জাতির ইতিহাসের সেই ব্যক্তি যিনি বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বাধিকারের আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম সংগঠক। তিনি একটি জাতিকে একটি পরিচয় দিতে পেরেছিলেন।
পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে স্বাধীন করতে ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ গঠন করেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ বা ‘নিউক্লিয়াস’।
পরে আবুল কালাম আযাদ ও আব্দুল মান্নান নিউক্লিয়াসে যুক্ত হলেও তারা সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পাvরেননি; কিন্তু মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন এবং নিউক্লিয়াস ও এর অনুসারীদের একটি আদর্শবাদী ধারায় গড়ে তুলতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন।
সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াস বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি-অনুপস্থিতিতে পরিচালনা করেন বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বাধীকারের আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
আন্দোলন পরিচালনার ধারায় তিনি ও তার সহযোদ্ধা অনুসারীগণ ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান প্রবর্তন করেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্ধারণ করেন, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তৈরি ও উত্তোলন করেন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। না, এসবে তিনি ও তার অনুসারীগণ ছাড়া অন্য কেউ বা অন্য কোনও দল বাংলার জনগণকে নেতৃত্ব দেননি। এর চেয়ে বড় পরিতৃপ্তির আর কী হতে পারে একজন ব্যক্তি ও তার সহযোদ্ধাদের কাছে?
সিরাজুল আলম খান জাসদ গঠনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করলেও বঙ্গবন্ধুর সাথে তার সম্পর্কের কখনও অবনতি হয়নি। তারা উভয়ে পরস্পরের খোঁজ-খবর রেখেছেন।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জাসদ ও আওয়ামী লীগ বারবার কাছাকাছি এসেছে। জাতীয় রাজনৈতিক প্রয়োজনে এই ঐক্য করেছে উভয় দল; কিন্তু ঐক্য সংহত হতে পারেনি বিবিধ কারণে। অবশেষে আবারও ১৪ দলের কাঠামোতে রাজনৈতিক ঐক্যে রয়েছে জাসদ ও আওয়ামী লীগ।
সিরাজুল আলম খান ১৯৮৩ সালে জাসদ রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। সামরিক সরকারকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে জাসদ সিরাজুল আলম খানকে পরিত্যাগ করে। সিরাজুল আলম খানের ওই অবস্থান ছিল তার চিন্তার পরিবর্তনের প্রকাশ।
তিনি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ওই সহযোগিতা করেছেন তা নয়। জনগণের কল্যাণই ছিল তার লক্ষ্য। তিনি ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া-সুবিধা-অসুবিধা দ্বারা পরিচালিত মানুষ ছিলেন না। চিরকুমার সিরাজুল আলম খানের কোনও ব্যক্তিগত সম্পদ ছিল না, কোন বিলাস ছিল না।
বিশিষ্ট লেখক মহিউদ্দিন আহমদের ‘প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান’ বইটিতে সিরাজুল আলম খানের শেষ ইচ্ছার কথা জানা গেছে।
সিরাজুল আলম খান বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর কোনো শোকসভা হবে না। শহীদ মিনারে ডিসপ্লে হবে না লাশ। যত দ্রুত সম্ভব নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে মরদেহ, যা ঢাকা থাকবে একটা কাঠের কফিনে। মায়ের একটা শাড়ি রেখে দিয়েছি। কফিনটা শাড়িতে মুড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, মায়ের কবরে।’
খুলনা জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করে ঢাকা কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সমাপ্তি টানা সিরাজুল আলম খান। গত ৯ জুন শুক্রবার জীবনের সমাপ্তি টানা এই বীর ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার আলীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্মেও সাথে জড়িয়ে আছে তার কৃতি ও স্মৃতি; বিস্মৃতি কোনোদিন তাকে কেড়ে নিতে পারবে না। বাঙালির মহান জাতীয় বীর সিরাজুল আলম খান অমর হোন।
মন্তব্য করুন