মিশিগান বাংলাদেশি আমেরিকানদের বসবাসের জন্য অত্যন্ত প্রিয় ও আকর্ষণীয় জায়গা। প্রতিনিয়তই এ অঙ্গরাজ্যে বাংলাদেশি মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সমৃদ্ধ হচ্ছে মুসলিম কমিউনিটি। যতই মানুষ বাড়ছে, ততই মানুষকে ইসলামের শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান প্রদান করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। উন্নত বিশ্বের সংস্কৃতির সাথে তালে মেলাতে গিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম যাতে মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে ছিটকে না পড়ে, সেজন্য মুসলিম সেন্টারগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। মিশিগানে বসবাসরত বাংলাদেশি মুসলিম কমিউনিটির নতুন প্রজন্মকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিতকরুণ, দ্বীনের দৈনন্দিন দাবি পালন এবং সার্বজনীন দাওয়াতকে সকল কমিউনিটির কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আইডিয়াল ইসলামিক সেন্টার’। এ সেন্টারের আওতায় রয়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে: দারুল ইহসান লতিফিয়াহ মাদরাসা, আল মিসবাহ ইনস্টিটিউট ও আল ইহসান ইসলামিক সেন্টার। এ তিনটি সেন্টার নিয়ে বাংলা সংবাদের বিশেষ আয়োজন।
দারুল ইহসান লতিফিয়াহ মাদরাসা, হ্যামট্রামিক
দারুল ইহসান মাদরাসার যাত্রা শুরু হয় ২০০০ সালে। শুরুতে এ মাদরাসা আবাসিক হলেও ২০১২ সালে মিশিগান স্টেটের হ্যামট্রামিক শহরের ২৭২১ হলব্রুক স্ট্রিটে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। এখানে একই সাথে মসজিদ-মাদরাসাসহ নানা ইসলামী শিক্ষামূলক কোর্সসমূহ চালু আছে। এখানকার কোর্সগুলো হচ্ছে:
ফুলটাইম হিফজুল কুরআন
পার্টটাইম আফটার স্কুল হিফজুল কুরআন
তা’লিমুল কুরআন অ্যান্ড ইসলাম কোর্স (মক্তব)
হিফজুল কুরআন ও মক্তব (শনি ও রবিবার)
সামারকালীন দারুল ক্বিরাত প্রশিক্ষণ।
উপরোক্ত কোর্সছাড়াও আরো দুটি কোর্স চালু হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে:
ফুলটাইম স্কুল (একাডেমিক)
ফুলটাইম স্কুল (ইসলামিক স্কুল)
এ দুটি কোর্সের মাধ্যমে যেকোনো শিক্ষার্থী হাইস্কুল শেষ করার পাশাপাশি হাফেজে কুরআন কিংবা আলেম/আলেমা হতে পারেন। এ দুটি কোর্স স্টেট অ্যান্ড ফেডারেল সার্টিফাইড টিচার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া হালাল লাঞ্চ, এসএটি প্রিপারেশন কোর্স, ফুলরাইডস বা ভালো স্কলারশিপ প্রাপ্তি বা যেকোনো বিষয়ে ছাত্র/ছাত্রী অনগ্রসর হলে উপযুক্ত টিউটরিং-এর সুব্যবস্থা রয়েছে। শুধু তাই নয়, আরো অনেক দক্ষ শিক্ষাবিদগণের পরামর্শ দ্বারা পরিচালিত হবে ফুলটাইম ইসলামিক স্কুল।
আল মিসবাহ ইনস্টিটিউট ও আল ইহসান ইসলামিক সেন্টার
আল মিসবাহ ইনস্টিটিউট ২০২০ সালের ২৩ মার্চ করোনাকালীন সময়ে আল মিসবাহ ইনস্টিটিউট ও আল ইহসান ইসলামিক সেন্টারের যাত্রা শুরু হয়। এর অবস্থান মিশিগানের ওয়ারেন শহরে। হ্যামট্রামিক শহরে জায়গার সংকুলান না হওয়ায় ওয়ারেন শহরে প্রতিষ্ঠানের শাখা করতে হয়। দারুল ইহসান লতিফিয়াহ মাদরাসা থেকে যারা হিফজুল কুরআন সম্পন্ন করার তাদেরকে আলিম কোর্সে ভর্তির জন্য একই সাথে মসজিদ ও ইসলামিক স্কুল শুরু করে।। একটি রেডিমেইড (চার্চ) স্কুল ও খ্রিস্টানদের উপাসনালয় ক্রয় করে এ প্রতিষ্ঠান করা হয়। এ সেন্টারের মক্তব্যে ১১১ জন, হিফজে ২০ জন, আলিম কোর্স ৩ ব্যাচে ৩৫ জন ছাত্র/ছাত্রী পড়াশোনা করছেন। এখানে প্রতিবছর আলিম কোর্সের একটি ব্যাচ চালু আছে। এছাড়া আল মিসবাহ ইনস্টিটিউটে ফুলটাইম ইসলামিক স্কুল চালু হয়েছে।
সিলেবাস
আইডিয়াল ইসলামিক সেন্টারে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার জন্য শক্তিশালী সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, মদিনা ইউনিভার্সিটি, আমেরিকার বিখ্যাত জায়তুনা কলেজ, দারুল মোস্তফা ইয়েমেন, দারুল উলুম জাকারিয়া সাউথ আফ্রিকা, দারুল হাদিস লতিফিয়াহ ইউকেসহন বেশ কয়েকটি বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসকে অনুসরণ করা হয়েছে।
সেন্টারের শিক্ষক-শিক্ষিকা
আইডিয়াল ইসলামিক সেন্টারে ১২ জন শিক্ষক/ শিক্ষিকা রয়েছেন। অনলাইন/গেস্ট টিচার রয়েছেন ২ জন। প্রত্যেকেই বোর্ড পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ডিগ্রিধারী। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিধারী শিক্ষকগণও অনলাইনে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। প্রায় প্রত্যেক শিক্ষকই ইংরেজিতে বেশ দক্ষ। তাদের মধ্যে একজন শিক্ষক ইংরেজিতে অনার্স, মাস্টার্স এবং কামিল বোর্ড পরীক্ষায় মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আলিমা কোর্সের দায়িত্বে রয়েছেন ইয়েমেনের দারুজ জাহরা থেকে আলিমা সম্পন্নকারী একজন হাফেজা শিক্ষিকা। এছাড়া বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন গ্র্যাজুয়েট শিক্ষক সেন্টারে শিক্ষকতা করে থাকেন। হিফজুল কুরআনের জন্য রয়েছেন উপদেষ্টা ও গেস্ট শিক্ষক আল্লামা ক্বারী ফখরুল হুদা। তিনি পিএইচপি কুরআনের আলো প্রতিযোগিতার পরীক্ষক। এছাড়া দীর্ঘ চার দশক কাতারে সরকারি ইমাম ও বর্তমানে সরকারি পরীক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। এছাড়া হুফ্ফাজুল কুরআন বোর্ড থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাঁচজন হাফেজে কুরআন শিক্ষক। মক্তবেও রয়েছেন দারুল ক্বিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টের অধীনে ক্বারী কোর্স সম্পন্নকারী প্রায় দশজন ক্বারী।
সেন্টারের প্রকাশনা
আইডিয়াল ইসলামিক সেন্টারের নিজস্ব প্রকাশনা রয়েছে। এ পর্যন্ত পঁচিশটি’রও বেশি ইসলামী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ গ্রন্থগুলো আরবি ও ইংরেজিতে অনুবাদকৃত। তাছাড়া ছাত্র/ছাত্রীদের রয়েছে বিভিন্ন কোর্সের দৈনিক প্লানার বুক। আলিম ক্লাসের শিক্ষকের পাঠদানের সাথে সাথে কিছু গ্রন্থ বের হয়ে আসছে। আরবি থেকে আরবি কিছু গ্রন্থও আলিম ক্লাসের শেষের দিকে পড়ানো হচ্ছে। সব গ্রন্থই সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত।
প্রশিক্ষণ
আইডিয়াল ইসলামিক সেন্টার শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন দেশকে খ্যাতিমান স্কলারদেরকে নিয়ে আসা হয়। এছাড়া শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরকে ইংল্যান্ড থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসতে হয়। এমনকি সেন্টারের প্রিন্সিপাল সাহেবও নিজে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
রিপোর্ট কার্ড ও প্যারেন্ট টিচার মিটিং
প্রতি তিনমাস অন্তর রিপোর্ট কার্ড ও প্যারেন্ট টিচার মিটিং-এর আয়োজন করা হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরকে এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে বদলি করে যোগ্যতা যাচাই-বাচাই করার কাজও চালু আছে। এছাড়া প্রিন্সিপাল সাহেব নিজেও ক্লাস নিয়ে থাকেন। নিয়মিতই টিচারদেরকে নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের উন্নয়নের জন্য মিটিং করা হয়। এছাড়া এ সেন্টারের অধীনে অনেকগুলো খণ্ডকালীন ইনটেনসিভ কোর্স চালু আছে। এগুলো হচ্ছে: সিরাহ, প্যারেন্টিং, আরবি ভাষা, ম্যারেজ কাউন্সেলিং, উর্দু ও বাংলা ভাষা প্রভৃতি। উপরোক্ত কর্মসূচি ছাড়াও আছর থেকে এশা পর্যন্ত তিন ওয়াক্ত জামাতে নামাজসহ ইসলামী শিক্ষা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং বিভিন্ন সুবিধা প্রদানের চিন্তাভাবনা রয়েছে। এ সেন্টারে শীগ্রই বয়স্কদের জন্য একটি কোর্স চালু হবে বলে জানান কর্তৃপক্ষ।
আইডিয়াল ইসলামিক সেন্টার মিশিগানে ইসলামী শিক্ষা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম ছাড়াও এ সেন্টার থেকে দাওয়াহ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কমিউনিটি সার্ভিস হিসেবে এ সেন্টার থেকে হেল্থ ক্লিনিক, ফ্লু ভ্যাক্সিন এবং ওবামা কেয়ারের ফ্রি সুবিধা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সামগ্রিক অর্থে, আইডিয়াল ইসলামিক সেন্টার পুরো মিশিগানে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। এ আলো ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বে। মানুষের অন্তর আলোকিত হোক হেদায়াতি নূরে।
মন্তব্য করুন