আমরা হতভাগা এক জাতি। বারবার দাঁড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়েছি-ব্রিটিশ থেকে ভারত-পাকিস্তান। সব জায়গায় আমরা কোনো না কোনোভাবে গোলামির জিঞ্জিরে বাধা ছিলাম। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে আমরা পেয়েছি আমাদের জাতিসত্তা-এক নদী রক্ত আর লক্ষ শহীদের বিনিময়ে। আমাদের স্বপ্ন ছিল একটা স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সাম্য, ন্যায়বিচারের একটি দেশ-আমরা কি পেয়েছি? উত্তর হবে, না। মিথ্যা স্বপ্নের মরীচিকার পেছনে ঘুরছে জাতি। বারবার খেয়েছে ধোঁকা। স্বৈরশাসকের জাঁতাকলে পৃষ্ঠ হয়েছে সোনার বাংলাদেশ। স্বৈরাচার এরশাদ ৮২-৯০ পর্যন্ত দেশের গণতন্ত্রকে বোতলবন্দি করে রেখেছিল। শহীদ নুর হোসেনের বুকের তাজা বুলেট আর হাজারো তাজা প্রাণের বিনিময়ে স্বৈরাচার মুক্ত হয় বাংলাদেশ। আবারও ফিরে আসে গণতন্ত্র। মানুষ আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখে একটি নতুন বাংলাদেশের। ১৯৯১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন বেগম খালেদা জিয়া।
অগোছালো একটা দেশ। অথনৈতিক দূরবস্থা। তারপর কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আর বিএনপির কিছু নেতাকর্মী চাঁদাবাজি- টেন্ডারবাজির সাথে জড়িয়ে পড়ে। এর ফলশ্রæতিতে ১৯৯৬ সালে তারা ক্ষমতা হারায়। পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে যেই লাউ সেই কদু। তারা আগের সরকারের চেয়ে কয়েকগুণ বেশিমাত্রায় জনগণের সাথে প্রতারণা, লুটপাট, অগ্নিসন্ত্রাস করে। তারপরও ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মন্দের ভালো একটা গণতান্ত্রিক ধারায় ছিল দেশ। কিন্তু ২০০৮ সালের পরে আবারও পথ হারায় স্বদেশ।
নতুন এক স্বৈরাচারের উত্থান হয়। ক্ষমতার মোহে তারা অন্ধ হয়ে যায়। যে দলটির নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল সে দলের কাছে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে। নতুন রূপে স্বৈরশাসক যাত্রা শুরু করে। ২০০৮ সাল থেকে বিগত ১৫ বছর জিম্মি ছিল দেশের ১৭ কোটি মানুষ। কেড়ে নেওয়া হয় মানুষের মৌলিক অধিকার। তিন তিনটি নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। লুট করা হয়েছে মানুষের ভোটাধিকার। ভিন্নমতের মানুষের উপর চালানো হয় নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন। বিরোধী দল দমনে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে চালায় নারকীয় তাণ্ডব। জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে শত শত নেতাকর্মীকে হত্যা, গুম করে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে বন্দি করে রাখে। দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করে। সুইস ব্যাংক যেন বাংলাদেশিদের দখলে চলে যায়। উন্নয়নের নামে দেশে দুর্নীতির মহাবিপ্লব ঘটে।
রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে পাতি নেতার দাম্ভিকতায় মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে আবু সাইদের বুকের বুলেট, মুগ্ধের মাথার খুলিসহ হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে উদয় হয় নতুন এক সকালের। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। দেশ আবার নতুন করে স্বাধীন হয়। লক্ষ কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে এসে আনন্দ মিছিল করে। আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধানের কাছে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসকে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন।
দেশের এই ক্লান্তিলগ্নে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাদের প্রস্তাবে রাজি হন। নতুন এক বাংলাদেশের শুভযাত্রা হয়। দেশের মানুষের দাবি-পলাতক স্বৈরাচারের দোসরদেরকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করা। তিনি ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। এখন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার নতুন করে নির্বাচন দেবে। মানুষ তাদের পছন্দের সরকার গঠন করবে। আমরা আশা করি, যারা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করবে, তারা যেন জনগণের উন্নয়নে, দেশের স্বার্থে কাজ করে যান। আর কোনো স্বৈরাচারের জন্ম যেন বাংলার মাটিতে না হয় এই প্রত্যাশা ১৭ কোটি মানুষের। নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় বাংলাদেশ।
হাবিব রহমান: কবি, সংগঠক, কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব
মন্তব্য করুন