সমাজের প্রধান উপাদান ব্যক্তি। তাই আদর্শ সমাজ গঠনে ব্যক্তি গঠনই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কোনো আদর্শ বা চেতনা যত সুন্দরই হোক, যদি সেই আদর্শ অনুযায়ী ব্যক্তি গঠন না করা হয়, তাহলে আদর্শ সমাজ গঠনের স্বপ্ন একসময় ধুলোমলিন হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে তার বাস্তবায়নও হয়ে পড়বে অসম্ভব এবং সুদূরপরাহত বিষয়। আদর্শ সমাজ গঠন করতে হলে এ ব্যাপারে যার অভিজ্ঞতা রয়েছে, সবার সামনে যিনি এর মডেল উপস্থাপন করেছেন- প্রথমে তাঁর শরণাপন্ন হতে হবে। রাসুল (সা.) পুরো পৃথিবীর সামনে শ্রেষ্ঠ আদর্শ সমাজের মডেল উপস্থাপন করেছেন। তাই আমরা যদি রাসুলের সিরাতকে সামনে রেখে তাঁর সমাজ গঠন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যে, তিনি ব্যক্তি গঠনের ক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক নীতি ও কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। যার আলোকে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। নীতি ও কর্মপদ্ধতিগুলো নিম্নরূপ-
এক.
তাওহিদ তথা একত্ববাদের বাণী ব্যক্তির হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করা। যেন শত প্রভুর গোলামির জিঞ্জির তথা শিরক থেকে মুক্ত হয়ে সে এক আল্লাহর দাসত্বে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। তাওহিদের সঠিক চেতনা ও বিশ্বাস মানুষকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে মাথানত না করতে শিক্ষা দেয়। তাওহিদ আদর্শ ব্যক্তিত্ব গড়তে সহায়তা করে। সর্বোপরি সমাজের একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের মূল প্রেরণা ও ভিত্তি হিসেবে কাজ করে তাওহিদ বা এক আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস।
দুই.
রিসালাত তথা রাসুল (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। তিনি সর্বশেষ নবী। তাওহিদের বাণীর পাশাপাশি তার রিসালাতের মর্মও ব্যক্তির হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করা। অর্থাৎ আমার সবকিছু আল্লাহর জন্য নিবেদিত। তবে তা হবে রাসুল (সা.) এর পথ ও পাথেয় অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে। এতে আমার প্রবৃত্তির কোনো প্রভুত্ব থাকবে না। থাকবে না কোনো কায়েমি স্বার্থবাদীদেরও কর্তৃত্ব।
তিন.
আখেরাতের বিশ্বাসের সরল পাঠ। অর্থাৎ, প্রতিটি মানুষের মৃত্যু পরবর্তী আরেকটি জীবন রয়েছে। যেটাকে পরকালীন জীবন বলা হয়ে থাকে। যেখানে তার ভালোমন্দ কাজের প্রতিদান দেওয়া হবে। জবাবদিহি করতে হবে প্রত্যেক কৃতকর্মের। সেখানে আছে অনিন্দ্য সুখের জান্নাত। আছে দুঃখ ও কষ্টে ভরা জাহান্নাম। পার্থিব জীবনে আমার কৃতকর্ম ভালো হলে আমলনামা দেওয়া হবে ডান হাতে। পুরস্কার হিসেবে আবাসস্থল হবে জান্নাত। কর্মফল ভালো না হলে আমলনামা দেওয়া হবে বাম হাতে। শাস্তি হিসেবে বাসস্থান হবে জাহান্নাম। সুতরাং এই জীবনেই আমাকে সতর্ক ও সচেতন হয়ে জীবনযাপন করতে হবে। পরকালের প্রয়োজনীয় পাথেয় এখান থেকেই সংগ্রহ করে নিতে হবে। ব্যক্তি গঠনের ক্ষেত্রে এমন বোধ ও বিশ্বাস ব্যক্তির মাঝে প্রতিষ্ঠিত করা ছিল ব্যক্তি গঠনের ক্ষেত্রে রাসুলের অন্যতম নীতি।
চার.
চারিত্রিক নৈতিকতার প্রশিক্ষণ প্রদান। ব্যক্তি গঠনের ক্ষেত্রে নৈতিকতা শিক্ষাদানের বিকল্প নেই। রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে হাতে-কলমে নৈতিক চরিত্র অর্জনের প্রশিক্ষণ দান করেছেন। নীতিহীন কাজ আর নৈতিকতাহীন মানুষের কোনো মূল্য নেই। কোনো ব্যক্তি জ্ঞানের সাগর বা পণ্ডিত হতে পারেন; কিন্তু তিনি যদি নৈতিক চরিত্রের অধিকারী না হন, তাহলে তিনি সমাজে একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারবেন না। তাই নৈতিকতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চারিত্রিক নৈতিকতার দুটি দিক রয়েছে।
১.
ইতিবাচক দিক বা অর্জনীয় গুণ। যথা- তাকওয়া ও খোদাভীতি, তাওয়াক্কুল ও আল্লাহ ভরসা, বিনয় ও নম্রতা, স্নেহ ও মায়া, দয়া ও সহমর্মিতা, সবর ও শোকর, ক্ষমা ও উদারতা, অল্পেতুষ্টি ও দানশীলতা, ইহসান ও লজ্জাশীলতা, সততা ও সত্যবাদিতা, আমানতরক্ষা ও ন্যায়পরায়ণতা এবং ত্যাগ ও কোরবানি ইত্যাদি।
২.
নেতিবাচক দিক বা বর্জনীয় গুণ। যথা- অহংকার ও আত্মগর্ব, ক্রোধ ও লৌকিকতা, লোভ ও লালসা, হিংসা ও বিদ্বেষ, গিবত ও পরনিন্দা, চোগলখুরি ও পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যা ও অপবাদ, খেয়ানত ও মন্দ ধারণা, অশ্লীলতা ও কামাসক্তি, কৃপণতা ও জুলুম এবং কোনো মোমিনকে অপমান করা ইত্যাদি।
চারিত্রিক নৈতিকতার এই অর্জনীয় ও বর্জনীয় গুণগুলোর মাঝে সমন্বয় ঘটানো ছাড়া একজন মানুষ নৈতিক চরিত্রের শীর্ষচূড়ায় পৌঁছতে পারবে না। গঠিত হবে না আদর্শ ব্যক্তিসত্তাও। রাসুল (সা.) নবুয়তের সুদীর্ঘ ২৩ বছর সাহাবায়ে কেরামকে নৈতিকতার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আদর্শ ব্যক্তিরূপে গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি উন্নত চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’
উপরোক্ত চারটি নীতি বা কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে আদর্শ ব্যক্তি গঠন করা সম্ভব-একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। যেমনটি রাসুল (সা.) দেখিয়েছেন। তাঁর পথকে অনুসরণ করে পরবর্তী সময়ে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবে তাবেয়িন ও সালাফে সালেহিরা ব্যক্তিত্ব গঠন করেছেন। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ব্যক্তিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, কয়েকজন ব্যক্তি মিলে গঠিত হয় পরিবার। কয়েকটি পরিবার মিলে গঠিত হয় সমাজ। আর বহু সমাজের সামষ্টিক রূপ হলো রাষ্ট্র। তাই আদর্শ সমাজ গঠনে ব্যক্তির বিকাশ ও গঠনের গুরুত্ব অপরিসীম।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
মন্তব্য করুন