মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন ১৯৫৮ সালের ২৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের গ্যারি শহরে জো জ্যাকসন এবং ক্যাথরিন জ্যাকসনের কোল আলো করে পৃথিবীতে আসেন। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত ঘরে জন্মগ্রহণ করে নিজ গুণে সমগ্র বিশ্বে নিজের নাম ছড়িয়ে দেন এই পপ সংগীতের রাজা। সংগীত জগতের বাঁক বদলে দেন তিনি। বিশ্বের সংগীতপ্রেমী মানুষের অন্তরে ঠাঁই নেন মোহনীয় কন্ঠের দ্যুতি ছড়িয়ে।
সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, লেখক, অভিনেতা, সমাজসেবক, ব্যবসায়ী যে বিশেষণ জুড়ে দিতে চান অনায়াসে মাইকেল জ্যাকসন নামের সঙ্গে জুড়ে দিতে পারবেন। জ্যাকসন পরিবারের দশ ভাই-বোনের মধ্যে অষ্টম মাইকেল মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পারিবারিক ‘জ্যাকসন ফাইভ’ নামের সংগীত দলের কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে ১৯৬৩ সালে পেশাদার সংগীত জীবন শুরু করেন।
বিংশ শতাব্দীর সংগীত জগতের অন্যতম কিংবদন্তি ‘এমজে’ খ্যাত মাইকেল জ্যাকসন সংগীত, নৃত্য এবং ফ্যাশন জগতসহ ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনায় চার দশকেরও অধিককাল মাতিয়ে গেছেন পুরো পৃথিবী। গানের সঙ্গে কারাতেও খুব ভালো পারতেন। ১৯৯০ সালে ব্ল্যাক বেল্ট অর্জন করেছিলেন জাপানে। তাঁর গানের অ্যালবামগুলো বিক্রিতে নিয়মিত গড়তো রেকর্ড। এক ‘থ্রিলার’ অ্যালবামই বিশ্বজুড়ে ১০০ মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে দুনিয়া কাঁপানো এই মহাতারকা শৈশবে সংগীত হতে দূরে থাকতে চাইতেন। তাঁর বাবা জো জ্যাকসন তাঁকে জোর করে ভাই-বোনদের সঙ্গে গানের অনুশীলন করাতেন। দরিদ্র বাবা পেট চালানোর জন্য সন্তানদের নামিয়েছিলেন সংগীত জগতে। লড়াই, পরিশ্রমের মধ্যদিয়ে অবশেষে জীবনে ধরা দেয় সাফল্য, পৌঁছে দেয় জনপ্রিয়তার শীর্ষ চূড়ায়। মাইকেলের জাদুকরি কণ্ঠ আর সাবলীল নাচ এখনো কোটি কোটি ভক্তের অন্তরে গেঁথে আছে। দুর্দান্ত নাচের জন্য আলাদা খ্যাতি ছিল তাঁর। কিন্তু একবার এই নাচের অনুশীলন করতে গিয়েই নাক ভেঙে ফেলেছিলেন মাইকেল। সেটা ১৯৭৯ সালে ‘অব দ্য ওয়াল’ অ্যালবাম মুক্তির পরের ঘটনা। দুর্ঘটনাটির পর নাকের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে তাঁকে অস্ত্রোপচার করতে হয়।
তাঁকে নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। কৌতূহল না থাকারও কথা নয়! মাইকেল জ্যাকসন ৩৯ বার গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তাঁর নাম লেখান। ১৩ বার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন। এ ছাড়া ২৬টি আমেরিকান মিউজিক অ্যাওয়ার্ডও তাঁর ঝুলিতে জমা হয়েছিল। পথ চলতে গিয়ে নিজের জীবনে রয়েছে নানা ঘটনা। ১৯৮৪ সালে একটি কোমল পানীয়র বিজ্ঞাপনচিত্র করার সময় চুলে আগুন ধরে যায়। এতে মাথার চামড়া ও মুখমণ্ডল ৩ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। তার পর থেকেই তিনি পরচুলা ব্যবহার করতেন। মাইকেল জ্যাকসন ছিলেন বইপোকা। একবার লাস ভেগাসের একটি বইয়ের দোকান খুব পছন্দ হওয়ায় সেটি কিনে নেন। ব্যতিক্রমী জীবন যাপন ছিল তাঁর। সন্তানদের সাংকেতিক নামে ডাকতেন। এমনকি একসঙ্গে বাইরে বের হলে ছেলেমেয়েদের মুখোশ পরিয়ে রাখতেন। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় নাচ ছিল ‘মুন ওয়াক’। এই নাচের জন্য তিনি বিশেষ ধরনের জুতা ব্যবহার করতেন। এই জুতার নকশাও তিনি নিজেই করেছিলেন।
সংগীত উপস্থাপনায় সৃজনশীলতা, গানের সাথে মানানসই নৃত্য, তাঁকে অনন্য এক উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করে। অবশ্য তাঁকে নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি।
ব্যক্তিত্ব হরণের চেষ্টা মৃত্যুর পরও অব্যাহত রয়েছে। সংগীত জগতে বর্ণবৈষম্যের বিভেদ দূর করতে তিনি ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ তারকা, যিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের হৃদয় জয় করতে পেরেছিলেন। ভিয়েনায় ‘ব্যাড’ অ্যালবাম নিয়ে মাইকেলের কনসার্টে তাঁকে সামনাসামনি দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন শতাধিক নারীভক্ত! তাঁর প্রতিটি কনসার্ট নানা ঘটনার জন্ম দিতো। বিশ্বখ্যাত ‘টাইম’ ম্যাগাজিন তাঁকে খেতাব দেয় ‘সঙ্গীতের বাজারের একক উদ্ধারকর্তা’।
বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় গায়কদের মধ্যে অন্যতম রকস্টার এলভিস প্রিসলির কন্যা লিসা মেরি প্রিসলিকে ১৯৯৪ সালে বিয়ে করেন মাইকেল জ্যাকসন। মাত্র দুবছর পর সেই সংসারে বাজে বিচ্ছেদের সুর। পরবর্তীতে তিনি দেবোরাহ নামে একজনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবন্ধ হন। কৃত্রিম উপায়ে ১৯৯৭ সালে ছেলে প্রিন্স মাইকেল জ্যাকসন এবং ১৯৯৮ সালে মেয়ে প্যারিস মাইকেল জ্যাকসনের জন্ম হয়। এছাড়াও জ্যাকসন জুনিয়র নামে আরও একটি সন্তান রয়েছে মাইকেলের। ১৯৯৯ সালে দেবোরাহের সঙ্গেও মাইকেল জ্যাকসনের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
সংগীতে মেগা ট্যুর বিষয়টি নান্দনিক করে তোলেন মাইকেল জ্যাকসন। তাঁর ১৯৯২ সালের ‘দ্য ডেঞ্জারাস ওয়ার্ল্ড ট্যুর’ চলে টানা পাঁচ মাস। সেসময়ের মধ্যে ৬৯টি কনসার্টে অংশ নেন তিনি। ২০০৯ সালে ‘দিস ইজ ইট’ নামের আরেকটি ‘মেগা ট্যুর’ আয়োজনের পরিকল্পনা করছিলেন মাইকেল জ্যাকসন, যেখানে মোট অনুষ্ঠান হতো ৫০টি। কিন্তু এর আগেই মৃত্যু এসে তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।
জুন মাসের ২৫ তারিখ বিশ্ব জুড়ে সংগীতপ্রেমীদের কাছে যেমন গভীর বেদনার দিন, তেমনি ২৯ আগস্ট অতীব আনন্দের, কেননা এই দিনে জনপ্রিয় পপসংগীত তারকা মাইকেল জ্যাকসন পৃথিবীতে এসেছিলেন, তিনি এসেছিলেন বলে পৃথিবী ‘মুনওয়াক’ দেখেছে। জ্যাকসন বিদ্বেষীরাও তাঁর কনসার্টে ‘লাইভ’ পারফরমেন্সে বিমোহিত হতো। অফুরন্ত জীবনীশক্তি আর প্রাণবন্ততা দিয়ে স্টেজ মাতানোয় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। শুধু যে গানে মাতিয়ে রাখতেন তা নয় বরং ‘মুনওয়াক’ নাচে মুগ্ধতা ছড়াতেন। ১৯৮৩ সালে মোটাউন কনসার্টে ‘বিলি জিন’ গানটি পরিবেশনের একপর্যায়ে ‘মুনওয়াক’ নাচ শুরু করেন জ্যাকসন। পরবর্তীতে তাঁর এই নাচ ‘ট্রেডমার্ক’-এ পরিণত হয়। দারিদ্রকে জয় করে, জীবনভর সংগীত ও কণ্ঠ সাধনার যে অনন্য দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, তা বিশ্বের সংগীত জগতে বিরল। নিজ দেশ ও বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননার চেয়েও মানুষের ভালোবাসা তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। সংগীত প্রিয় মানুষের হৃদয়ে নিজকর্মে বেঁচে থাকবেন কিং অব পপ তথা পপ সংগীতের রাজা মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন।
সঙ্গীত ছাড়াও বিভিন্ন দাতব্য কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মাইকেল জ্যাকসন। পুরো পৃথিবীকে নিয়েই ভাবতেন তিনি, যার প্রতিফলন দেখা যেত গানগুলোতে। চার বছর পরপর প্রকাশ করতেন গানের অ্যালবাম। ‘স্মুথ ক্রিমিনাল’ গানটিতে দেখালেন আরেক চমক। নিজের শরীরকে পুরো সামনে নুয়ে ফেললেন মাধ্যাকর্ষণ বলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। প্রথমে অনেকে ভাবল ক্যামেরার কারসাজি। কিন্তু লাইভ কনসার্টেও এই একই দৃশ্য দেখার পর হতবাক হয়ে গেল দর্শকেরা। এই মুদ্রাটি ‘অ্যান্টি গ্র্যাভিটি লিন’ নামে পরিচিত। ‘ম্যান ইন দ্য মিরর’ গানে শ্রোতাদের চেনালেন সত্যিকারের মাইকেলকে। ভিডিওটিতে ছিল না কোনো নাচ বা কোনো সুন্দরী মডেল। ভিডিওজুড়ে ছিল মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং, মাদার তেরেসা’র মতো মহান ব্যক্তিদের ফুটেজ সেইসাথে যুদ্ধাহত, অনাহারী শিশুদের চিত্র।
পুরো পৃথিবীকে নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও সুন্দর করার আহ্বান জানিয়ে গাইলেন ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড’। এই গানের নামেই মাইকেল গড়ে তুলেছিলেন ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন’ যা ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের কল্যাণে কাজ করত। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, বনভূমি উজাড় করা আর বন্য প্রাণী হত্যার প্রতিবাদে গলা ফাটিয়ে গাইলেন ‘আর্থ সং’। কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর যুগ যুগ ধরে চলে আসা অত্যাচারের প্রতিবাদে গাইলেন ‘দে ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট আস’।
মাইকেল জ্যাকসন তাঁর কর্মজীবনে অভাবনীয় সাফল্য পেলেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নানা বিতর্কে সমালোচিত ছিল। তাই শেষ জীবনে বিভিন্ন ঘটনায় নিজেকে গুটিয়ে নেন। ২০০১ সালে মুক্তি পায় তাঁর সঙ্গীত জীবনের শেষ স্টুডিও অ্যালবাম ইনভিনসিবল। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিকবার শিশু নির্যাতনের অভিযোগ উঠে। দীর্ঘ বিচার-প্রক্রিয়া শেষে ২০০৫ সালে মামলা থেকে বেকসুর খালাস পান। এরপর থেকেই অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান এই শিল্পী। ২০০৯ সালে ঘোষণা দেন ‘দিস ইজ ইট’ নামে জীবনের শেষ অ্যালবাম বের করে ক্যারিয়ারের ইতি টানার। সেটা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি, মৃত্যু তাঁর জীবনেরই ইতি টেনে দেয়।
২০০৯ সালের ২৫ জুন নিভে যায় জীবনপ্রদীপ। সেদিন লস এঞ্জেলেসের বাড়িতে নিথর হয়ে পড়েছিলেন ৫০ বছরের মাইকেল। অ্যানেস্থেটিক প্রোপোফোলের মতো ঔষধ অতিরিক্ত মাত্রায় সেবনের ফলে তাঁর হৃদ্স্পন্দন থেমে গিয়েছিল।
মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুর খবরে ভেঙে পড়ে গুগল, টুইটার কিংবা উইকিপিডিয়ার মতো সাইট। সারা পৃথিবী থেকে বিপুল পরিমাণ ভক্ত মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুসংবাদ একসঙ্গে খোঁজার কারণে সার্ভারের ধারণক্ষমতার উপর চাপ পড়ায় সাইটগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ হয়েছিল। তখন সিএনএন একটি শিরোনাম করেছিল-‘জ্যাকসন মারা গেছেন, সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন প্রায় পুরো ইন্টারনেট’।
মৃত্যুর ৭০ দিন পর লস এঞ্জেলেসের গ্লেনডেল শহরতলির ফরেস্ট লন সমাধিস্থলে পপসংগীতের রাজা বিখ্যাত সব তারকাদের পাশে সমাহিত হলেন। তাঁর কন্ঠের মোহনীয় জাদুতে ভার্চুয়াল জগত এখনো মাতোয়ারা। জনপ্রিয়তায় পড়েনি একটুও ভাটা বরং নতুন প্রজন্মের নিকট প্রতিনিয়ত নতুনভাবে ধরা দিচ্ছেন মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন।
মন্তব্য করুন