White Hole বা সাদা গহবর: মহাবিশ্বের এক রহস্যময় দ্বার
White Hole বা সাদা গহবর হলো মহাবিশ্বের এক চমকপ্রদ তাত্ত্বিক ধারণা, যা ব্ল্যাক হোলের ঠিক বিপরীত। যেখানে ব্ল্যাক হোলের প্রবল মাধ্যাকর্ষণ সবকিছু গ্রাস করে ফেলে এমনকি আলোকেও, সেখানে সাদা গহবর (White Hole ) এমন একটি স্থান, যেখানে কিছু প্রবেশ করতে পারে না, বরং ভেতরের সবকিছু নিঃসরণ করে ফেলে। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো সরাসরি সাদা গহবর বা হোয়াইট হোল আবিষ্কার করা যায়নি। তবে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের (General Relativity) ভিত্তিতে এর অস্তিত্ব তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত। এটি মহাকাশবিদ্যা ও কল্পনাবিজ্ঞানের জগতে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খোলে দেয়।
সাদা গহবের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি
১. জেনারেল রিলেটিভিটি ও সময়ের প্রতিসাম্য: আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ব্ল্যাক হোল এবং হোয়াইট হোলের ধারণার ভিত্তি স্থাপন করে। ব্ল্যাক হোলের সমীকরণে সময়কে উল্টো দিকে প্রবাহিত করা হলে হোয়াইট হোলের ধারণা উঠে আসে। যেখানে ব্ল্যাক হোল আশেপাশের সবকিছু শুষে নেয়, সেখানে হোয়াইট হোল সবকিছু বের করে দেয়।
২. চরম মাধ্যাকর্ষণ: হোয়াইট হোলের মাধ্যাকর্ষণও ব্ল্যাক হোলের মতোই প্রবল, তবে এটি তার চারপাশের পদার্থকে ছিটকে ফেলে দেয়। কোনো কিছুই এর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না, বরং ভেতরের সবকিছু এর থেকে নির্গত হয়।
৩. থার্মোডাইনামিক্স ও এনট্রপি: হোয়াইট হোলের ধারণার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ আসে থার্মোডাইনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র থেকে ‘কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা মাত্রা সময়ের সাথে হ্রাস পায় না এবং প্রক্রিয়াসমূহ যদি এবং কেবল যদি পরিবর্তনীয় হয়, তাহলে এর মান ধ্রুব হবে। বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা ক্রমেই তাপগতিক ভারসাম্যের দিকে অগ্রসর হয় (যখন বিশৃঙ্খলা মাত্রা সর্বোচ্চ থাকে)। ‘হোয়াইট হোল এই প্রাকৃতিক নিয়মের বিপরীত, কারণ এটি সবকিছু বের করে দেয়, যা এনট্রপি বৃদ্ধির বিপরীত কাজ করে।
৪. ওয়ার্মহোল সংযোগ: কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, ব্ল্যাক হোল এবং হোয়াইট হোল একটি ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকতে পারে। এটি এমন একটি মহাজাগতিক সেতু, যেখানে ব্ল্যাক হোল যা শোষণ করে, তা হোয়াইট হোলের মাধ্যমে মহাবিশ্বের অন্য প্রান্তে বেরিয়ে আসতে সক্ষম । এমনকি এটি ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বের সঙ্গেও সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্ব
যদিও এখনো কোনো হোয়াইট হোলের সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায়নি, মহাবিশ্বে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা বিজ্ঞানীদের কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছে। ২০১১ সালে বিজ্ঞানীরা মহাকাশে একটি প্রচণ্ড শক্তিশালী, স্বল্পমেয়াদী বিস্ফোরণ পর্যবেক্ষণ করেন। অনেকেই মনে করেন, এটি একটি গামা-রে বিস্ফোরণ হতে পারে। তবে কিছু বিজ্ঞানী ধারণা করেন, এটি হতে পারে একটি হোয়াইট হোলের সাময়িক উপস্থিতি। যদিও এখনো এই ধারণার কোনো প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
কুরআনের সঙ্গে সংযোগ
হোয়াইট হোলের ধারণা সরাসরি কুরআনে উল্লেখ না থাকলেও মহাবিশ্বের সৃষ্টির বিষয়ে কিছু আয়াত এই তাত্তি¡ক ধারণার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
১. মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ: এ বিষয়ে আল্লাহ তায়া’লা বলেন,‘ তারা কি দেখে না যে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী একসঙ্গে ছিল, তারপর আমি তাদের পৃথক করেছি?’ (সূরা আল আম্বিয়া: ৩০)
এই আয়াতটি ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্বের সাথে মিলে যায়। যেখানে বলা হয় যে, মহাবিশ্ব এক বিন্দু থেকে বিস্ফোরিত হয়ে প্রসারিত হয়েছে। ঠিক তেমনই সাদা গহবর বা হোয়াইট হোল একটি নতুন সৃষ্টি বা মহাজাগতিক পদার্থের উদ্ভবের উৎস হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে।
২. আকাশের গুটিয়ে যাওয়া: আল্লাহ তায়া’লা বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আকাশমণ্ডলী গুটিয়ে ফেলা হবে, যেমনভাবে একটি গ্রন্থপত্র গুটিয়ে রাখা হয়।’ (সূরা আয যুমার: ৬৭)
ব্ল্যাক হোলের মাধ্যমে মহাজাগতিক পদার্থের গুটিয়ে যাওয়ার ধারণাটি এই আয়াতের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যেভাবে ব্ল্যাক হোল আশেপাশের সবকিছু শোষ করে নেয়, তেমনই একদিন পুরো মহাবিশ্বও হয়তো সংকুচিত হয়ে যাবে, যা কুরআনের এই আয়াতের সঙ্গে মিলে যায়।
৩. মহাজাগতিক সময়চক্র: কিছু তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও ধ্বংসের একটি চক্র থাকতে পারে। হোয়াইট হোল সেই পুনর্বার সৃষ্টির অংশ হতে পারে, যেখান থেকে মহাবিশ্বের নতুন পদার্থ বা শক্তির উদ্ভব হতে পারে। বিজ্ঞানীরা এর রহস্য উদঘাটন করতে চান-এটি কি কেবল একটি মহাজাগতিক বিপর্যয় নাকি একটি নতুন জগতের জন্মস্থান?
বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে, হোয়াইট হোল কেবল শক্তি বা পদার্থ নির্গত করছে না, বরং এটি হয়তো মহাবিশ্বের অন্য অংশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। এটি এমন একটি দ্বার হতে পারে, যা তাদের অন্য জগতে নিয়ে যাবে বা মহাজাগতিক সময়ের চক্রের মধ্যে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করবে। কুরআনের আয়াত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মহাবিশ্বের এই রহস্যকে নতুনভাবে তুলে ধরতে পারে। এটি একটি গভীর, চিন্তাশীল এবং বহুমাত্রিক গল্পে রূপান্তরিত হতে পারে, যা পাঠকদের জ্ঞানের পাশাপাশি তাদের আত্মিক অনুপ্রেরণাও যোগাবে।
মন্তব্য করুন