বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র মরে যাচ্ছে। এটা উদ্বেগজনক। এ প্রবণতা কয়েকটি প্রশ্নের জন্ম দেয়। এর প্রকৃত মানে আসলে কী? তাহলে কি কোনো নির্বাচন আর হবে না? বিরোধীদের কি এভাবেই অপরাধী সাব্যস্ত করা হবে?
এগুলো যদি মাপকাঠি হয়ে থাকে তাহলে বলতে হয় ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ায় গণতন্ত্র চালু করেছেন। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় আইনসভা দুমায় ছয়টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব আছে। আর রাশিয়ায় নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা হলো ২০। আপনি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন যে রাশিয়া কোনো গণতান্ত্রিক দেশ নয়। এই রাষ্ট্রটি অতীতের কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে এখন সর্বময় স্বৈরাচারী একটা ব্যবস্থায় ঢুকে পড়েছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য জোসেফ স্তালিনের সময়ের চেয়ে এখন বেশি মানুষকে নির্যাতন করা হচ্ছে।
গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস প্রশ্নাতীতভাবে কমে যাচ্ছে। নতুন একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ব্রিটেনে ৪৫ বছরের কম বয়সীদের প্রতি পাঁচজনের একজন বিশ্বাস করেন যে দেশকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে হলে এমন একজন শক্তিশালী নেতা দরকার, যাকে নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। বিশ্বজুড়ে একই চিত্র দেখা যায়। ২০২০ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৬০টি দেশে একই ধরনের জরিপ করা হয়েছিল। সেই জরিপের ফলাফল হলো তরুণতর প্রজন্মের মধ্যে ‘ধারাবাহিকভাবে গণতন্ত্রের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটছে’।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপ বলছে, ১২টি উচ্চ আয়ের দেশের তিন ভাগের দুই ভাগ নাগরিক ২০২৪ সালে গণতন্ত্রের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। অথচ ২০১৭ সালে এই সংখ্যাটি ছিল অর্ধেক। কেন এমনটা ঘটছে? কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষাটির উপসংহারে বলা হয়েছে, অর্থনীতি থেকে বিযুক্তির প্রশ্নটিই তরুণদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির প্রধান কারণ। রাশিয়ার ঘটনাটি এ ক্ষেত্রে শিক্ষণীয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরপরই (১৯৯০) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেৎসিন ঘোষণা করেন, ‘আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে মানুষের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যাবে না এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনমান উন্নত হবে।
কিন্তু চার বছরের মধ্যে রাশিয়ানদের প্রকৃত আয় অর্ধেকে নেমে আসে। শক থেরাপি নীতির আশীর্বাদে রাশিয়ার ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যান। ২০২১ সালে মাত্র ১৬ শতাংশ রাশিয়ান ‘পশ্চিমা গণতন্ত্রের মডেলকে’ সমর্থন দেন। গণতন্ত্রের ব্যানারে রাশিয়ার একটা অশান্ত মুক্তবাজার পুঁজিবাদ চালু হয়, যেটা জনগণের মধ্যে মোহভঙ্গের অনুভূতি তৈরি করে। এ পরিস্থিতিকেই কাজে লাগান পুতিন। ১৯৯০–এর দশকে রাশিয়া যে ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিল, যুক্তরাজ্যে সেটা হয়নি। তা সত্ত্বেও নব্য উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি ও কঠোর সংযমী নীতির সংমিশ্রণ তরুণদের মধ্যে তিক্ততার জন্ম হয়। থ্যাচারিজম (মার্গারেট থ্যাচারের অর্থনৈতিক নীতি) স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু তার পরিবর্তে নিরাপত্তাহীনতা উপহার দিয়েছিল।
যুক্তরাজ্যে নিরাপদ চাকরিগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে, ভাড়া বেড়েছে, মজুরি কমে গেছে, যুব কর্মসংস্থান কমে গেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে তরুণদের ঘাড়ে শাস্তিমূলক ঋণের বোঝা চেপেছে। যুক্তরাজ্যের অল্প বয়সী তরুণেরা ভুক্তভোগী হয়েছেন, তাঁদের অনেকে কখনো ভোট দেননি। ফান্সের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তিন ভাগের এক ভাগ তরুণ গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছেন। কিন্তু ভিন্ন ব্যাপারও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরা যাক। ১৯৬০–৭০–এর দশক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এমন এক অস্থিতিশীল সময় যেখানে ট্রাম্পের মতো লোকদের উত্থানের উর্বর ভূমি। অর্থনীতি ছিল সংকটে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং নিশ্চল প্রবৃদ্ধির একটা বিষাক্ত বাস্তবতা তৈরি হয়েছিল।
নাগরিক অধিকার আন্দালনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী বর্ণবাদী আক্রমণের প্রতিঘাতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে দাঙ্গাও হয়েছিল। সহিংস অপরাধ আজকের তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। আত্মহত্যার ঘটনাও এখনকার তুলনায় দ্বিগুণ ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৬০ হাজার মার্কিন সেনা নিহত হওয়া এবং এই সংঘাতের অপমানজনক অবসানের পর অনেকের ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ক্ষয় হচ্ছে এমন অনুভূতি তৈরি হয়েছিল। মূলধারার রাজনীতিবিদদের মধ্যে সে সময়ে আজকের ট্রাম্পের সমতুল্য রাজনীতিবিদ ছিলেন জর্জ ওয়ালেস। কিন্তু ট্রাম্পের তুলনায় তিনিও কম অভদ্র ছিলেন। ১৯৬৮ সালের প্রসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি মাত্র ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পান। পুঁজিবাদের অধীন গণতন্ত্রে সব সময় করপোরেট ও ধনিক গোষ্ঠীর স্বার্থে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষমতা অনেকখানি ছেটে ফেলা হয়। পুঁজিবাদ যখন সংকটে পড়ে তখন এর ত্রুটিগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম হয়। যেমনটা আমরা দেখেছিলাম ২০০৮ সালে। প্রশ্ন হলো এটাকে কারা কাজে লাগাচ্ছে।
এখানে একটা বড় বিপদ হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ধ্বংসাত্মকভাবে ব্যবহারের কলাকৌশল এমন সফলভাবে উগ্র ডানপন্থীরা রপ্ত করে নিয়েছে যে তাদের অনুসারীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। অন্যদিকে বামপন্থীরা আলোকবর্ষ পিছিয়ে পড়েছে।
সুত্রঃ ওয়েন জোনস গার্ডিয়ান
মন্তব্য করুন