আল্লাহ তায়া’লা মানবজাতি সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদাত করার জন্য। ইবাদাতের মাঝে সালাত হচ্ছে অন্যতম। যা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে দ্বিতীয়। সালাতের মাধ্যমে যেমন আল্লাহকে খুশি করা যায়, ঠিক তেমনই নিজেও মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায়। পবিত্র কুরআন ও হাদিস গ্রন্থে বহু জায়গায় সালাত কায়েম করার তাগিদ ও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়া’লা বলেন:
وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوۃَ
অর্থ: ‘এবং তোমরা নামাজ কায়েম করো ও জাকাত আদায় করো।’ (সূরা আন নূর: ৫৬))
তাই সালাত সঠিকভাবে আদায় করে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করা সকল মুসলমানদের ঈমানি দাবি। তাহলে কীভাবে আমরা সালাত আদায় করলে আল্লাহর পুরস্কার পাওয়া যাবে, কীভাবে আমাদের রাসূলুল্লাহ (সা.) তা আদায় করতেন, একমাত্র সেটাই আমাদের অনুকরণ করতে হবে। তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা সেভাবে সালাত আদায় করো যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছো।’ (বুখারি: ৬৩১) তাহলে সালাত আদায় কেমন ছিল তা নিয়েই আমাদের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
সালাত কী?
নামাজকে কুরআনের ভাষায় সালাত বলে। সালাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো দরুদ বা শুভকামনা, তাসবিহ বা পবিত্রতা বর্ণনা, রহমত তথা দয়া বা করুণা, ইস্তিগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা। কর্তা ও স্থান-কাল কিংবা পাত্রভেদে সালাতের বিভিন্ন অর্থ হয়। সালাতের কর্তা যদি আল্লাহ হন, তাহলে সালাতের অর্থ হয় দয়া-মায়া। সালাতের কর্তা যদি ফেরেশতা হন, তাহলে এর অর্থ হয় রহমত বা দয়া কামনা অথবা কারও জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা। আর সালাতের কর্তা যদি ইনসান বা মানুষ হয়, তাহলে এর অর্থ হয় ক্ষমা ভিক্ষা, রহমত প্রার্থনা ও শুভকামনা। এই সালাত শব্দটি সালয়ুন ধাতু থেকে নির্গত। যার অর্থ হলো আগুনে পুড়ে কোনো বস্তৃুকে নির্ধারিত আকার দেওয়া। বিশেষ করে বেত, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তীর ও ধনুকের ছিলা তৈরি করা। সালাতের এসব আভিধানিক অর্থের সঙ্গে এর অন্তর্নিহিত আবেদনের মিল রয়েছে।
সালাত শব্দের পারিভাষিক অর্থ হলো নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট ইবাদত সম্পাদন করা। এর মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত হলো ফরজ, যথা: ফজর বা ভোরের সালাত; জোহর বা দ্বিপ্রহরের সালাত; আসর বা বিকেলের সালাত; মাগরিব বা সান্ধ্যকালীন সালাত; এশা বা রাত্রকালীন সালাত।
সালাতের আহকাম ও আরকান
সালাত আদায় যথাযথ হওয়ার জন্য কতগুলো শর্ত রয়েছে। যার কোনো একটি ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, বাদ পড়লে সালাত বাতিল হয়ে যাবে। সালাতে মোট ফরজ তেরোটি। সালাতের পূর্বে প্রস্তুতিমূলক সাতটি ফরজ রয়েছে। এগুলোকে সালাতের আহকাম বলা হয়। আর সালাতের ভেতরে ছয়টি ফরজ রয়েছে। এগুলোকে সালাতের আরকান বলা হয়। সালাতের আহকাম ও আরকান নিম্নরূপ:
সালাতের আহকাম
১. শরীর পবিত্র হওয়া।
২. পরিধানের কাপড় পবিত্র হওয়া।
৩. সালাতের স্থান অর্থাৎ যে জায়গায দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা হবে তা পবিত্র হওয়া। কমপক্ষে দাঁড়ানোর জায়গা থেকে সিজদাহর জায়গা পর্যন্ত পবিত্র হতে হবে।
৪. সতর ঢাকা। পুরুষের নাভি থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত এবং নারীদের মুখমÐল, হাতের কবজি ও পায়ের পাতা ছাড়া সমস্ত শরীর ঢাকা।
৫. কিবলামুখী হওয়া, অর্থাৎ কিবলার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করা। কিবলা অজানা হলে নিজের প্রবল ধারণা অনুসারে কিবলা নির্ধারণ করে সালাত আদায় করতে হবে।
৬. সালাতের সময় হওয়া।
৭. নিয়ত করা, অর্থাৎ যে ওয়াক্তের সালাত পড়তে হবে, মনে মনে সেই ওয়াক্তের নিয়ত করা। নিয়ত নিজ নিজ ভাষায়ও করা যায়।
সালাতের আরকান
১. তাকবিরে তাহরিমা তথা ‘আল্লাহ আকবার’ বলে সালাত শুরু করা।
২. দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা। দাঁড়াতে অক্ষম হলে বসে এবং বসতে অক্ষম হলে শোয়া অবস্থায় ইশারায় সালাত আদায় করতে হবে।
৩. কিরাত পড়া, অর্থাৎ সূরা তেলাওয়াত করা (ছোট তিন আয়াত বা বড় এক আয়াত)।
৪. রুকু করা
৫. সিজদাহ করা।
৬. শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পরিমাণ বসা (যে বৈঠকের মধ্যে তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে সালাত শেষ করা হয় সেটাই শেষ বৈঠক)।
সালাতের ওয়াজিবসমূহ
সালাতের ওয়াজিব বলতে ওই সব করণীয় বিষয় বোঝায়, যার কোনো একটি ভুলক্রমে ছুটে গেলে সিজদায়ে সাহু আদায় করে সালাত শুদ্ধ করতে হয়। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ছেড়ে দিলে সালাত ভঙ্গ হয়ে যায় এবং পুনরায় সালাত আদায় করতে হয়।
সালাতে ষোলটি ওয়াজিব রয়েছে (বাধ্যতামূলক কাজ)। এগুলো হচ্ছে:
১. প্রত্যেক রাকআতে আলহামদু বা সূরা ফাতেহা পড়া।
২. সূরা ফাতেহাসহ অন্য সূরা পড়া বা সূরার অংশ-বিশেষ পাঠ করা ।
৩. ফরজ নামাজের প্রথম দুই রাকাতে সূরা ফাতেহার সাথে অন্য কিরাত পড়া।
৪. প্রতিটি রাকাতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
৫. রুকু সিজদাহ ও তেলাওয়াতের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ও সালাতের রুকনগুলো সঠিকভাবে আদায় করা। অর্থাৎ রুকু, সিজদাহ, দাড়ানো, বসায় কমপক্ষে এক তাসবিহ পরিমাণ স্থির থাকা।
৬. রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানো।
৭. দুটি সেজদার মাঝখানে সোজা হয়ে বসা।
৮. সিজদাহর মধ্যে উভয় হাত ও হাঁটু মাটিতে রাখা।
৯. প্রথম বৈঠক অর্থাৎ তিন বা চার রাকআত বিশিষ্ট সালাতে দুই রাকআত আদায়ের পর তাশাহহুদ পড়ার জন্য বসা।
১০. প্রথম ও শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পাঠ করা।
১১. ইমামের জন্য উচ্চস্বরে কিরাত পড়ার সালাতে উচ্চস্বরে এবং চুপি চুপি পড়ার সালাতে চুপি চুপি কিরাত পড়া
১২. বিতর সালাতে দোয়া কুনুত পাঠ করা।
১৩. জামাআতে নামাজের সময় ইমামের অনুসরণ করা
১৪. দুই ঈদের নামাজে অতিরিক্ত ছয় তাকবীর বলা হয়।
১৫. সালাতের মধ্যে সিজদাহর আয়াত তেলাওয়াত করলে তেলাওয়াতে সিজদাহ করা।
১৬. ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলে সালাত সমাপ্ত করা।
সাহু সেজদাহর নিয়ম: শেষ বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতু পড়ার পর ডান কাঁধে সালাম দিয়ে এবং আবার দুই সেজদা করে আত্তাহিয়্যাতুর সাথে দুরূদ ও মাসুরা পাঠ করে সালাম ফিরানো।
সালাতের মাকরুহ সময়
১. আসরের পর সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
৩. ফজরের সময় শুরু হলে ফজরের সুন্নত ছাড়া অন্য কোনো সালাত আদায় করা।
৪. ফরজ সালাতের যখন তাকবীর দেওয়া হয় তখন অন্য কোনো সালাত শুরু করা।
৫. যখন ইমাম সাহেব জুমুআর খুতবা দিতে থাকেন তখন কোনো সালাত শুরু করা।
৬. বিনা কারণে এশার সালাত মধ্যরাতের পরে আদায় করা।
সালাতের নিষিদ্ধ সময়:
তিন সময়ে সালাত আদায় করা হারাম বা নিষিদ্ধ। যথা:
১. ঠিক সূর্যোদয়ের ২৩ মিনিট পর্যন্ত সময়।
২. ঠিক দ্বিপ্রহরের সময়।
৩. সূর্যাস্তের ২৩ মিনিট পর্যন্ত। তবে যদি কোনো কারণে ওই দিনের আসরের সালাত আদায় করতে না পারলে তা ওই সময় আদায় করা যাবে তবে মাকরুহ বা অপছন্দনীয়ভাবে আদায় হয়ে যাবে।
ওজুর ফরজ
সালাত শুদ্ধ হওয়ার জন্য ওজু সঠিক হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তাই ওজুর চারটি ফরজ জানা আবশ্যকীয়। ওজুর ফরজগুলো:
১। সমস্ত মুখ ভালোভাবে ধৌত করা।
২। দুই হাতের কনুইসহ ভালোভাবে ধৌত করা।
৩। মাথা চার ভাগের এক ভাগ মাসেহ করা।
৪। দুই পায়ের টাকনুসহ ধৌত করা।
মন্তব্য করুন