কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বর্তমান বিশ্বের অন্যতম একটি প্রযুক্তি, যা একসময় রূপকথার গল্পের মতো শুনাতো। অর্থাৎ, অসম্ভবকেই যেন সম্ভব করাই হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাজ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য আগামীর পৃথিবী বিস্বয়কর এবং রোমাঞ্চকর হতে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যাত্রা শুরু হয় ১৯৫০ সালের দিকে কম্পিউটার বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং এর বিখ্যাত ‘টুরিং টেস্ট’ গেইমের মাধ্যমে। টুরিং-এর প্রশ্ন ছিল ‘যন্ত্র কি চিন্তা করতে পারে?’ এই প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণাটি গড়ে ওঠে। তারপর ১৯৫৬ সালে জন ম্যাককার্থি Artificial Intelligence শব্দটি ব্যবহার করেন যা সংক্ষেপে AI। সেই সময় বিজ্ঞানীরা কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে মানসিক চিন্তা শক্তিকে কপি করার চেষ্টা করেন। AI প্রধানত দুই ধরনের একটি হচ্ছে ন্যারো এআই এবং অন্যটি হচ্ছে জেনারেল এআই। ন্যারো AI হচ্ছে যন্ত্র বা সফটওয়্যার একটি নির্দিষ্ট কাজের উপর দক্ষ হয়। যেমন প্রথম দিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ছিল গাণিতিক। শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান করতে পারতো এবং বর্তমান বিশ্বে এই ন্যারো AI এরই বেশি ব্যবহার করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে : অনুবাদ, ছবি এডিট, ভিডিও তৈরি, বিশেষ বিশেষ টুলস তৈরি ইত্যাদি যা নির্দিষ্ট কিছু কাজে দক্ষ হয়। অপরদিকে জেনারেল এআই হচ্ছে যন্ত্রও মানুষের মতো সবধরনের চিন্তা ও কাজ করতে পারবে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
আধুনিকতার ধারাবাহিকতায় AI যুগের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত হতে হতে আজকের আধুনিক যুগে চলে এসেছে। ১৯৯০-এর দশক থেকে AI এর আধুনিক যুগ শুরু হয় বলে ধরা হয়। যখন মেশিন লার্নিং এবং ডিপ লার্নিং এর মতো প্রযুক্তি AI এর উন্নতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। মেশিন লার্নিং এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে কম্পিউটার নিজে থেকে ডাটা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। ডিপ লানিং এ ব্যবহৃত নিউরাল নেটওয়ার্কগুলো মানুষের মস্তিষ্কের নিউরণের কর্যক্রম অনুকরণ করে যার কারণে জটিল এবং বিশাল ডাটাসেট থেকে সিদ্ধান্ত নিতে AI সক্ষম হয়। বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত AI এর উদাহরণ হলো ২০১১ সালে আইবিএম এর ‘ওয়াটসন’, যা জনপ্রিয় কুইজ শো Jeopardy-তে চ্যাম্পিয়ানদের হারিয়ে নিজের সক্ষমতা জানান দেয় এবং প্রমাণ করে দেয় AI শুধু সমস্যার সমাধান নয়। বরং অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন সমস্যার সমাধানও করতে পারে। যা অত্যন্ত কম সময় এবং নির্ভুলভাবে হয়ে থাকে। তারপর থেকে AI নানাভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে। AI-কে কাজে লাগিয়ে অনেক জটিল জটিল কাজও এখন খুব সহজেই করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্য বিজ্ঞান। AI অত্যন্ত নির্ভুলভাবে ডায়োগনোসিস করতে পারে। এমনকি মানুষের চেয়েও অত্যন্ত নির্ভুলভাবে রোগও শনাক্ত করতে পারে। AI এর মাধ্যমে ক্যান্সার বা হৃদরোগের মতো জটিল রোগ আগে থেকেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়। AI ভিত্তিক রোবোটিক্স প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নির্ভুল এবং সফল অপারেশন করা সম্ভব।
বর্তমান AI এর বিকাশ এমনভাবে হয়েছে যেখানে ‘জেনারেটিভ এআই’ এবং ‘ডিপ লার্নিং’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম্পিউটার নিজেই নতুন সৃষ্টিকর্ম করতে পারে। GPT মডেল এবং DALL-E মডেল উল্লেখযোগ্য। এই মডেলগুলো শুধু তথ্য বিশ্লেষণই নয় বরং তথ্যের ভিত্তিতে সৃজনশীলভাবে নতুন ছবি, অডিও, ভিডিও, বিভিন্ন ধরনের ইফেক্ট ইত্যাদি তৈরি করতে পারে। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এডোবির ‘ফায়ারফ্লাই এআই’ যা প্রম্পট লেখার সাথে সাথে একদম নেচারাল একটি ‘জেনারেটিভ ফিল’ করে দেয় যা দেখে বুঝার কোনো উপায়ই যেন যে, এটা কোনো ধরনের এডিট করা হয়েছে। AI এর মাধ্যমে ভার্চুয়্যাল রিয়ালিটি (VR) এমনকি ৫D পর্যন্ত দেখা সম্ভব যা বাস্তবে না থেকেও বাস্তবতার অনুভব দেবে। এআই জীবনকে অনেক সহজ এবং গতিময় করে তুলেছে। এআই এর অগণিত সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও রয়েছে। যা আমাদের জীবনে একদিকে সহজ করতে গিয়ে অন্যদিকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। গত কয়েক বছর আগেও যেই ফ্যাক্টরিতে একটি কাজ করতে ১০ জন লোকের প্রয়োজন হতো, আজ সেই জায়গায় এআই ইনস্টল করা রোবট দখল করে নিয়েছে। এটি মানুষের চাইতেও অত্যন্ত দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে কাজ করে দেয়। এর ফলে চাকুরি হারাচ্ছে প্রচুর মানুষ। তাই চাকুরি হারানোর ভয় না করে আমাদেরও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যেতে হবে। তা না হলে এআই এর বিস্তৃতির ফলে একসময় আমাদের মনুষ্য জীবন অত্যন্ত ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। এআই আমাদের জন্য কখনোই ঝুঁকি হবেনা যদি আমরা এআই-এর যথাযথ ব্যবহার করতে পারি। এআইকে কাজে লাগিয়ে আমরা নতুন নতুন কাজ কিংবা শিল্পের সৃষ্টি করবো। যা আমাদের ভবিষ্যত জীবনকে নিরাপদ করবে।
লেখক: কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এবং গ্রাফিক ডিজাইনার।
মন্তব্য করুন