বিবিসি নিউজ বাংলা, ঢাকা
২৪ জুলাই ২০২৪, ১০:২৭ অপরাহ্ন
অনলাইন সংস্করণ

কোটা আন্দোলন: চিকিৎসা নিতে গিয়ে আহতদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে

সংঘাতে আহতদের চাপ সামলাতে হাসপাতালগুলোও হিমশিম খেয়েছে। গেটি ইমেজ

ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকার দিনমজুর মোহাম্মদ রিংকু। গত শনিবার দুপুরে বাসার নিচে নেমেছিলেন প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে। দোকানে যাওয়ার পথে তার পেটে গুলি লাগে।

 

“মেইন রোডে ঝামেলা বইলা আমার ভাই গলি দিয়া যাইতেছিল। এর মধ্যেই হুট কইরা একটা গুলি আইসা ওর পেটে হান্দে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন আহত মোহাম্মদ রিংকুর ছোট ভাই মোহাম্মদ পিংকু।

 

গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মোহাম্মদ রিংকুকে উদ্ধার করে পাশের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যায় স্থানীয় মানুষজন। একইসঙ্গে, স্বজনদের কাছেও খবর পৌঁছান তারা।

 

“খবর পাইয়া আমরা দৌড়ে হাসপাতালে গেলাম। হেরা ব্যান্ডেজ করাই দিয়া কইলো ভাইরে ওইহানে রাখন যাইবো না। তাড়াতাড়ি মুগদা মেডিকেলে নিতে হইবো,” বিবিসি বাংলাকে বলেন তার ছোটভাই মোহাম্মদ পিংকু।

 

কিন্তু বাইরের পরিস্থিতি তখন রীতিমত রণক্ষেত্র।

 

“বাইরে তহন হেবি গেঞ্জাম। ছাত্র পোলাপান পুলিশগো ইটা মারতাছে, পুলিশও গুলি করতাছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. পিংকু।

 

এর মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইরে বের হন তিনি। কিন্তু মুশকিল হয়, গাড়ি খুঁজে পাওয়া।

 

“এমনেই গেঞ্জাম-গোলাগুলি, তার মধ্যে কারফিউ। কেউই গাড়ি বের করতে চায় না। এম্বুলেন্সও খালি নাই। এদিকে, ভাইয়ের পেট দিয়া হমানে রক্ত পড়তেছে,” যোগ করেন তিনি।

 

অনেক চেষ্টার পর শেষমেশ তারা একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা খুঁজে পান। কিন্তু চালককে রাজি করাতে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিতে হয়েছে তাদের।

 

“মহল্লা বিছড়াইয়া একটা ইজিবাইক পাইলাম। হাতে পায়ে ধইরা পাঁচগুণ বেশি ভাড়া দিয়া কোনোমতে হেরে রাজি করাইলাম,” জানান মি. পিংকু।

 

ভর্তি নেয়নি হাসপাতাল

 

গুলিবিদ্ধ হওয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা পর মোহাম্মদ রিংকুকে নিয়ে ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান পরিবারের সদস্যরা। যদিও সেখানে তাকে ভর্তি করানো যায়নি।

 

“হাসপাতালে তহন ভিড়। সব আহত মানুষ। এর মধ্যে ডাক্তার ভর্তি নিলো না। গুলি লাগছে শুইনাই কইলো ঢাকা মেডিকেলে নিয়া যান,” পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বলছিলেন মোহাম্মদ পিংকু।

 

ফলে দেরি না করে একই অটোরিক্সা চড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের উদ্দেশে রওনা হন তারা। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোও সহজ ব্যাপার ছিল না।

 

“সব রোডে গেঞ্জাম-গোলাগুলি। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেলে কেমনে পৌঁছামু, হেইডা নিয়াই আমরা টেনশনে ছিলাম,” বলছিলেন মি. পিংকু।

 

“পরে মেইন রোড বাদ দিয়ে মহল্লার অলি-গলি ধইরা অনেক কাহিনী কইরা বিকেলের দিকে আমরা ঢাকা মেডিকেলে ঢুকলাম,” বলেন তিনি।

 

ভর্তির পর আরেক যুদ্ধ

 

গুলিতে আহত দিনমজুর মোহাম্মদ রিংকুকে নিয়ে এমন একটি সময়ে স্বজনরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান, যখন কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় আহতদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন চিকিৎসকরা।

 

“প্রতিমুহূর্তেই নতুন নতুন রোগী আসছিল, যাদের সামাল দিতে আমাদের রীতিমত হিমশিম অবস্থা হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন।

 

এমন পরিস্থিতিতে আহত ভাইকে নিয়ে বিপাকে পড়েন মি. পিংকু।

 

“ডাক্তাররা রোগী দেইখা কুলাইতে পারে না, এমন অবস্থা। এই ভিড়ের মধ্যে ক্যামনে ভর্তি করামু, সেইডাই ভাবতেছিলাম,” বলছিলেন তিনি।

 

অনেক চেষ্টার পর সন্ধ্যার দিকে গুলিবিদ্ধ মোহাম্মদ রিংকুকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে সক্ষম হন স্বজনরা।

 

ঘাম ছুটেছে রক্ত জোগাড়ে

 

বহু চেষ্টায় হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারলেও সেখানেই সমস্যার শেষ হয়নি। আহত মি. রিংকুর জন্য রক্ত জোগাড় করতেও বেগ পেতে হয়েছে পরিবারের সদস্যদের।

 

“ভর্তির পরপরই ডাক্তার কইলো ভাইরে তাড়াতাড়ি রক্ত দেওন লাগবো তিন ব্যাগ। কিন্তু এই কারফিউয়ের মধ্যে একলগে এত রক্ত কই পামু?” বলছিলেন মি. পিংকু।

 

রক্তের সন্ধানে প্রথমে হাসপাতালের ব্লাডব্যাংক এবং স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতাদের একাধিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে মি. রিংকুর পরিবার। কিন্তু সেখানে প্রয়োজনীয় গ্রুপের রক্ত না পেয়ে শেষমেশ আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন তারা।

 

“অনেক বিছড়ানোর পর আত্মীয়-স্বজনগো মধ্যে দুইজন পাইলাম,” বলছিলেন মি. পিংকু।

 

কিন্তু কারফিউয়ের মধ্যে তাদেরকে কীভাবে হাসপাতালে আনা হবে, সেটি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়।

 

“দিনের বেলাতেই যেইহানে কোনও গাড়ি পাওন যায় না, সেইহানে রাইতের বেলায় ক্যামনে আনমু হেগো?” বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।

 

পরে অবশ্য আগের মতোই বেশি ভাড়া দিয়ে রক্তদাতাদেরকে হাসপাতালে আনা হয়। সেই রক্ত দিয়েই পার হয় শনিবার রাত। কিন্তু রক্তের তৃতীয় ব্যাগ তখনও জোগাড় হয়নি।

 

“ডাক্তার কইছে, সকালের মধ্যে রক্ত রেডি রাখতে। যেকুনু সময় দেওন লাগবে। টেনশনে আমাগো মাথা খারাপ অবস্থা,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. পিংকু।

 

শেষমেশ রক্ত জোগাড় হলো কীভাবে?

 

“আল্লায় মিলায় দিছে, ভাই। আল্লায় হাতে কইরা আমার ভাইরে বাঁচাইছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. পিংকু।

 

মি. পিংকুর ভাইকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় আরেক ব্যাগ রক্ত দিয়েছিলেন হাসপাতালে ভর্তি আরেক রোগীর একজন স্বজন।

 

“ঘটনা শুইনা হেয় লোক কইলো উনার রক্তের লগে ভাইয়ের রক্তের মিল। আমরা কইলাম, আলহামদুলিল্লাহ্,” বলছিলেন মি. পিংকু।

 

আন্দোলনকারীদের অভিজ্ঞতা

 

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সরকার সমর্থকদের সঙ্গে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হতে দেখা গেছে।

 

এসব সংঘর্ষে আহত হয়ে যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা।

 

এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের তুলনায় তাদের অভিজ্ঞতা কিছুটা ভিন্ন বলেই জানা যাচ্ছে।

 

“চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় আমরা বেশি চ্যালেঞ্জ ফেস করেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইলমা জাহান (নিরাপত্তার স্বার্থে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে)।

 

কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়ে মিজ জাহান নিজে যেমন আহত হয়েছেন, তেমনি বন্ধু-বান্ধবদেরকেও আহত হতে দেখেছেন।

 

“আহত হওয়ার পর আমাদের প্রথম যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে, সেটি হচ্ছে- পুলিশ ও ছাত্রলীগকে মোকাবেলা করে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানো,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মিজ জাহান।

 

আহত হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথে তিনি নিজেই একাধিকবার বাঁধার মুখে পড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।

 

“এমনকি হাসপাতালে যাওয়ার পরও তারা আমাদের উপর হামলা চালিয়েছে, যার ছবি সবাই ইতোমধ্যেই দেখেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মিজ জাহান।

 

উল্লেখ্য যে, গত ১৫ই জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কর্মসূচি পালনকালে ছাত্রলীগসহ সরকার সমর্থকদের হামলায় আন্দোলনকারীদের অনেকেই আহত হন।

 

পরে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে লাঠি-সোটা হাতে একদল লোক পুনরায় তাদের উপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও ঘটনার পর ছাত্রলীগ ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

 

কিন্তু হামলার ওইসব ঘটনায় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয় বলে জানাচ্ছেন মিজ জাহান।

 

“ফলে একেবারে বাধ্য না হলে আমাদের কেউই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মিজ জাহান।

 

একই ধরনের কথা জানিয়েছেন আরেক আন্দোলনকারী মিজানুর রহমান (ছদ্মনাম)।

 

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতায় গত বুধবার ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় আহত হন তিনি।

 

“আমি মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছিলাম। কিন্তু তারপরও হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে এসেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. রহমান।

 

কিন্তু এর কারণ কী?

 

“কারণ মনে হচ্ছিলো, পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া আমার পরিবারও আমাকে হাসপাতালে রাখতে সাহস পায়নি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. রহমান।

 

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিজ্ঞতা

 

কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে ঢাকার যে কয়েকটি স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকার সমর্থকদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে, সেগুলোরই একটি হচ্ছে রামপুরা-বনশ্রী এলাকা।

 

দফায় দফায় সংঘর্ষে ওই এলাকায় যারা আহত হয়েছেন, তাদের একটি বড় অংশই চিকিৎসা নিয়েছেন বনশ্রীর ফরাজী হাসপাতালে।

 

“গত বুধবার থেকে পরবর্তী চার দিনে আমরা এক হাজারেরও বেশি আহতের চিকিৎসা দিয়েছি, যাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ মানুষও ছিল,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ফরাজী হাসপাতালের উপ-মহাব্যবস্থাপক রুবেল হোসাইন।

 

সক্ষমতা ও লোকবল বিবেচনায় বেসরকারি ফরাজী হাসপাতাল খুব একটা বড় কিংবা শক্তিশালী নয়।

 

“এমনকি প্রতিষ্ঠার পর একসঙ্গে এতবেশি ক্যাজুয়ালিটি আমরা আগে কখনোই পাইনি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. হোসাইন।

 

কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন সময়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটলেও ঢাকার রামপুরা-বনশ্রী এলাকায় সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করে গত ১৮ই জুলাই।

 

“সেদিন দুপুরের পর থেকে একের পর এক আহত মানুষ হাসপাতালে আসতে থাকে। অথচ তখন জরুরি বিভাগে আমাদের চিকিৎসক ছিল মাত্র একজন,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ফরাজী হাসপাতালের উপ-মহাব্যবস্থাপক মি. হোসাইন।

 

তাহলে পরিস্থিতি সামাল দিলেন কীভাবে?

 

“পরিস্থিতি বিবেচনায় হাসপাতালের অন্য ডাক্তার ও নার্সদেরকে আমরা ডেকে পাঠাই এবং ত্রিশ জনের একটি টিম গঠন করি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. হোসাইন।

 

কিন্তু তারপরও চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।

 

“বৃহস্পতি থেকে শনিবার পর্যন্ত এত বেশি ক্যাজুয়ালিটি আসছিল যে, ত্রিশজনের টিম দিয়েও আমাদের চাপ সামলে হিমশিম খেতে হচ্ছিলো,” বলেন মি. হোসাইন।

 

ফরাজী হাসপাতালের আশেপাশে আরও অন্তত দুটি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। লোকবল সংকটে তারাও জরুরি সেবা দিতে হিমশিম খেয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে।

 

তবে এসব হাসপাতালের কোনোটিই আহতদের কাউকে ভর্তি রাখেনি।

 

“সক্ষমতা না থাকায় আমরা কেবল প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েই ছেড়ে দিয়েছি। এর মধ্যে যাদের অবস্থা গুরুতর তাদেরকে নিজেদের অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেলসহ অন্য হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে,” বলছিলেন মি. হোসাইন।

 

শুধু ঢাকার এসব হাসপাতাল নয়, বরং সারা দেশ থেকেই সহিংসতায় গুরুতর আহতদেরকে পাঠানো হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের কয়েক হাজার ডাক্তার-নার্স গত কয়েকদিনে পালাক্রমে সার্বক্ষণিকভাবে এসব আহতদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে।”

 

বাংলাদেশে যখন কোনো দুর্যোগ, দুর্ঘটনা এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটে, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার চাপ এসে পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

 

“ফলে এক ধরনের প্রস্তুতি আমাদের সবসময়ই থাকে। এবারে রোগীর সেই চাপ সামলাতে আমাদের খুব একটা বেশ পেতে হয়নি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. আসাদুজ্জামান।

 

“তবে যেটা সামাল দিতে বেগ পেতে হয়েছে, সেটি হচ্ছে- রোগীর সঙ্গে আসা মানুষের চাপ,” বলছিলেন তিনি।

 

সহিংসতায় আহতদের অনেকে সঙ্গেই আট-দশ, কিছুক্ষেত্রে তারও বেশি সংখ্যক স্বজন ও বন্ধুবান্ধব হাসপাতালে ঢুকতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

 

“তারা সবাই চায় তার রোগীর চিকিৎসা আগে করা হোক। ফলে অল্পকিছু নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া খুব একটা সহজ ছিল না,” বলেন মি. আসাদুজ্জামান।

 

গত ১৫ই জুলাই হাসপাতাল প্রাঙ্গণে লাঠি-সোটা হাতে বহিরাগতদের প্রবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অনাকাঙক্ষিত ওই ঘটনার ব্যাপারে আমরাও মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি এবং হাসপাতালের নিরাপত্তা জোরদার করতে অনুরোধ করেছি।”

 

“আমাদের কাজ চিকিৎসা দেওয়া। হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্ব তো আমরা নিতে পারবো না। সেজন্যই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে এ বিষয়ে সাহায্য চেয়েছি,” যোগ করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

 

এদিকে, কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার কারণে হঠাৎ রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালটির নিয়মিত সেবা কার্যক্রম বেশ ব্যাহত হয়েছে।

 

“গত কয়েকদিনে সহিংসতায় আহতদের বাইরে অন্য রোগী খুব একটা আসতে দেখা যায়নি। তবে আগেই যারা ভর্তি ছিলেন, পরিস্থিতির কারণে তাদের দিকে আগের মতো অতটা মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি,” বলছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক।

 

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে বিক্ষোভ-সংঘর্ষ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর গত ১৫ই জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার আহত ব্যক্তিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তাররা।

 

এর মধ্যে, গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ, যাদের মধ্যে অন্তত ১৯ জন মারা গেছেন।

 

এছাড়া হাসপাতালে নেয়ার সময় আরও কমপক্ষে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

 

পরিস্থিতি এখন কেমন?

 

কোটা আন্দোলন কেন্দ্র করে সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করায় গত শুক্রবার মধ্যরাতে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার।

 

এরপর শনিবার কোথাও কোথাও সংঘাত ও হতাহতের ঘটনা ঘটলেও রোববারের পর পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।

 

“ফলে রোববারের পর রোগীর চাপও কমতে শুরু করেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

 

তবে হাসপাতালের পরিস্থিতি এখনও থমথমে বলে জানাচ্ছেন রোগীর স্বজনরা।

 

“যেদিকেই তাকান, দেখবেন পুলিশ। এত পুলিশ দেখে তো আমরা নিজেরাই ভয়ে আছি,” বলছিলেন নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা এক রোগীর স্বজন।

 

গত কয়েকদিনের সংঘাতে গুলিবিদ্ধ যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাদের মধ্যেও এখন উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে।

 

“যারা গুলিতে আহত হইছে, শুনতাছি হাসপাতালতে বের হইলে হেগো নাকি পুলিশে ধইরা লইতেছে,” উদ্বিগ্ন হয়ে বলছিলেন গুলিবিদ্ধ এক রোগীর স্বজন।

 

তারা অবশ্য নিজ চোখে এরকম কাউকে গ্রেফতার হতে দেখেননি বলে জানান। তবে বেশ কয়েকজন বিবিসি বাংলাকে বলেন যে পুলিশ তাদের কাছে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণ জানতে চেয়েছে।

 

হাসপাতালের যেসব ওয়ার্ডে আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, সেসব ওয়ার্ডের সামনে পুলিশি পাহারা দেখা গেছে।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছে যে, আহত রোগীদের নিরাপত্তার স্বার্থেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।

 

অন্যদিকে, গুলিবিদ্ধসহ সংঘাতে যারা গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাদের সামনে এখন মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে চিকিৎসার খরচ চালিয়ে যাওয়া।

 

“টাকা-পয়সা যা আমাগো কাছে ছিল, সবডি খরচ হইয়া গেছেগা এই (স্বাস্থ্য) পরীক্ষা, ওই পরীক্ষা আর ওষুধপাতির পিছনে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন গুলিতে আহত মোহাম্মদ রিংকুর ছোট ভাই মি. পিংকু।

 

এখন ধার-দেনা করে ভাইয়ের চিকিৎসা করাচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

 

“পনেরো-বিশ হাজার টাকা অলরেডি দেনা হইয়া গেছি আমরা। কাজ-কামও বন্ধ। ক্যামনে ভাইয়ের ওষুধপত্র কিনুম, এখন সেই টেনশন করতেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. পিংকু।

 

 

Facebook Comments Box

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিটিস্ক্যানে বাড়তে পারে ক্যানসারের ঝুঁকি: গবেষণায় ইঙ্গিত

বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ হতে পারে হার্ভার্ডে: ট্রাম্প প্রশাসনের হুঁশিয়ারি

ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাব: জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তহবিল বন্ধের সুপারিশ

পররাষ্ট্র দপ্তরের বাজেট অর্ধেকে নামানোর পরিকল্পনা ট্রাম্পের

যুক্তরাষ্ট্র ছাড়ছেন শিক্ষার্থীরা, কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন বেড়েছে

বিচারিক পর্যবেক্ষণে জাকারবার্গ, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ বিক্রির সম্ভাবনা

লন্ডনের আকর্ষণ হারাচ্ছে ধনীদের কাছে, পাড়ি জমাচ্ছেন এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে

ট্রাম্পের চাপ উপেক্ষা করে নীতিগত অবস্থান ধরে রেখেছে হার্ভার্ড: ওবামা

বুধবার ঢাকা আসছেন ট্রাম্পের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী

মিশিগানে ‘বরবাদ’ সিনেমার প্রদর্শনী উপলক্ষে সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

১০

চীনের ভিসা নিষেধাজ্ঞার তালিকায় মার্কিন কর্মকর্তারা

১১

সেমিকন্ডাক্টর আমদানিতে এবার শুল্ক আরোপের ঘোষণা ট্রাম্পের

১২

যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ দিনের বেশি থাকলে নাম নথিভুক্ত না করলে হবে কারাদণ্ড

১৩

পারমাণবিক প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট চুক্তি সই করবে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব

১৪

এখন থেকে কারা আমেরিকার ভিসা পাবেন, জানালেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী

১৫

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচির খবর প্রকাশ

১৬

ভিসা ও গ্রিনকার্ড দেয়ার আগে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট যাচাই- বাছাই হবে: মার্কিন অভিবাসন কর্তৃপক্ষ

১৭

হোয়াইট হাউজের ওবামার প্রতিকৃতি সরিয়ে নিজের নতুন ছবি বসালেন ট্রাম্প

১৮

যুক্তরাষ্ট্রে বিতাড়ন থেকে আর সুরক্ষা পাবেন না আফগানিস্তান ও ক্যামেরুনের অভিবাসীরা

১৯

যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত থাকা ভারতীয় শিক্ষার্থীরা এখন কী করবেন?

২০