পঞ্চখণ্ডের মনিষার ধারার অন্যতম পুরুষ, শক্তিমান কবি ফজলুল হক ভাইয়ের প্রয়াণে আমার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ বইছে সেটা লিখে প্রকাশ করা কঠিন। ফজলু ভাই আদতেই আলাদা ধাঁচের। বচনে, সৃজনে তিনি ছিলেন স্বকীয়। মাটিলগ্ন এই কবির গোটাজীবনটাই কেটেছে একেবারে সাদামাটা। আমরা যারা খুব কাছ উনাকে দেখেছি তারা সকলেই জানি কাব্যের মালা গেঁথে কথা বলতেন। এতটাই প্রকৃতি নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে যন্ত্র কোলাহল ছিলো ভীষণ অপছন্দের। তাই নগর বাসের ইচ্ছে না থাকাসত্ত্বেও তিনি নিতান্তই গরজে ছিলেন সিলেট নগরবাসী। শহরের ভেতর শ্যামলী আবাসিক এলাকা নামক এক গ্রামে বাস করে তাঁর নীরবতার সাধনা অব্যাহত রেখেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। প্রিয় ফজলুল হকের সঙ্গে চলার পথে রয়েছে অজস্র স্মৃতি, সেক্ষেত্রে আমি না হয় শেষ সময়ের কথাই বলি। মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পূর্বে ফজলু ভাইয়ের সিলেটের বাসায় যাই উনাকে দেখতে। সঙ্গে ছিলেন আব্দুল ওয়াদুদ, সুরাইয়া বেগম, আমার মেয়ে ইলিয়ানা বেগম শুকুর। কথা বলার তীব্র ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। কানে কানে কিছু কথা বললেন। সকলের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা, উনার সময় শেষ হয়ে গেছে এরকম, সবাই যেনো মিলে মিশে থাকি, সততার সাথে যেনো দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করি এবং শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করি এরকম অনেক কথা। সেই সময় কল্পনায়ও ভাবিনি এই অসময়ে কবি চলে যাবেন। দেখা হওয়ার দিনে আমার সহধর্মিণী সুরাইয়া বেগম এর দেওয়া কবি জালাল উদ্দীন রুমির কবিতার বইটি উপহার পেয়ে খুবই খুশি হয়েছেন। জানিনা পড়া হয়েছে কি না? কবির রেখে যাওয়া কাজগুলো যদি ধরে রাখা যায় তাহলে তাঁর আত্মা শান্তি পাবে। মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রার্থনা করি ফজলু ভাইয়ের পরিবারের সবাইকে ধৈর্য্য ধারণের তৌফিক দিন এবং সন্তানেরা যেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে।
কবি ফজলুল হক (১৯৬১-২০২২)
বিয়ানীবাজারের উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব, আশির দশকের শক্তিমান কবি ফজলুল হক ১৯৬১ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিয়ানীবাজার পৌরসভার কসবা নয়াটিল্লা এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন এবং খ্যাতনামা গীতিকার। বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেন। পঞ্চখণ্ড গোলাবিয়া পাবলিক লাইব্রেরী সহ বেশকিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তিনি বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ‘পৃথক দংশন’, ‘কবির জন্মদিন’, ‘শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে নির্বাসনের দিনে’। সম্পাদনা গ্রন্থ: ‘তপোধীর ভট্টাচার্য : জীবন ও কর্ম’। বাংলাদেশ ও ভারত থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা এবং সাহিত্য সংকলন ও সাময়িকীতে নিয়মিত তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। কবি ফজলুল হক বাংলাদেশ সময় ২৬ জুলাই মঙ্গলবার বিকেল সোয়া ৪ টায় সিলেট নগরীর শ্যামলী আবাসিক এলাকার বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
কবির লেখা কাব্যে যেমন বলেছেন, “সব দুঃখ সঙ্গে নেবো না, কিছুকিছু স্বপ্নচূর্ণ / সুখের মোড়কে এঁটে গেণ্ডাফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে / পথে রেখে যাবো।” হ্যাঁ, তিনি কথা রেখেছেন। অনেক দুঃখ-হতাশা ঘিরেই ছিলেন তারপরও তিনি সুখের মোড়কে এঁটে গেণ্ডা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে গেছেন পথে। যে জীবন কাটিয়েছেন ফজলু ভাই তাতে নিজেই ফুল হয়ে গেছেন। আমরা যতদিন ধরাধামে আছি সেই ফুলের সৌরভ-সুবাস মেখে বাকিটা পথ হেঁটে যাবো।
মন্তব্য করুন