পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণি যারা মেরুদণ্ড সোজা করে চলে-বসে-কাজ করে। তাই অভিকর্ষজ টানের ফলে দেহের পুরো ওজন ও চাপ মেরুদণ্ডকেই বহন করতে হয়। এতে করে মানুষমাত্রই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে কোমর ব্যথায় ভোগে। অর্থাৎ, বিশ্বজুড়ে কোমর ব্যথা একটি ব্যাপক বিস্তৃত স্বাস্থ্য সমস্যা। প্রাপ্তবয়স্কদের ২০ শতাংশ এবং বয়স্কদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষ কোমর ব্যথায় ভোগে। নিম্নে কোমর ব্যথার চিকিৎসা তথা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
কোমর ব্যথা কাদের বেশি হয়
সাধারণত ৩০ বছরের পর থেকে মানুষ কোমর ব্যথায় বেশি আক্রান্ত হয়। কারণ, ৩০ বছর থেকেই দেহের ক্ষয় প্রক্রিয়া শুরু হতে থাকে। ইংরেজিতে যাকে ডিজেনারেশন বলে। মেয়েদের স্যাক্রোইলিয়াক জয়েন্টের গঠন পুরুষের তুলনায় ছোট। ফলে একে অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে হয়। তাই পুরুষের চেয়ে নারীদের কোমর ব্যথায় আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ বেশি।
কোমর ব্যথা কত প্রকার
কোমর ব্যথার সঠিক চিকিৎসার জন্য কারণ ও স্থায়ীত্বের উপর নির্ভর করতে হয়। ব্যথার কারণের উপর ভিত্তি করে একে ৪ ভাগে ভাগ করা হয়। নিচে এর ভাগগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো।
মেকানিক্যাল পেইন: কোমর ব্যথার অনেকগুলো কারণের মধ্যে মেকানিক্যাল অর্থাৎ কাজ বা অভ্যাসজনিত সমস্যা অন্যতম। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যথার কারণ কাজ সম্পর্কিত। এছাড়াও স্পাইনাল স্টেনোসিস বা মেরুদণ্ড সরু হয়ে গেলে ডিস্ক প্রল্যাপস হয়েও যে ব্যথা হয় তাকে মেকানিক্যাল পেইনের মধ্যে ধরা হয়। পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় সৃষ্ট ব্যথাও এই প্রকরণের অন্তর্ভুক্ত।
ইনফ্লামেটরি পেইন: এই ধরনের ব্যথাকে বাংলায় প্রদাহজনিত ব্যথা বলে। স্পন্ডাইলোআর্থ্রোপ্যাইথস (Spondyloarthopathies) বা কশেরুকার দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহ, স্পন্ডাইলাইটিস (Spondylitis) বা মেরুদণ্ডের প্রদাহ ইত্যাদি কারণে সৃষ্ট ব্যথাকে ইনফ্লামেটরি ব্যথা বলা হয়।
অনকোলজিক্যাল পেইন: অনকোলজিক্যাল পেইন মানে হলো ক্যান্সারের কারণে সৃষ্ট ব্যথা। বোনে মেরো ক্যান্সারের একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে কোমর ব্যথা হয়ে থাকে। এই ধরনের ব্যথাকে অনকোলজিক্যাল পেইন বলা হয়।
ইনফেকসিওয়াস পেইন: ইনফেকসিওয়াস পেইন মানে সংক্রমণজনিত ব্যথা। মেরুদণ্ডের কোমরের অংশে কোনো টিস্যু বা ডিস্কে ইনফেকশন বা হলে যে ব্যথা হয় তাকে এই ভাগে ফেলা হয়।
আর ব্যথার স্থায়ীত্বের উপর ভিত্তি করে কোমর ব্যথা ৪ ভাগে ভাগ করা হলেও মানুষ মাত্র ২ ধরনের ব্যথা অনুভব করে। এগুলো হচ্ছে:
স্বল্প মেয়াদী বা একিউট পেইন: এই ব্যথা কিছুটা বিশ্রাম নিলে ভালো হয়ে যায়। তবে অনেকের কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ ব্যথা থাকতে পারে। এই ধরনের ব্যথায়ই মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়।
দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা বা ক্রনিক পেইন: যদি ব্যথা ৬ মাসের বেশি হয়ে থাকে তাহলে তাকে দীর্ঘস্থায়ী কোমার ব্যথা বলা হয়। এই ব্যথা নিয়ে ঘরে বসে থাকা ঠিক হবে না। ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
কোমর ব্যথা কেন হয়
আগেই বলেছি কোমর ব্যথার অনেকগুলো কারণের মধ্যে মেকানিক্যাল কারণ অন্যতম। যারা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে কাজ করেন তাদের একসময় কোমার ব্যথা হয়ে থাকে। এছাড়া নিন্মোক্ত সমস্যাগুলোর কারণেও কোমর ব্যথা হয়ে থাকে।
জন্মগত সমস্যা যেমন মেরুদণ্ড বাঁকা হওয়া; বয়সজনিত কারণে ডিস্ক ক্ষয়; লাম্বার স্টেনসিস বা স্পাইনাল ক্যানেল সরু হয়ে যাওয়া; স্পাইনাল ডিস্ক হার্নিয়েশন; এঙ্কাইলোজিং স্পন্ডাইলাইটিস; রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস;
অস্টিওমাইলাইটিস বা হাড়ের ইনফেকশন; স্পাইনাল টিউমার; স্পাইনাল টিউবাকুলোসিস; ভিটামিন ডি-এর অভাব; প্রেগনেন্সি; স্থূলতা; দীর্ঘক্ষণ বাইক বা গাড়ি চালানো; হাই হিলের জুতো পরা; অধিক নরম গদিতে বসা বা নরম বিছানায় শোয়া ইত্যাদি।
কোমর ব্যথা কীভাবে প্রকাশ পায়
কোমর ব্যথা যদি আঘাতজনিত কারণে না হয়ে থাকে তাহলে তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রথম দিকে সহ্য ক্ষমতার মধ্যে থাকলেও পরবর্তীতে তা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলে। চলুন জেনে নেওয়া যাক কোমর ব্যথার সাধারণ কিছু উপসর্গ:
দীর্ঘক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকলে ব্যথা আরও খারাপ হয়; অনেক সময় ব্যথা পা ও হাঁটুর দিকে ছড়িয়ে পড়ে; উঠতে বা বসতে সমস্যা হওয়া; পিঠ ও নিতম্বের চারপাশ অসাড় হয়ে যাওয়া; হাঁটা-চলায় সমস্যা; কোরের দিকে ফুলে যাওয়া; শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
কখন ডাক্তার দেখাবেন
বিশ্রাম নেওয়ার পরও ব্যথা না কমলে; ব্যথার বয়স ৬ সপ্তাহ হয়ে গেলে; কোমর ব্যথার সাথে অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলে; ব্যথার সাথে সাথে দ্রুত ওজন হ্রাস পেলে; কোমর ব্যথার সাথে পা শিরশির, অবশ ও দুর্বল হয়ে গেলে; প্রস্রাব ও মলত্যাগে সমস্যা হওয়া; ওষুধ খেয়েও ব্যথা নিয়ন্ত্রণ না হলে।
কোমর ব্যথা নির্ণয়
সাধারণত কোমরের ডিজিটাল এক্সরের মাধ্যমে কোমর ব্যথার কারণ নির্ণয় করা হয়। তবে এক্ষেত্রে এমআরআই হলো সবচেয়ে কার্যকর পরীক্ষা। এমআরআই করার মাধ্যমে হাড়ের চারপাশের মাংসপেশি, লিগামেন্ট, হাড়ের মাঝখানের ডিস্ক, নার্ভ ইত্যাদি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। প্রয়োজনে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেও আসল কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়।
কোমর ব্যথা হলে চিকিৎসা কী
কোমর ব্যথা যদি মেকানিক্যাল কারণে হয়ে থাকে তাহলে স্বল্প মেয়াদী বা দীর্ঘস্থায়ী কোমর ব্যথার চিকিৎসা হলো ফিজিওথেরাপি। এক্ষেত্রে ওষুধ সাময়িক যন্ত্রণা উপশম করবে ঠিকই কিন্তু কোমর ব্যথায় ব্যথার ওষুধ কোনো কার্যকর সমাধান নয়। বরং দীর্ঘদিন ব্যথার ওষুধ খেলে আপনার লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। কোমর ব্যথা শুধু নয়, যেকোনো মেকানিক্যাল পেইনে সম্পূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত চিকিৎসা হচ্ছে ফিজিওথেরাপি।
মন্তব্য করুন