খুলনা শহরের বাসিন্দা আমজাদ আলি কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর জন্য মেডিক্যাল ভিসার আবেদন করেছিলেন নভেম্বর মাসের ২৩ তারিখ। কিন্তু ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র আইভ্যাকে তার অ্যাপয়েন্টমেন্টের তারিখ পড়েছিল ২০২৪ সালের আটই জানুয়ারি।
হয়তো তিনি ভিসা পেতেন তার থেকেও দিন ১৫ পরে, অর্থাৎ আবেদন করার প্রায় মাস দেড়েক পরে।
তবে শুক্রবার থেকে পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসা করাতে আসা বাংলাদেশি রোগীদের মেডিক্যাল ভিসা ব্যবস্থাপনায় যে বদল আনা হয়েছে, তাতে আবেদন করার দুই থেকে চার কর্ম-দিবসের মধ্যেই মি. আলিদের মতো বহু রোগী মেডিক্যাল ভিসা পেয়ে যাবেন বলে আশা করছে ভারতের বেসরকারি হাসপাতালগুলির একটি সংগঠন।
নতুন ব্যবস্থায় মেডিক্যাল ভিসা আবেদনকারীদের দিক থেকে অন্য কিছু করতে হবে না, তারা যেভাবে আবেদন করেন, সেটাই চালু থাকবে।
কিন্তু নথি যাচাই করে ‘ভিসা ইনভিটেশান লেটার’ দেওয়ার পদ্ধতির বদল এটি।
নতুন ব্যবস্থায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি বিশেষ ওয়েবসাইটে যাচাই করা নথি আপলোড করার দায়িত্ব পড়েছে রাজ্যের হাসপাতালগুলির ওপরে। ওই যাচাই করা নথির ভিত্তিতেই দ্রুত মেডিক্যাল ভিসা দেবে বাংলাদেশে ভারতীয় হাই কমিশন বা সহকারী হাই কমিশনারের দপ্তরগুলি
নতুন পদ্ধতি কীভাবে কাজ করবে?
সম্প্রতি ঢাকার ভারতীয় হাই কমিশনের দুই কর্মকর্তা, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং তথ্য প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়ার কর্মকর্তা এবং পূর্ব ভারতের বেসরকারি হাসপাতালগুলির সংগঠন এ এইচ ই আইয়ের মধ্যে একটি বৈঠক হয়।
এ এইচ ই আইয়ের প্রেসিডেন্ট রূপক বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “ওই বৈঠকেই ঠিক হয় যে এখন থেকে রোগীদের আবেদনের ভিত্তিতে প্রথমে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল তার চিকিৎসা সংক্রান্ত সব নথিপত্র যাচাই করবে, চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করবে। তারপরে একটি বিশেষ ওয়েবসাইটে রোগীর ‘ভিসা ইনভিটেশান লেটার’ বা ‘ভিআইএল’ আপলোড করা হবে হাসপাতালের তরফ থেকে।“
‘ইয়াত্রি সুভিধা হেল্থ ভিসা প্রসেস’ নামে এই প্রক্রিয়াতে যে ওয়েবসাইটটি ব্যবহার করা হবে, সেটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ তৈরি করেছে।
“আবার ওই ওয়েবসাইটে আমাদের তরফে যে কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থাকবে ‘ভিসা ইনভিটেশান লেটার’ আপলোড করার, তাদের পরিচয় আগে থেকেই নথিভুক্ত থাকবে। লগইন করার সময়ে ওই ব্যক্তির আধার কার্ড এবং হাসপাতালের জিএসটি নম্বরও দিতে হবে,” জানাচ্ছিলেন মি. বড়ুয়া।
তার কথায়, “ওই বিশেষ ওয়েবসাইটটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৈরি, সেখানে যে নথি আমরা আপলোড করব, তা আমাদের তরফে ইতিমধ্যেই যাচাই করা হয়েছে। আবার যিনি তথ্য আপলোড করবেন, তার নাম, পরিচয়ও আগে থেকেই নথিভুক্ত করা। অর্থাৎ আমরা যে ইনভিটেশান লেটার আপলোড করব সেগুলো একাধিক পর্যায়ে যাচাই করা।
“তাই তার ভিত্তিতেই হাই কমিশনের দিক থেকে খুব দ্রুত,মেডিক্যাল ভিসা দিয়ে দেওয়া যাবে,” জানাচ্ছিলেন রূপক বড়ুয়া।
তার দাবী, “এতদিন যে মেডিক্যাল ভিসা পেতে ৪৫ থেকে ৫০ দিন মতো লাগছিল, তা এখন কমে মাত্র দুই থেকে চারটি কাজের দিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করছি।“
ওই ওয়েবসাইটে হাসপাতালের তরফ থেকে একাধিক পর্যায়ে যাচাই করা তথ্য আপলোড করার পরে একটি ২৫ সংখ্যার ‘ইউনিক আইডি’ তৈরি হবে। এই ‘আইডি’ আবেদনকারীর কাছে যেমন যাবে, তেমনই হাসপাতাল এবং ভারতীয় হাই কমিশনের ভিসা বিভাগেও যাবে।
সীমান্তে দিতে হবে চিকিৎসার নথি
কলকাতার হাসপাতালগুলিতে মাঝে মাঝেই অভিযোগ আসে যে তাদের পাঠানো নয়, এমন ‘ভিসা ইনভিটেশান লেটার’-এর ভিত্তিতে বাংলাদেশ থেকে আসল মেডিক্যাল ভিসা ইস্যু করে দেওয়া হয়েছে।
হাসপাতাল সূত্রগুলি বলছে, এমনও অনেকে ‘মেডিক্যাল ভিসা’ নিয়ে ভারতে চলে আসেন, যারা চিকিৎসা ছাড়া অন্য কোনও কাজে এখানে আসছেন।
“কেউ হয়তো চিকিৎসা করাতেই এসেছেন, কিন্তু তাদের টাকা ফুরিয়ে গেছে। তারা বাংলাদেশে কোনও আত্মীয়-বন্ধুকে খবর দেন টাকা নিয়ে আসার জন্য। তাকে যেহেতু তাড়াতাড়ি আসতে হবে, তাই তিনিও আবার মেডিক্যাল ভিসার জন্য আবেদন করে চলে আসেন,” জানাচ্ছিল ওই সূত্রটি।
রূপক বড়ুয়ার কথায়, “আবার এক হাসপাতালের ইনভিটেশানের ভিত্তিতে মেডিক্যাল ভিসা নিয়ে আসা বাংলাদেশী নাগরিকদের সীমান্ত থেকেই এক শ্রেণীর দালাল ধরে নিয়ে গিয়ে অন্যান্য ছোটখাটো নার্সিং হোমে চিকিৎসা করায়। আবার মেডিক্যাল ভিসা নিয়ে অন্য কোনও কাজ সেরে বাংলাদেশে ফিরে যান অনেকে।“
তিনি বলছিলেন, “এগুলো এবার থেকে বন্ধ হবে। যখন মেডিক্যাল ভিসা নিয়ে কেউ সীমান্ত পেরবেন, তখন তাকে চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি জমা দিতে হবে। আবার তিনি যখন ফিরে যাবেন, তিনি যে সত্যিই নির্দিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে নিজের দেশে ফিরছেন, সেই নথিও সীমান্তে জমা দিতে হবে। চিকিৎসার প্রয়োজনে যেমন দ্রুত মেডিক্যাল ভিসা দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে, তেমনই সেটার অপপ্রয়োগ যাতে কেউ না করেন, সেটাও নিশ্চিত করা হবে নতুন ব্যবস্থাপনায়।“
দেড় মাস অপেক্ষার অবসান
খুলনার বাসিন্দা আমজাদ আলি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আমি হার্টের রোগী, স্টেন্ট বসানো আছে। চেক আপ করাতে কয়েক মাস পরে পরেই কলকাতায় যেতে হয়। আমার মেডিক্যাল ভিসার মেয়াদ শেষ হয় অক্টোবরের ২৩ তারিখ। নতুন করে ভিসার আবেদন করি এবছরের ২৩শে নভেম্বর।
“তার আগে আমি কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে টেলি কনফারেন্সে কথা বলি। আমি যে অসুস্থ বোধ করছি, আমার হাতে, পায়ে পানি জমছে, সেটা জানাই। এসবের ভিত্তিতে তারা আমাকে ইনভিটেশান লেটার পাঠায়। সেটা দিয়ে আমি ভিসার আবেদন করেছিলাম। আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্টের তারিখ দেওয়া হয় আগামী বছরের আটই জানুয়ারি,” জানাচ্ছিলেন মি. আমজাদ আলি।
এরকম আরও অনেক অসুস্থ মানুষকে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয় মেডিক্যাল ভিসার আবেদন জমা দিয়ে।
মি. আলি বলছিলেন, “মেডিক্যাল ভিসার আবেদন করে যদি মাস দেড়েক অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে তো পেশেন্টের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যাবে!”
কিন্তু খুলনায় ভারতের সহকারী রাষ্ট্রদূতের দপ্তরে দ্রুত ভিসা পাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন তিনি এবং আরও অনেকে। ওই আবেদন করে অবশ্য অনেকটাই কম সময়ে, ডিসেম্বরের ১২ তারিখে এখন ভিসা পাবেন বলে আশা করছেন মি. আলি।
“খুলনায় সহকারী হাই কমিশনে অনুরোধ করার ফলে আমি এখন হয়তো ভিসার মূল আবেদন করার দিন কুড়ির মধ্যে মেডিক্যাল ভিসা পেয়ে যাব। শুক্রবার থেকে যে ব্যবস্থা চালু হল, সেই সুবিধা যদি আমি পেতাম, তাহলে আমিও তো দিন দুয়েকের মধ্যেই হয়তো ভিসা পেয়ে যেতাম,” বলছিলেন আমজাদ আলি। বিবিসি বাংলা
বাংলা সংবাদের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
মন্তব্য করুন