যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস যদি রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে হেরে যান, সেটা আরব বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকদের কারণেই হবে। ইয়েমেনি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক সামরা লোকমান এমনটাই ধারণা করছেন।
সামরা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আরব আমেরিকানদের ভোট নিশ্চিতভাবেই ডেমক্র্যাট প্রার্থীরা পেয়ে আসছেন। গাজা ও লেবাননে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থনের জন্য এবার ডেমোক্র্যাটদের মূল্য দিতে হবে।
মিশিগানের ডিয়ারবোর্ন শহরের উপকণ্ঠ ডেট্রয়টে নিজের অফিসে বসে আল-জাজিরার সঙ্গে আলাপকালে সামরা বলেন, ‘কমলা হ্যারিস যদি হারেন, তাহলে আমি বলব, এই কমিউনিটির কারণে তাঁকে হারতে হয়েছে। গাজার কারণে, সেখানে গণহত্যার কারণে তাঁকে হারতে হয়েছে।’
গাজা ও লেবাননে ভয়াবহ নৃশংসতা সত্ত্বেও বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে সামরার মতো অনেক আরব বংশোদ্ভূত মার্কিন হতাশ হয়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকে ছেড়ে যাচ্ছেন। পরিবর্তনের আশায় তাঁরা ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন।
মুসলিম ও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বক্তব্য দেওয়ার পরও ট্রাম্প এসব ভোটারের কাছে গেছেন। ডিয়ারবোর্নে তিনি অভিবাসী ও মুসলিমদের মধ্যে প্রচার চালিয়েছেন। সেখানে গত শুক্রবার আরব বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকেরা তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন।
সামরার নেকলেসে ফিলিস্তিনের মানচিত্র, আল আকসা মসজিদের গম্বুজ আর ফিলিস্তিনি পতাকা শোভা পাচ্ছিল। তিনি যুক্তি তুলে ধরে বলেন, মুসলিমদের ট্রাম্পকে ভোট দেওয়া জুয়া ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু কমলাকে সমর্থনের অর্থ নিশ্চিত পরাজয়। কারণ, তিনি ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়েই যাবেন।
ইয়েমেনি বংশোদ্ভূত এই নারী বলেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলেও ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালু থাকার আশঙ্কা ৯৯ ভাগ। যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা ১ ভাগ। কিন্তু কমলার অধীনে গণহত্যা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা শতভাগ।
ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি’ ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন। তবে কীভাবে সেটা করবেন, সে বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি। ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে ইসরায়েলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন।
তবে সামরা বলেন, ট্রাম্পকে সমর্থনের অর্থ এই নয় যে তাঁর আগের মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যসংক্রান্ত উদ্যোগ ভালো ছিল। বরং এর মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রতি বাইডেন–কমলা প্রশাসনের অভূতপূর্ব সামরিক সমর্থনের বিষয়ে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্টকে কিছুটা হলেও জবাবদিহির আওতায় আনা আসল লক্ষ্য।
এই আরব বংশোদ্ভূত মার্কিন নারী বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না, এই গণহত্যার শাস্তি কখনো হবে না। এবং আমার মনে হয়, এই শাসনকে দ্বিতীয় মেয়াদে সুযোগ দেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়।’
সামরা বলেন, ‘ওয়াশিংটনের প্রতি বিশেষ করে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের প্রতি আমার বার্তা হচ্ছে, এই নির্বাচনের পর আপনারাও যদি বাইডেনের মতো কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান, তাহলে আপনারাও এমন পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকুন।’
অবশ্য কমলার কিছু সমর্থক বলছেন, তিনি বাইডেনের কাজ চালিয়ে যাবেন না। তিনি ইসরায়েল নীতির বিষয়ে নিজেকে ইতিমধ্যেই কিছুটা দূরে রেখেছেন। তিনি ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের অবাধে প্রবাহ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আরব আমেরিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে দূরত্ব ট্রাম্পের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য মিশিগানে দুই প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে আরব ভোটাররা চূড়ান্ত ফল নির্ধারণ করে দিতে পারেন। এই রাজ্যের জয়–পরাজয়ও ঠিক করে দিতে পারে, কে হচ্ছেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
ট্রাম্প শুক্রবার আরব সংখ্যাগরিষ্ঠ ডিয়ারবোর্ন শহরে সংক্ষিপ্ত নির্বাচনী প্রচার চালান। ট্রাম্প ও তাঁর উগ্রপন্থী মিত্ররা দীর্ঘদিন ধরে অপপ্রচার চালিয়ে আসছিলেন যে এই নগরে ইসলামি আইন চালুর চেষ্টা চলছে। ফলে সেখানে মার্কিন কর্তৃপক্ষের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকবে না।
শুক্রবার সেখানে গিয়ে ট্রাম্প উষ্ণ অভ্যর্থনা পান। ব্যবসায়ী আলবার্ট আব্বাস যখন বিবৃতি পড়ছিলেন, তখন ট্রাম্প তাঁর পাশে দাঁড়ানো। সেই বিবৃতিতে তিনি ‘ক্ষমতাসীনরা বিশ্বাসঘাতক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
ট্রাম্প যখন সেখানে ‘লেবাননে ধ্বংস ও ভোগান্তি’ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন, আব্বাস তখন গাজায় ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি তোলেন।
ট্রাম্পের নির্বাচনী পতাকা হাতে ডিয়ারবোর্নের বাসিন্দা হাসান হোসেন আবদুল্লাহ বলেন, ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন প্রত্যেকে খুশি ছিলেন।
আবদুল্লাহ বলেন, ‘ট্রাম্প যদি বলেন, তিনি যুদ্ধ বন্ধ করবেন, তাহলে তিনি যুদ্ধ বন্ধ করতে যাচ্ছেন। আমি বিশ্বাস করি, ট্রাম্প ভালো মানুষ। আমি বিশ্বাস করি, তিনি যুদ্ধ বন্ধ করবেন।’
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের সময় সেখানে ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে বিক্ষোভ হচ্ছিল। ট্রাম্পের গাড়িবহর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মিসরীয় বংশোদ্ভূত ফাউজি মোহাম্মদ স্লোগান দেন, ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো।’
ট্রাম্পকে আরব কমিউনিটির সমর্থন দেওয়া নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত ফাউজি। তাঁর মতে, ট্রাম্প বারবারই ফিলিস্তিনবিরোধী নীতির কথা বলেছেন। এমনকি তিনি ফিলিস্তিনিদের গালিও দিয়েছেন।
ফাউজি বলেন, ‘কেউ যদি ট্রাম্প বা কমলাকে ভোট দেন, তাহলে তাঁরা গাজা ও লেবাননে আমাদের নিহত শিশুদের রক্তের কোনো দাম দিচ্ছেন না বলেই মনে হবে।’
ট্রাম্প ডিয়ারবোর্নে যেখানে প্রচার চালিয়েছেন, তার কয়েক ব্লক দূরে কমলার নির্বাচনী প্রচার অফিস। সেখানে ডিয়ারবোর্ন ডেমোক্রেটিক ক্লাবের প্রধান সামি খালদি বলেন, অতীতে কখনো রিপাবলিকানরা আরব আমেরিকানদের কোনো বিষয়ে নজর দেয়নি। কিন্তু ট্রাম্প দিচ্ছেন, কারণ তিনি ভোট পেতে ‘মরিয়া’।
খালদি বলেন, ট্রাম্প সেই ব্যক্তি, যিনি মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করেছেন। তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলের অংশ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ফিলিস্তিনে অনেক অবৈধ বসতি স্থাপন করেছে ইসরায়েল।
ডিয়ারবোর্নে প্রচার চালানোর আগে ট্রাম্প গত মাসে মিশিগানের আরেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ শহর হ্যামট্রামকে প্রচার চালান।
ট্রাম্পের অনেক সমর্থক মনে করেন, হ্যামট্রামকের মেয়র ইয়েমেনি বংশোদ্ভূত মার্কিন আমির গালিব আরব কমিউনিটির সঙ্গে ট্রাম্পের সংযোগ ঘটিয়ে দিয়েছেন।
অবশ্য গাজা ও লেবাননে ইসলায়েলি হামলা শুরুর অনেক আগেই গালিব রিপাবলিকানদের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করার কাজ শুরু করেছেন। স্কুলের গ্রন্থাগারে এলজিবিটিকিউ বিষয়ের বই রাখা নিয়ে তাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি ওই শহরে এলজিবিটিকিউ পতাকাও নিষিদ্ধ করেন, যা রিপাবলিকানদের মতের সঙ্গে মেলে।
গালিবের এসব উদ্যোগ নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা তাঁর ওপর বেশ বিরক্ত। গালিব নিজেও স্বীকার করে বলেন, রিপাবলিকান দলের দিকে তাঁর ঝুঁকে পড়ার জন্য এই ইস্যু ‘অনুঘটক’ হিসেবে কাজ করেছে। তবে এলজিবিটিকিউ পতাকা নিয়ে উগ্র বামপন্থীদের আগ্রাসী আচরণের সমালোচনা করেন তিনি।
ট্রাম্পকে সমর্থন করার বিষয়ে গালিব আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এটা কোনো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নয় যা আমরা এক দিনেই নিয়েছি। বরং বর্তমান প্রশাসনের গত চার বছরের বিশেষ করে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর তাদের ভূমিকার কারণে হতাশ হতে হয়েছে আমাদের।’
দক্ষিণ লেবাবন থেকে কাছের ডিয়ারবোর্ন হেইটস শহরের মেয়র বিল বাজ্জিও ট্রাম্পকে সমর্থন করেছেন। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, মিশিগানের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের’ অন্যতম হোতা সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির মেয়ে লিজ চেনির সঙ্গে কমলাকে নির্বাচনী প্রচার চালাতে দেখার পর থেকে তিনি ট্রাম্পের পক্ষে পূর্ণ শক্তি নিয়ে নামার সিদ্ধান্ত নেন।
বাজ্জি বলেন, ট্রাম্প শান্তি চান। তিনি যুদ্ধ চান না। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, তাঁর বার্তা সঠিক। কারণ, তিনি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, কোনো যুদ্ধের কথা শোনা যায়নি। তিনি ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন।’
তবে আরব বংশোদ্ভূত সংখ্যাগরিষ্ঠ ডিয়ারবোর্ন শহরের মেয়র আবদুল্লাহ হামুদ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সমর্থন জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
হামুদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুক্রবার লিখেছেন, মুসলিমদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করার মূল কারিগরের ডিয়ারবোর্নে প্রচার বন্ধ করা উচিত।
হামুদ লিখেছেন, ‘ট্রাম্প্র যে কী, আরব কমিউনিটির মানুষ সেটা জানে। তাঁর কারণে আমাদের কয়েক বছর ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। নানাজনের কাছ থেকে অনুরোধ আসার পরও আমি তাঁর পাশে বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি।’
এই মেয়র ইসরায়েলি নৃশংসতায় ডেমোক্র্যাটদের সমর্থনকে দায়ী করে বলেন, ‘তাদের কারণে আমাদের কমিউনিটিতে ট্রাম্প ঢুকতে পেরেছেন।’
মন্তব্য করুন