প্রায় ৩ দশক আগে জনপ্রিয় বাংলা নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ রচনা করেছিলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। নাটকের মূল চরিত্র ‘বাকের ভাই’ দর্শক-শ্রোতাদের মনে তুমুল আলোড়ন ফেলেছিল। সেই চরিত্রে রূপদানকারী আসাদুজ্জামান নূর ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছিলেন। যার বদৌলতে গ্রাম-গঞ্জের অনেক মানুষের কাছে আজও তিনি বাকের ভাই নামে পরিচিত।
কোথাও কেউ নেই’তেও আসাদুজ্জামান নূরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে এবার নাটকে নয়, তাকে বাস্তবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাত ১১টার দিকে রাজধানীর বেইলি রোডের নওরতন কলোনি থেকে বরেণ্য অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজধানীর মিরপুর থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় ও সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এরপর থেকেই আলোচনায় তিনি। বাঙালি দর্শকের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকা বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয়ের কথা ছিল প্রখ্যাত অভিনেতা তারিক আনাম খানের। তবে নাট্যকার ও প্রযোজকের সিদ্ধান্তে পরে আসাদুজ্জামান নূর চূড়ান্ত হন। এ কারণে দীর্ঘদিন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কাজ করেননি তারিক আনাম খান। তবে সেসময়ে আসাদুজ্জামান নূরই সত্যিকারের বাকের ভাই হয়ে জায়গা করে নেন কোটি ভক্তের হৃদয়ে।
১৯৯৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ‘কোথাও কেউ নেই’-এর শেষ পর্ব আলোচনার তুঙ্গে ছিল। ধারাবাহিকটির মূল চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসি না দেয়ার দাবিতে অঘোষিত কারফিউ দেয়া হয়। মিথ্যা মামলায় তাকে ফাঁসানো হয়। আগের পর্বে বদি (অভিনেতা আবদুল কাদের) মিথ্যা সাক্ষী দিতে যান আদালতে। বাকের ভাইয়ের এই সাগরেদ কুত্তাওয়ালির হুমকিতে ভয় পেয়ে এই কাজ করেন। পত্র-পত্রিকায় আগেই সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল, বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবে। সেই খবরে রাস্তায় নেমেছিলেন হাজার হাজার দর্শক। তাদের হাতে ছিল ব্যানার, পোস্টার।
সেখানে লেখা ‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’, ‘বদির দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’, ‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কেন, কুত্তাওয়ালি জবাব চাই। কিন্তু কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। বাকের ভাইকে তিনি ফাঁসি দেবেনই। দর্শকদের দাবির মুখে নিজের পরিকল্পনা থেকে সরে আসবেন না। কথিত আছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ফোন করে ধারাবাহিকটির প্রযোজক বরকতউল্লাহকে বলেছিলেন, হুমায়ূন আহমেদকে বলুন, বাকের ভাইকে বাঁচিয়ে রাখা যায় কিনা।
হুমায়ূন আহমেদ তবু রাজি হননি। শেষ পর্বটি প্রচারিত হওয়ার কথা ছিল আগের সপ্তাহেই। উত্তেজিত দর্শক শুটিং সেটে হামলা চালাতে পারে, এই ভয়ে তা পিছিয়ে দেয়া হয়। তাই শেষ পর্বটি প্রচারিত হয় নির্ধারিত দিনের পরের সপ্তাহে। সেদিন সন্ধ্যা নামার পর পুরো ঢাকা শহরে নেমে আসে নীরবতা, যেন অঘোষিত কারফিউ। দেশের অন্য শহর, এমনকি মফস্বলেও প্রভাব পড়েছিল। শেষ দৃশ্যে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হওয়ার পর সেদিন টিভি সেটের সামনে থাকা অনেক দর্শক নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। যেন বাস্তবের কোনো নায়ককে হারিয়ে ফেলেছেন তারা। মুনারূপী সুবর্ণা মুস্তাফার কান্না ছুঁয়ে গিয়েছিল দর্শকদের। ভোরে কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে মুনা। জেলার এসে জানতে চান, ‘আপনি আসামির কী হন?’ উত্তরে মুনা বলেন, ‘আমি ওর কেউ না।’ মুনার মুখের এই সংলাপ দর্শকের হৃদয়ে হাহাকার বাড়িয়ে দেয়।
বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয় করে অভাবনীয় জনপ্রিয়তা পান আসাদুজ্জামান নূর। নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ নাটকেই তিনি অভিনয় করতেন। এই নাটকে বাকের ভাই চরিত্রে হুমায়ূন আহমেদই তাকে নির্বাচন করেন।আসাদুজ্জামান নূর বলেছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে ‘অয়োময়’ নাটকে অভিনয় করার কারণে আমার কণ্ঠে একটা ভারিত্ব ভাব চলে এসেছিল। আমি ওই চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিলাম না। তখন বরকতউল্লাহ ভাই আমাকে এই চরিত্র করতে বলেন। বললেন, আপনার এটা ভাঙতে হবে। ধারাবাহিকটিতে আসাদুজ্জামান নূর ছাড়া আরো অভিনয় করেন মুনা চরিত্রে সুবর্ণা মুস্তফা, বদি চরিত্রে আবদুল কাদের, মজনু চরিত্রে লুৎফর রহমান জর্জ, মতি চরিত্রে মাহফুজ আহমেদ, বকুল চরিত্রে আফসানা মিমি, উকিল চরিত্রে হুমায়ুন ফরিদীসহ আরও অনেকে।
উল্লেখ্য, আসাদুজ্জামান নূর ১৯৪৬ সালের ৩১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নীলফামারী-২ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মন্তব্য করুন