কোর্তোয়ার জাদুর হাতে শিরোপা

ইমানুয়েল ডেনিস গত রাতে খেলা দেখেছেন কি না, কে জানে!

বর্তমান সময়ে নাইজেরিয়ার ফুটবলে যে কয়জন প্রতিভাবান স্ট্রাইকার উঠে এসেছেন, এই ডেনিস তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বেলজিয়ান ক্লাব ব্রুগার হয়ে আলো ছড়িয়ে এই মৌসুমের শুরুতে নাম লিখিয়েছিলেন ইংলিশ ক্লাব ওয়াটফোর্ডে। মৌসুম জুড়ে বেশ ভালোই খেলেছেন, তবে লাভ হয়নি। ইংলিশ প্রিমিয়ার থেকে অবনমিত হয়েছে ওয়াটফোর্ড। লিগের খেলা শেষ যেহেতু, ডেনিসের হাতে এখন অখণ্ড অবসরই থাকার কথা। সে অবসরে ডেনিস যদি আর দশজন ফুটবলপ্রেমী দর্শকের মতো গত রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের স্বাদ নিয়েও থাকেন, থিবো কোর্তোয়ার পারফরম্যান্স দেখে একটু হলেও কি নস্টালজিয়ায় ভুগেছেন? কোর্তোয়ার উন্নতি দেখে অবাক হয়েছেন?

কোর্তোয়ার উন্নতি – শব্দজোড়া নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে অনেকের। ২০১৮ বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপারের পুরস্কার যে খেলোয়াড় পেয়েছেন, তাঁর ‘উন্নত’ মান নিয়ে কারওর মনে কোনো সন্দেহ থাকার কথা না। এই পুরস্কারটাই মূলত তখন চেলসি থেকে রিয়ালে আসার পথটা সহজ করে দিয়েছিল থিবো কোর্তোয়ার জন্য। ওই বিশ্বকাপের পর কেয়লর নাভাসের মতো সর্বজয়ী গোলকিপারের জায়গায় কোর্তোয়াকে নিয়ে আসতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি রিয়াল মাদ্রিদের সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। কিন্তু এরপর? রিয়ালের জার্সি গায়ে কোর্তোয়ার পথটা কেমন ছিল?

এখানেই দৃশ্যপটে আগমন ইমানুয়েল ডেনিসের। ২০১৯-২০ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্বে ক্লাব ব্রুগার বিপক্ষে লড়েছিল রিয়াল। নিজেদের মাঠে প্রথমার্ধেই ডেনিসের জোড়া গোলে পিছিয়ে পড়েছিল লস ব্লাঙ্কোসরা। তবে সে গোল দুটিতে ডেনিসের চেয়ে কোর্তোয়ার ‘ভূমিকা’-ই চোখে পড়েছিল বেশি। প্রথম গোলে ডেনিস ডান পায়ে শট নেবেন না বাঁয়ে, সেটা বুঝতে না পেরে হাস্যকরভাবে মাটিতে পড়ে গিয়ে দুবার দিক পরিবর্তন করলেন। দ্বিতীয় গোলে সামনে চলে এসে ডেনিসের সঙ্গে নিজের ব্যবধান কমানোর পরেও বলে হাতই লাগাতে পারেননি। ডেনিসের আলোয় যেন ম্লান হয়ে গিয়েছিলেন কোর্তোয়া। নিচের ভিডিওতে দেখে নিতে পারেন গোল দুটি।

এই দুই গোলে কোর্তোয়ার ভূমিকা দেখে যদি কেউ চমকে না-ও থাকেন, নিশ্চিতভাবেই চমকে গিয়েছিলেন বিরতিতে নেওয়া কোচ জিনেদিন জিদানের এক সিদ্ধান্তে। কোর্তোয়াকে বসিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে বিকল্প গোলকিপার আলফঁস আরেওলাকে নামিয়ে দেন রিয়ালের তৎকালীন কোচ। তখন শোনা গিয়েছিল, কোর্তোয়া অসুস্থ, যে কারণে আর খেলানো হয়নি তাঁকে। পরে স্প্যানিশ সাংবাদিকদের কল্যাণে জানা যায়, আগে থেকে অসুস্থ ছিলেন না কোর্তোয়া। ডেনিস-ঝলকে ‘অসুস্থ’ হয়ে গিয়েছিলেন। এতটাই স্নায়ুচাপে ভুগছিলেন, যে বিরতির সময়ে নার্ভাস ব্রেকডাউনের কারণে বমি করেছিলেন এই বেলজিয়ান। পরে রামোস-কাসেমিরোর কল্যাণে ম্যাচ ড্র করলেও কোর্তোয়ার ফর্মের পাশে বেশ বড়সড় এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল এই ম্যাচ। কোর্তোয়াকে আদৌ রিয়ালের মূল গোলকিপার হিসেবে রাখা হবে কি না — শুরু হয়ে গিয়েছিল আলোচনা।

তবে কোর্তোয়ার এই ‘নার্ভাস ব্রেকডাউন’ কিন্তু একদিনে হয়নি। ব্রুগার বিপক্ষে ম্যাচের আগেও রিয়ালের জার্সি গায়ে গোলবারের নিচে একের পর এক শিশুতোষ ভুল করছিলেন, পারফরম্যান্স ছিল পড়তির দিকে। দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে গোল হজম করার ব্যাপারটা যেন একরকম নিজের ‘ট্রেডমার্ক’ বানিয়ে ফেলেছিলেন কোর্তোয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোর্তোয়ার ওসব গোল হজম করা দেখে কত হাস্যরসই না জন্ম নিয়েছে! সৃষ্টি হয়েছে হাজারো মিম-ট্রলের। একের পর এক ভুল থেকে পাওয়া অস্বস্তিগুলো জমাট বেঁধে চূড়ায় উঠেছিল ওই ব্রুগার বিপক্ষে ম্যাচটাতেই। যেখানে ডেনিস-কোর্তোয়া লড়াইয়ে শেষ হাসিটা হেসেছিলেন অখ্যাত ওই নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার।

দুই বছর পর ডেনিসের নতুন দল ওয়াটফোর্ড যেখানে দ্বিতীয় বিভাগে অবনমিত, কোর্তোয়া সেখানে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। শুধু জিতেছেন বলাটা ভুল হবে, জিতিয়েছেন। কোর্তোয়ার অতিমানবীয় পারফরম্যান্স থামিয়ে দিয়েছে সন্দেহবাদীদের কোলাহল। দুই বছর পর গত রাতে খেলা দেখতে দেখতে কোর্তোয়ার এই ‘উন্নতি’-কে বিশেষায়িত করতে গেলে ডেনিস তো শব্দ হারা হবেনই, যেকোনো ব্যাকরণবিদেরও ঘাম ছুটে যাওয়ার কথা!

উন্নতি যে শুধু মাঠের খেলাতেই হয়েছে, তা নয়। যে কোর্তোয়া বছর দুয়েক আগে স্নায়ুচাপে ভুগে বমি করছিলেন, চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের মতো স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচের আগে সে কোর্তোয়ার আকাশছোঁয়া আত্মবিশ্বাস, সুকঠিন মানসিকতা জাগায় বিস্ময়। নিঃসংকোচে জানিয়েছিলেন, ‘আপনারা জানেন, রিয়াল মাদ্রিদ যখনই ফাইনাল খেলে, তারা জেতে।’ ম্যাচের আগে তাঁর কথাটা অনেকের কাছেই দম্ভ মনে হয়েছিল। রিয়াল মাদ্রিদেরই অনেক সমর্থক ভেবেছিলেন, ম্যাচের আগে এভাবে বলা ঠিক হয়নি, যদি কথাটা বুমেরাং হয়ে ফেরত আসে!

আসেনি। এ কোর্তোয়া যে দুই বছর আগে ডেনিসের দাপটে ম্লান হয়ে থাকা কোর্তোয়া নন! এ কোর্তোয়া নিজের বলা কথার মান রাখতে জানেন, প্রচণ্ড চাপে নিজেকে বরফশীতল রাখতে জানেন। যে হিমশীতলতার সামনে নিভে যায় সালাহদের আক্রমণের আগুন। গোটা ম্যাচে সালাহ-মানে-থিয়াগোদের নয়-নয়টা শট আটকেছেন। এর মধ্যে সাতটা আবার বক্সের ভেতর থেকে আসা শট।

শুধু ফাইনাল বলেই নয়। সেমিফাইনালে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে বুড়ো আঙুলের টোকায় যেভাবে জ্যাক গ্রিলিশকে গোলবঞ্চিত করেছিলেন, সেটা না হলে ফাইনালে হয়তো রিয়াল নয়, সিটিই খেলত। পুরো আসরে সব মিলিয়ে ১৩ ম্যাচে ৫৫টা সেভ করেছেন কোর্তোয়া। প্রিমিয়ার লিগের এই মৌসুমে ৩৯ ম্যাচ খেলে চ্যাম্পিয়ন দল ম্যানসিটির গোলকিপার এদেরসন মোরায়েস সেভ করেছেন কোর্তোয়ার চেয়ে মাত্র দুটি বেশি শট। ভাবা যায়!

সেই এদেরসন, যে এদেরসনকে আধুনিক গোলকিপারের মানদণ্ডে বেশ উঁচু স্থানেই রাখা হয়। বর্তমান সময়ে যেকোনো ক্লাবই এমন গোলকিপার চায়, যিনি শট আটকানোর ক্ষেত্রে দুর্দান্ত হওয়ার পাশাপাশি বাড়তি একজন ডিফেন্ডার হিসেবে পেছন থেকে পাস দিয়ে আক্রমণ গড়ে তুলতে পারেন, বল যখন দলের পায়ে থাকে তখন ওপরে উঠে আসার মাধ্যমে দলের রক্ষণভাগকে ‘হাই লাইন’ কৌশল বাস্তবায়ন করায় সহায়তা করেন, বল পায়ে একজন মিডফিল্ডারের মতোই দক্ষ থাকেন। এদেরসনের পাশাপাশি লিভারপুলের আলিসন বেকার, বায়ার্নের ম্যানুয়েল নয়্যার, বার্সেলোনার মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগেন, চেলসির এদুয়ার্দ মেন্দি— প্রত্যেকে গোল আটকানোর পাশাপাশি এই কাজে দক্ষ।

কোর্তোয়া অবশ্য কখনই পেছন থেকে ছোটবড় নিখুঁত পাসের বুননে আক্রমণ গড়ে তুলতে নয়্যার বা এদেরসনদের মতো অতটা কুশলী ছিলেন না। সে কারণেই কি না, বর্তমান সময়ে সেরা গোলকিপারের তালিকার ওপরের দিকে অনেকেই কোর্তোয়াকে রাখতে চান না। বিশ্বখ্যাত ক্রীড়া ম্যাগাজিন ‘ফোর ফোর টু’-ই যেমন, বর্তমান সময়ের সেরা গোলকিপারের তালিকায় সেরা দশেও রাখেনি কোর্তোয়াকে। লিভারপুলের বিপক্ষে গত রাতের ম্যাচের আগেও কোর্তোয়ার এই খামতি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিল।

কোর্তোয়াকে প্রেস করলে ভেঙে পড়েন, প্রেসে ভেঙে পড়ে ছোট পাস না দিয়ে লম্বা কিক নিয়ে বলের দখল হারিয়ে ফেলেন, আক্রমণ রচনা করতে পারেন না পেছন থেকে – কোর্তোয়ার ‘সুইপিং কিপিং’ নিয়ে প্রশ্ন ছিল অনেক। সালাহ-মানেরা কোর্তোয়ার এই দুর্বলতার ফায়দা লুটতে পারলে লিভারপুলের হাতে জয় ধরা দেবে, মনে করা হচ্ছিল এমনটাই। এমনকি গত রাতেও বেশ কিছু মুহূর্তে মানে বা সালাহর প্রেসিংয়ে পেছন থেকে ছোট পাস না দিতে পেরে লম্বা কিক দিয়ে থ্রো-ইন হজম করেছেন, বা বলের দখল হারিয়েছেন।

তাতে অবশ্য নব্বই মিনিট পর রিয়ালের কিছু আসে যায়নি। কোর্তোয়া দেখিয়েছেন, এই আধুনিক যুগেও একজন গোলকিপারের শট আটকানোর দক্ষতাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিরোপা জেতার জন্য একজন গোলকিপারের দুটো হাত থাকলেই হয়। প্রেস এড়িয়ে ফাঁকায় থাকা সতীর্থকে ছোট পাস দেওয়া, আক্রমণ গড়ে দেওয়া, বল পায়ে দক্ষতা, ‘সুইপিং কিপিং’—এসব দক্ষতা একজন গোলকিপারের বাড়তি ‘অলংকার’, আসল দক্ষতা তো গোল কীভাবে হাত দিয়ে আটকাতে পারছেন, সেটা।

যে দক্ষতাটা একজন গোলকিপারের প্রথম পাঠ। আদি ও অকৃত্রিম গুণ। সব সময় সেটাই ছিল, সব সময় সেটাই থাকবে।


Posted

in

by

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *