মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের টেলিভিশন বিতর্ক একে অন্যকে লক্ষ্য করে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ করেছেন দুই প্রধান প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চার বছরের মধ্যে এই প্রথম তারা আগামী ৫ই নভেম্বরের নির্বাচন সামনে রেখে একে অন্যের মুখোমুখি হলেন।
পররাষ্ট্র নীতি, অর্থনীতি, সীমান্ত ইস্যু, সামাজিক নিরাপত্তা, চাইল্ড কেয়ার, কংগ্রেস ভবনে হামলার ঘটনা এবং গর্ভপাতসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলার সময় তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলার অভিযোগ আনেন এবং পরস্পরকে তীব্র বাক্যবাণে জর্জরিত করার চেষ্টা করেছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনীতি সামলানো, পররাষ্ট্র নীতির রেকর্ড ও ব্যাপক সংখ্যক অভিবাসীর বিষয়ে মি. বাইডেনের তীব্র সমালোচনা করেন।
অন্যদিকে, আদালতে সম্প্রতি মি. ট্রাম্পের সাজার প্রসঙ্গ তুলে তাকে ‘গণতন্ত্রের জন্য হুমকি’ বলে উল্লেখ করেন মি. বাইডেন।
বিতর্কে মি. ট্রাম্প শেষ করেছেন এই বলে যে আমেরিকার মানুষ এখন জাহান্নামে বাস করছে। “সাড়ে তিন বছর ধরে আমরা জাহান্নামে বাস করছি”।
অন্যদিকে, শেষ বক্তব্যে মি. বাইডেন আমেরিকানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন এবং বলেন যে তিনি কর কমিয়ে আনতে চান। একই সাথে দাবি করেন যে ট্রাম্প কর বাড়িয়ে দিবেন।
জো বাইডেন পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আক্রমণ করেন। এর আগে মি. ট্রাম্প সম্প্রতি জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনের বন্দুক আইনে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়টি তুলেছিলেন।
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ডেমোক্র্যাট দলের মি. বাইডেন ও রিপাবলিকান মি. ট্রাম্প পরস্পরের মুখোমুখি হলেন।
বিতর্কে কথা বলার সময় মি. বাইডেনের কণ্ঠ খসখসে শোনাচ্ছিলো। এ নিয়ে তার প্রচার দল বলেছে গত কয়েকদিন ধরে তার ঠাণ্ডা লাগার কারণে কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে।
কে জিতেছে বিতর্কে?
যুক্তরাষ্ট্রের বিবিসির স্পেশাল করেসপন্ডেন্ড কেইটি কে লিখেছেন যে এবারের বিতর্কের ফরম্যাট ছিল আমেরিকানদের জন্য তুলনামূলক ভালো।
তবে সঞ্চালকরা তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করেননি এবং এটা ছিল জো বাইডেনের জন্য একটি খারাপ রাত।
তার অনেক জবাবই পরিষ্কার ছিল না। তাকে বয়স্ক মনে হচ্ছিলো। তবে বিতর্কের দ্বিতীয় ধাপ তার জন্য কিছুটা ভালো ছিল এবং তিনি কিছুটা শক্তি পেয়েছিলেন। তবে এটি হতে হতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো।
বিতর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতেছেন। কিন্তু এটি কি তাকে নির্বাচনে জিততে সহায়তা করবে?
পর্যবেক্ষকরা কী বলছেন?
রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের যারা মনোযোগ দিয়ে বিতর্ক দেখেছেন তারা অনেকেই তাদের প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
সাবেক ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসওম্যান স্টেফাইন মারফি বিবিসিকে বলেছেন কিছু মুহূর্ত ছিল যেখানে মি. বাইডেন তার বয়স তুলে ধরেছেন।
“তাকে বোঝাটা কষ্টসাধ্য ছিল।”
কিন্তু অন্যদিকে তার মতে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছু মন্তব্য করেছেন যা ‘সত্যি নয়’ এবং এগুলো সত্যতা যাচাই করা উচিত। তিনি বলেন তার উদ্বেগের জায়গা হলো নির্বাচনের ফল গ্রহণ করবেন কি না তা বলতে ডোনাল্ড ট্রাম্প অনীহা দেখিয়েছেন।
সাবেক রিপাবলিকান কংগ্রেসওম্যান রোডনি ডেভিস বলেছেন বিতর্কটি ছিল ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিষ্কার জয়’।
“আমেরিকাজুড়ে ডেমোক্র্যাটদের জন্য দুঃখজনক বিতর্কের ধরনটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সহায়তা করেছে,” বলেছেন তিনি।
বিবিসির ম্যাডেলাইন হ্যালপার্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর কোরউইন স্মিডট বলেছেন যে বাইডেন তার অনেক দুর্বলতা দেখিয়েছেন এবং খুব বেশি শক্তির জায়গা দেখাননি।
ভিজ্যুয়াল, কণ্ঠ ও জবাব দেয়ার গতির কারণে তাকে অনুসরণ করাটা কঠিন ছিল।
“অনেক তথ্যভিত্তিক জবাব ও পয়েন্ট প্রেসিডেন্ট বাইডেন দিয়েছেন। কিন্তু বলার ধরনের কারণে সেগুলো দ্রুত হারিয়ে গেছে,” বলছিলেন তিনি।
ট্রাম্পের পারফরমেন্স থেকেও অনেক বেশি শক্তির জায়গা পাওয়া যায়নি এবং তিনিও কিছু দুর্বলতা প্রদর্শন করেছেন, বলেছেন তিনি।
“প্রশ্নের জবাবে তার উত্তরগুলো দৃঢ় ছিল না। কিন্তু উত্তরগুলো তার ভোটারদের কিছু উদ্বেগ ও ইস্যুকে স্পর্শ করে গেছে,” বলছিলেন প্রফেসর স্মিডট।
“তার সমর্থকরা তাকে চার বছর আগের প্রার্থীর মতোই দেখতে চায়”।
ট্রাম্প নির্বাচনের ফল মানবেন?
বিতর্ক পরিচালনাকারী সিএনএন এর সঞ্চালক মি. ট্রাম্পের কাছে দুবার জানতে চান যে নির্বাচনে যে-ই জিতুক তিনি ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফল মানবেন কি না।
তিনি বারবার প্রশ্নটি উপেক্ষা করছিলেন, বরং রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে চলে যাচ্ছিলেন।
এরপর আবারো তাকে প্রশ্নটি করা হয়।
জবাবে মি. ট্রাম্প বলেন, “যদি এটি সুষ্ঠু, আইনগত ও ভালো নির্বাচন হয় তাহলে অবশ্যই”। একই সাথে তিনি ২০২০ সালের নির্বাচন নিয়ে তার বড় ধরনের কারচুপির অপ্রমাণিত দাবির পুনরাবৃত্তি করেন।
প্রার্থীদের বয়স প্রসঙ্গ
মি. বাইডেনকে তার বয়স সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় যে তিনি যখন দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করবেন তখন তার বয়স হবে ৮৬। তিনি হবেন সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট জবাবে বলেন একসময় তিনি সবচেয়ে কমবয়সী আইনপ্রণেতা বলে সমালোচনার শিকার হতেন এবং ট্রাম্প “তিন বছরের ছোট এবং অনেকটাই কম যোগ্য”।
“রেকর্ড দেখুন। দেখুন তিনি যে ভয়ানক পরিস্থিতি রেখে গিয়েছিলেন সেখান থেকে কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছি,” বলছিলেন মি. বাইডেন।
অন্যদিকে মি. ট্রাম্পকে বলা হয় যে তার বয়স এখন ৭৮ এবং দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে তা হবে ৮২ বছর।
জবাবে ট্রাম্প বলেন তার স্বাস্থ্য ভালো এবং তিনি এ সময় গলফ খেলার প্রসঙ্গও টেনে আনেন।
“তিনি এটা করেন না। তিনি ৫০ গজ দূরেও বল পাঠাতে পারেন না,” ট্রাম্প বলছিলেন। “আমার মনে হয় আমি ২৫-৩০ বছর আগের মতোই ভালো অবস্থায় আছি। সত্যি বলতে, আমি এখন আরও উজ্জ্বল।”
শিশু যত্নের খরচ প্রসঙ্গ
শিশু যত্নের খরচ মেটানোর সক্ষমতা নিয়ে মি. ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো খরচ কমিয়ে আনতে তিনি কী করবেন। এর উত্তরে মি. ট্রাম্প যথারীতি যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত ইস্যু টেনে এনে মি. বাইডেনের তীব্র সমালোচনা করেন।
পাল্টা আক্রমণ করে মি. বাইডেন বলেন যে ট্রাম্প হলেন ‘আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ প্রেসিডেন্ট’। এরপর তিনি বলেন শিশু যত্নের খরচ কমাতে মি. ট্রাম্প খুব কম ব্যবস্থাই নিয়েছিলেন।
পরে মি. ট্রাম্প তিনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে কী করেছেন সেটি তুলে ধরেন।
“তারা আমাকে সবচেয়ে ভালো মনে করে এবং আমি যদি আরও চার বছর পাই তাহলে আমি আমার সেরাটাই দিবো,” যোগ করেন তিনি।
‘বীরেরা রাস্তায় বাস করছে’
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন তিনি জো বাইডেনের মতো আর কাউকে ‘এতো মিথ্যা’ বলতে দেখেননি এবং ভেটেরান অর্থাৎ আমেরিকার সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক সদস্যদের বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগ তুলে সমালোচনা করেন মি. বাইডেনের।
“তিনি (বাইডেন) যাই বলছেন সব মিথ্যে,” বলছিলেন তিনি।
এ পর্বেও মি. ট্রাম্প সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়ার অভিযোগ করেন মি. বাইডেনের বিরুদ্ধে এবং বলেন “লাখ লাখ মানুষ” পাবলিক পেনশন স্কিমে যোগ হতে যাচ্ছে।
“তারা ভেটেরান অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্ট ও আমাদের ভেটেরানদের সাথে যা করেছে তা অবিশ্বাস্য,” বলছিলেন তিনি।
“আমাদের বীরেরা এখন রাস্তায় বাস করে। আর এইসব লোকেরা (অভিবাসী) থাকে বিলাসবহুল হোটেলে”। বিবিসি বাংলা
মন্তব্য করুন