বাংলাদেশে আগের সব জাতীয় নির্বাচনের মতো এবারও নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় সক্রিয় থাকবে সেনাবাহিনী। তেসরা জানুয়ারি থেকে দশই জানুয়ারি পর্যন্ত তিনশো নির্বাচনী আসনের সবকটিতেই সেনাবাহিনীর উপস্থিতি থাকবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনকে ঘিরে পুলিশ, আনসার, র্যাব, বিজিবি’র মতো বাহিনীগুলোর সাথেই দায়িত্ব পালন করবে সেনাবাহিনী। অতীতেও নির্বাচনের সময় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে সেনাবাহিনী ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে কাজ করেছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, নির্বাচনকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বেসামরিক বাহিনীগুলো সক্রিয় থাকার পরও কেন সেনাবাহিনীকে নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করার জন্য আহ্বান করা হয়? তাদের দায়িত্বের আওতাই বা কতটুকু?
সেনাবাহিনী কী করতে পারবে, কী পারবে না
নির্বাচন কমিশন বলছে, ‘স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনকে’ সহায়তা করার জন্য ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় সশস্ত্র বাহিনীকে নির্বাচনী দায়িত্বে মোতায়েন করা হবে।
“রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের সাথে পরামর্শ করে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে সেনাবাহিনী”, বলছিলেন নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাঙ্গীর আলম।
“তারা (সেনাবাহিনী) নির্বাচনী আসনের বিভিন্ন নোডাল পয়েন্টে অবস্থান করবে। কোনও সংকটের ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে তারা ঘটনাস্থলে যাবে। এরপর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ অনুযায়ী তারা কাজ করবে”, জানাচ্ছেন তিনি।
কোন আসনের কোথায় এবং কতগুলো ‘নোডাল পয়েন্ট’ থাকবে, তা নির্ধারণ করবেন আসন সংশ্লিষ্ট স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, পুলিশ সুপার সহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা নির্ধারণ করবেন সেনাবাহিনী কোথায় অবস্থান করবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্বাচনী আসনগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ, অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সাধারণ – এই তিন ভাগে ভাগ করেছে।
ভোট কেন্দ্রে বড় ধরনের গোলযোগ যদি পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসন সামাল দিতে না পারে তখন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে যাবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ অনুযায়ী সেখানে পদক্ষেপ নেবে।
সিআরপিসি’র দণ্ডবিধি অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী বল প্রয়োগ থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলছিলেন, “যদি ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার একটি রাস্তা কেউ বন্ধ কর রাখে, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী সেখানে যাবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বুঝিয়ে বা বল প্রয়োগ করে সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ব্যবস্থা করবে।”
আইন অনুযায়ী, নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর সাথে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকায় ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে তারা প্রয়োজনে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারে।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকলেও সেনাবাহিনী কোনও ঘটনায় মামলা করতে পারবে না বলে জানান নির্বাচন কমিশন সচিব মি. আলম।
কেন সেনাবাহিনী মোতায়েন?
এবারের নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে না বলে অন্যান্য বারের তুলনায় সহিংসতার সম্ভাবনা কম বলে ধারণা করা হচ্ছে। কাজেই নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক।
আবার অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, অন্য যে কোনও নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হত, কমিশন সেরকমভাবেই নির্বাচনের প্রস্ততি নিচ্ছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন, “সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন আছে না নাই সেটি এখানে বিষয় নয়। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে কমিশন যা যা করতো, ঠিক তাই করছে এই নির্বাচনের ক্ষেত্রেও।”
পাশাপাশি, সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার মনে করছেন যে নির্বাচনের পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার মাধ্যমে কমিশন আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকেও একটি বার্তা দিতে চাইছে।
“এই নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন কমিশনের ওপর যে আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে, তা সিইসি নিজেই বলছেন। হয়তো তারা আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকে বলার চেষ্টা করছেন যে সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আমরা সব সতর্কতা মেনে পালন করেছি। তারা হয়তো একটা বার্তা দিতে চাচ্ছেন যে, সংবিধান অনুযায়ী আমরা আমাদের কাজে গাফিলতি করি নাই”, বলছিলেন সাখাওয়াত হোসেন।
অর্থাৎ, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে যেন সমালোচনা বা প্রশ্ন তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করতে কমিশন যথাযথ প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে করেন মি. হোসেন।
তার মতে, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের আরেকটি বড় কারণ বাংলাদেশের মানুষের কাছে সেনাবাহিনীর ‘ভাবমূর্তি’।
বাংলাদেশের মানুষ সেনাবাহিনীকে ‘নিরপেক্ষ’ বাহিনী হিসেবে মনে করে এবং তাদের উপস্থিতিতে মানুষ ‘নিরাপত্তার বিষয়ে আস্থা’ পায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলোর বিচারে বাংলাদেশে কোনো রিজার্ভ ফোর্স না থাকার কারণে নির্বাচনের মত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন জরুরি হয়ে পড়ে বলে মনে করেন তিনি।
“ভারতে সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ, সিআরপি নামে আলাদা ফোর্স আছে। নির্বাচনের সময় তারা প্রাদেশিক পুলিশের চেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে এবং তারা সরাসরি নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে আসে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পুলিশ ফোর্স নির্বাচন পরিচালনাকারী সরকারের অধীনে থাকে।”
তাই এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ এবং ‘নিরপেক্ষ’ ভাবমূর্তির জন্যই তাদের নির্বাচনী দায়িত্বে মোতায়েন করা হয় বলে বলছিলেন মি. হোসেন।
“১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বেশি সংখ্যক পুলিশ ছিল না। অন্যান্য বাহিনীতেও যথেষ্ট পরিমাণ সদস্য ছিল না। তাই জনবল বাড়ানোর জন্য সেসময় সেনাবাহিনীকে ডাকা হয়েছিল।”
“এরপর ১৯৯১ সালের আগ পর্যন্ত সব নির্বাচনই হয়েছে সেনা সমর্থিত প্রশাসনের অধীনে। স্বাভাবিকভাবেই সেসব নির্বাচনে সেনা উপস্থিতি ছিল”, জানাচ্ছেন তিনি।
আগের নির্বাচনগুলোর ঐ ধারাই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অনুসরণ করা হয় এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় বলে মন্তব্য করেন মি. সাখাওয়াত হোসেন।
এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির ‘একতরফা নির্বাচন’-সহ সে বছরের ১২ই জুন ও ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর হওয়া নির্বাচনেও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল।
এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিতই হয় সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
২০১৪ সালে পরের নির্বাচনে মোট ১৫ দিনের জন্য নিয়োজিত হয়েছিল সেনাবাহিনী।
সবশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় ৩৮৮টি উপজেলায় ৩৫ হাজারেরও বেশি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। বিবিসি
বাংলা সংবাদের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
মন্তব্য করুন