শেখর দেব জয়

মানুষের জন্য ভালো কিছু করলে আমার গর্ব হয়: শেখর দেব জয়

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রিয়মুখ, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, মা ইমপোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট এর স্বত্বাধিকারী, সমাজসেবক শেখর দেব জয় সম্প্রতি মিশিগানে বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর বাংলা সংবাদের সাথে এক আলাপচারিতায় মিলিত হন। সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে ধরা হলো-

আপনার জীবনে তিনটি সঠিক সিদ্ধান্ত কি ছিল?
আমার জীবনের প্রথম সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল বিবাহ করা। আমি একজন বুদ্ধিমতী এবং বন্ধুসুলভ স্ত্রী পেয়েছি। যেটা আমার জীবনে অনেক বড় পাওয়া। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হচ্ছে আমার দাদার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। বড় ভাইয়ের সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ গড়ে তোলার ফলে বিজনেসটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। আমার তৃতীয় সঠিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে মানুষকে সহযোগিতা করা।

আপনার জীবনের কোন দিকটা নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন?
আমি সব সময় আমার সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষকে সাহায্য করেছি এবং এখনো করছি‌। আমার জীবনের এই দিকটা নিয়ে আমি খুব সন্তুষ্ট। এটা আমাকে মানসিক প্রশান্তি দেয়‌। আমি অনেক অর্থ আয় করেছি, তা আমি সাথে নিয়ে যেতে পারবো না। এই অর্থ দিয়ে যদি মানুষের উপকার হয় তাহলেই আমি মানসিক সন্তুষ্টি অনুভব করি।

আপনার জীবনের এই পর্যায়ে এসে এখনো কি নিয়ে অনুশোচনা করেন? আপনার কি এমন ভাবনা হয় যে, কোন একটি সিদ্ধান্ত না নিলে হয়তো আরও ভালো অবস্থানে থাকতে পারতেন। অথবা এমন কী ব্যর্থতা আছে যেখান থেকে আপনি কিছু শিখেছেন বলে মনে করেন?

জীবন থেকে যেটা দেখেছি সেটা হলো, আপনি যদি ভবিষ্যতের জন্য কিছু করতে চান তাহলে সেটা অবশ্যই অল্প বয়সে অর্থাৎ তরুণ বয়সে শুরু করা উচিত। সেক্ষেত্রে ২৫ বছরের আগেই শুরু করলে ভালো হয়। বর্তমান প্রযুক্তিবান্ধব পৃথিবীতে অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এখন যে কেউ চাইলে অনেক কিছু সহজেই জানতে পারে।

জীবনে চলার পথে ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছি। সেগুলো সব সময় সাফল্যের মুখ দেখেনি। কিন্তু আমি সেখান থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তবে অনুশোচনার বিষয়ে বলা আমার জন্য খুবই কঠিন। কারণ আমি এ পর্যন্ত যত রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেগুলো বাস্তবায়ন করার আগে আমি অনেক গবেষণা করেছি। যার ফলে আমার গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো প্রায় ৯৫% সাফল্যের মুখ দেখেছে। সে ক্ষেত্রে আমার ব্যর্থতার জায়গাটা খুবই কম। তারপরও আমি যতটুকু ব্যর্থ হয়েছি, সেখান থেকে আমি শিখেছি।

যদিও আমি শতভাগ সফল নই, তারপরও আমার জীবন সম্পর্কে কোন অনুশোচনা নাই। আমি খুব সতর্কতার সাথে যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। আমি এমন নয় যে হঠাৎ করে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম এবং সেই কাজটি করতে শুরু করলাম। আমি যেটা করি সেটা হলো কোন কিছু করার আগে আমি সে বিষয়টাকে ভালো করে গবেষণা করি। আর নিজেকে সেখানে কতটুকু যোগ্য, সেই বিষয় বিবেচনা করি। এরপর আমি ঐ কাজটি শুরু করি। আপনি যদি আপনার নিজের প্রতি, নিজের সমাজের প্রতি, নিজের প্রতিষ্ঠানের প্রতি, নিজের কর্মীদের প্রতি সৎ থাকেন, তাহলে আপনার গৃহীত পরিকল্পনা অবশ্যই সাফল্যের মুখ দেখবে। আমার কোম্পানিতে যারা কাজ করে তারা সবাই একই পরিবারের সদস্য হয়ে সততা চর্চার মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করছে। আমরা সকলের সুবিধা-অসুবিধা, দুঃখ কষ্টগুলো পারস্পরিকভাবে ভাগাভাগি করে নেওয়ার ফলে আমাদের যেকোন পরিকল্পনা সাফল্যমন্ডিত করতে সহজ হয়। এজন্য অনুশোচনা নয় বরং আনন্দের সাথে আমরা একত্রে কাজ করি।

একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে তরুণদের প্রতি আপনার ব্যবসায়িক উপদেশ কি?
আমার জীবন থেকে যেটা দেখেছি সেটা হলো, আপনি যদি ভবিষ্যতের জন্য কিছু করতে চান তাহলে সেটা অবশ্যই অল্প বয়সে অর্থাৎ তরুণ বয়সে শুরু করা উচিত। সেক্ষেত্রে ২৫ বছরের আগেই শুরু করলে ভালো হয়। বর্তমান প্রযুক্তিবান্ধব পৃথিবীতে অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এখন যে কেউ চাইলে অনেক কিছু সহজেই জানতে পারে। আমিতো সেই ১৪ বছর থেকে কিছু করার জন্য ভাবছিলাম। এরপর ১৯ বছর থেকেই গুরুত্বসহকারে ব্যবসা শুরু করেছিলাম।

আপনি ৩১৩ গোল্ডকাপ আয়োজন করেছিলেন। সে সম্পর্কে কিছু বলুন?
আমি ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী। এখনো বিভিন্ন রকম খেলায় অংশগ্রহণ করি। সেই আগ্রহ থেকেই এখন আমি ফুটবল টিম চালু করা ছাড়াও বিভিন্ন রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এর ফলে মিশিগানে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির শিশুরা বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করে তাদের মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে পারছে। ৩১৩ গোল্ডকাপ আমাদের প্রথম আয়োজন। বিপুল সংখ্যক ফুটবলপ্রেমী দর্শকের উপস্থিতিতে গত ২৯ আগস্ট ৩১৩ গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা আরডেন এভিনিউস্থ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়।

ফাইনাল খেলায় মিশিগান ইউনাইটেড ৩-১ গোলে ইন্টার মিশিগানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। গত ৭ আগষ্ট শুরু হওয়া এই গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ৮টি দল অংশগ্রহণ করে। দলগুলো হচ্ছে ওয়ারেন এফসিবি, মিশিগান ইউনাইটেড এফসি, ব্লেজিং টাইগার এফসি, সিলেট ইউনাইটেড এফসি, ইন্টার মিশিগান, ব্রাদার্স এফসি, ডেট্রয়েট এভেঞ্জার্স এবং ওয়ারেন এফসিএ। টুর্নামেন্টের প্রত্যেকটি টিম মিশিগানের ছিল। চ্যাম্পিয়ন দলকে ট্রফিসহ ৩ হাজার ডলার এবং রানার্সআপ দলকে এক হাজার পাঁচশ ডলার পুরস্কার দেওয়া হয়।

প্রথমবারের মত এই গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন হওয়ায়, আমরা শুধুমাত্র মিশিগান থেকে নিয়েছিলাম। অন্যান্য রাজ্য থেকে এসেছিল কিন্তু আমাদের আয়োজন সীমিত পরিসরে থাকার কারণে তাদেরকে নিতে পারিনি। তবে পরবর্তীতে আমরা যখন আয়োজন করব, তখন সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। অর্থাৎ যে কেউ তাদের টিমকে নিয়ে এই গোল্ডকাপে অংশগ্রহণ করতে পারবে।

আপনার বর্তমান ব্যস্ততা সম্পর্কে জানাবেন।
আমার ব্যবসা এবং পরিবার নিয়ে আমি আপাতত ব্যস্ত আছি। আমার এক ছেলে এবং এক মেয়ে আছে। তাদেরকে নিয়ে আমার ছোট সংসার। আমার স্ত্রীর নাম বৈশালি দেব। আমার মেয়ের নাম হচ্ছে সামিক্ষা দেব, এবং ছেলের নাম হচ্ছে রাজবি দেব।

কমিউনিটির প্রতি আপনার কি বলার আছে?
আমাদের কমিউনিটিকে আরো কিভাবে ভালো করতে পারি, সেই বিষয়ে আমাদের সকলের আন্তরিক ভাবে একত্রে কাজ করা উচিত। আমাদের কমিউনিটিতে অনেকেই আছে যারা খুবই উচ্চ শিক্ষিত এবং কমিউনিটির উন্নয়নে কাজ করতে চায়। তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। তাদেরকে সাথে নিয়ে কমিউনিটির কল্যাণে আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

আপনার ব্যবসা কি শুধু মিশিগান কেন্দ্রিক। না অন্যান্য রাজ্যেও ব্যবসা করে থাকেন?
আমি মিশিগান কেন্দ্রিক হলেও সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রেই ব্যবসা করে থাকি। টেক্সাস, নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি, ইন্ডিয়ানা, শিকাগো, ক্যালিফোর্নিয়াসহ অন্যান্য রাজ্যেও নিজস্ব পরিবহনের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করে থাকি।

আপনার কি কি ব্যবসা আছে?
বর্তমানে আমার সব থেকে জনপ্রিয় ব্যবসা হল দেশি মার্কেট। যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়। এছাড়া দেশি মাসালা রেষ্টুরেন্ট, মা ইমপোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট, এটিএম পাসিং, রিয়েল স্টেট ইনভেস্টর বিজনেস রয়েছে। শীঘ্রই বৃহত্তম ইনডোর স্পোর্টস কমপ্লেক্স এর যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছি। এখানে টেনিস, ব্যাডমিন্টন, সকার, বাস্কেটবলসহ অন্যান্য খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকবে। শিশুদের খেলার জায়গা এবং সুইমিং পুলও থাকবে।

আপনার ব্যবসা শুরুর গল্প জানতে চাই?
ভালো সুযোগ সুবিধার জন্য আমি আমার পরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে মিশিগানের হ্যামট্রামিক শহরে চলে আসি। ২০০২ সালে আমি একাউন্টিং-এ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সক্রিয়ভাবে ব্যবসা শুরু করি। তবে পড়াশোনার পাশাপাশি আমি টুকটাক ব্যবসা করতাম। আমি প্রথমে গ্যাস স্টেশন ব্যবসা শুরু করি। এরপর কিছুদিন রিয়েল এস্টেট ব্যবসা করার পর আমি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রির ব্যবসা শুরু করি। দেশি মার্কেটের যাত্রা শুরু হয় ২০১৪ সালে।

এরপর ২০১৮ সালে আমি পাইকারি ব্যবসা শুরু করি। পাশাপাশি আমি আমদানি করতে শুরু করি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ফ্যাক্টরি স্থাপন করে আমদানি প্রক্রিয়াকে আরো সম্প্রসারণ করি। বর্তমানে মিশিগানের সর্ববৃহৎ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানিকারক হিসেবে বাংলাদেশ, বার্মা, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পণ্য আমদানি করছি।

আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
দেখুন আমি একজন কর্ম প্রিয় লোক। আমি সবসময় কাজ করতে ভালোবাসি। আগামী ৫ বছর আমি এই কাজের মধ্যেই থাকবো। কারণ আমি আমার কাজকে খুব উপভোগ করি। পাশাপাশি আমার কমিউনিটির জন্য আরো ভালো কিছু করার পরিকল্পনা রয়েছে। আপনারা জানেন আমি ইতিমধ্যেই কমিউনিটির কল্যাণে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি এবং যেগুলো চলমান আছে। এই ধরনের কার্যক্রম ভবিষ্যতে আরও বাড়াতে চাই।

বাংলা সংবাদ পত্রিকা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
আমি সবসময় যারা কিছু ভালো কিছু করে তাদের পাশে থাকতে চাই। বাংলা সংবাদ পত্রিকা কমিউনিটির কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। আমি এই ধরনের কাজকে অবশ্যই প্রশংসা করি। আমি বাংলা সংবাদ পত্রিকার একজন নিয়মিত পাঠক। বাংলা সংবাদ কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠান কাভার করে। এটি খুবই ভালো একটা উদ্যোগ।

আমাদের প্রত্যেকের কমিউনিটির সাথে এভাবেই কাজ করে যাওয়া উচিত। যখনই আমি কাউকে কমিউনিটির জন্য ভালো কিছু করতে দেখি, তখন আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি। এমন নয় যে আমি সবকিছু জানি। আমি প্রতিনিয়ত জানার-শেখার চেষ্টা করে থাকি।

আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য বাংলা সংবাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ

আরও পড়ুনঃ উন্মুক্ত হলো স্কাই ব্রিজ