ফিলিস্তিনের শিরিন: কে তবে মরে গেল… কে?

সেই সুন্দর, আত্মবিশ্বাসী আর সাহসী মানুষটির কণ্ঠ আর শোনা যাবে না। ফিলিস্তিনিদের সব শোক আর সংগ্রামের খবর তিনি এভাবেই শেষ করতেন: শিরিন আবু আকলেহ, আল-জাজিরা, ফিলিস্তিন। ইসরায়েলি সেনারা তাঁকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে। জেনিনের ফিলিস্তিনি শরণার্থীশিবিরে ইসরায়েলিদের অভিযানের সংবাদ জানানোর সময়, ‘প্রেস’ লেখা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আর হেলমেট পরা অবস্থায় একটি গুলিতেই নিহত হন তিনি। ২০০০ সালের পর থেকে ইসরায়েলিদের হাতে নিহত ৪০তম সাংবাদিক শিরিন।

ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের কবিতা সত্য হয়ে উঠছে আজ। তিনি লিখেছিলেন, আমার শোক মিছিলে সর্বদাই আমি আগাম হাজির: কে তবে মরে গেল…কে? শিরিনের শোক মিছিলে, তাঁর কফিনের পেছনে যারা হাঁটা শুরু করেছে, তাদের হাতে মোমবাতি, বুকের কাছে ধরা শিরিনের ছবি। এই শোকের মিছিল হয়তো পরিণত হবে বিরাট ইন্তিফাদায়, পরিণত হবে গণবিদ্রোহে। তাদের সবার মনের মধ্যে জ্বলে উঠবে শিরিনের আত্মদানের স্মৃতি। এত দিন শিরিন তাদের কথা বলেছেন, এখন তারা সবাই বলছে শিরিনের কথা। কে তবে মরে গেল…কে?

ফিলিস্তিনিদের প্রতিটি ঘরে আজ কান্না। স্বজন হারানোয় অভ্যস্ত ফিলিস্তিনিরা। তবু তাদের শোকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে আরও বড় কিছু। আমি জানি না কী এর নাম। হয়তো এর নাম সংকল্প, হয়তো এর নাম সুবিচারের জন্য মরণপণ প্রতিজ্ঞা। হয়তো এর নাম শহীদের প্রতি ভালোবাসা।

২৫ বছর ধরে আল-জাজিরার হয়ে ফিলিস্তিনের খবর বিশ্বকে জানাতেন সাংবাদিক শিরিন। ফিলিস্তিনের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে তিনি পা রাখেননি। যেখানেই ইসরায়েলি সন্ত্রাস, বুলডোজার, গণহত্যা; সেখানেই পাওয়া যেত তাঁকে। টেলিভিশন সাংবাদিকতা দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সব ফিলিস্তিনির ঘরের মানুষ। প্রতিটি আরব পরিবার তাঁর নাম জানে। ফিলিস্তিনি বালক জালাল আবুখাতের সাত বছর বয়সেই ঠিক করে ফেলেছিলেন, ‘বড় হয়ে আমি শিরিনের মতো হব।’ সেই বালক সত্যিই বড় হয়ে শিরিনের পাশে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতা করে যাচ্ছিলেন।

এই শুক্রবার শিরিনকে সেখানেই শেষশ্রদ্ধা জানানো হবে, যেখান থেকে চিরবিদায় নিয়েছিলেন ইয়াসির আরাফাত। ইসরায়েলি চেকপয়েন্ট ডিঙিয়ে চতুর্দিক থেকে মানুষ আসবে কণ্ঠে ‘শিরিন’ ডাক নিয়ে। শহীদের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে বড় কোনো অমরত্ব নেই। কে তবে মরে গেল…কে?

শিরিন শান্ত কণ্ঠে তথ্যকে করে তুলতেন নিরপেক্ষ, সাংবাদিকতার বয়ানকে করে তুলতেন বিশ্বাসযোগ্য। নির্মম সত্য বলার সময়ও বোঝা যেত না তিনিও একজন নির্যাতিত ফিলিস্তিনি। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ফিলিস্তিনের কণ্ঠস্বর, যুদ্ধ সাংবাদিকতার আদর্শ মানুষ, আরব সাংবাদিকতা জগতের সবচেয়ে পরিচিত ও শ্রদ্ধেয় নাম।

রামাল্লা থেকে গাজা, জেনিন থেকে হাইফায় আজ শোক ও প্রতিবাদের মাতম। শিরিনের মৃত্যুর পর দুদিন হয়ে যাচ্ছে, আল-জাজিরা টিভি চ্যানেল একটানা শিরিনের কাজ, শিরিনের ভিডিও, শিরিন হত্যার তথ্য-প্রমাণ, ফিলিস্তিনিদের শোক, বিশ্বজুড়ে ওঠা প্রতিবাদ দেখিয়েই যাচ্ছে। আল-জাজিরা কাতারের আমিরের মালিকানাধীন টিভি চ্যানেল। ফিলিস্তিন প্রশ্ন ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের আন্তর্জাতিক নীতি আমেরিকার সঙ্গেই মেলানো। শিরিনের মৃত্যু সেই আল-জাজিরাকেও করে তুলেছে আমেরিকার ইসরায়েল নীতির কঠোর সমালোচক। দুদিন ধরে টানা শিরিনকেন্দ্রিক সংবাদ প্রকাশ করে তারা জানিয়ে যাচ্ছে, শিরিনের স্মৃতি কত জীবন্ত, কতটা শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠেছিলেন এই ৫১ বছর বয়সী সাংবাদিক।

রোজার সময়ে, ঠিক ঈদের আগে বরাবরের মতো মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান আল আকসা মসজিদে অভিযান চালায় ইসরায়েলি সেনারা। বহু বছর হলো রক্তপাতহীন ঈদ দেখে না ফিলিস্তিনে। নতুন ফিলিস্তিনি বিক্ষোভের শুরু জেরুজালেম থেকেই। শিরিনের জন্মস্থান এর কাছেই, বেথলেহেমে। এই ছোট্ট শহরেই যিশুর জন্ম। সেখানকারই খ্রিষ্টান পরিবারের সন্তান শিরিন। সেই শিরিনের মৃত্যু বুঝিয়ে দিয়ে গেল, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার আন্দোলন কোনো ধর্মীয় ব্যাপার নয়। হোন তিনি মুসলিম বা খ্রিষ্টান, তা সব ফিলিস্তিনিরই প্রাণের আন্দোলন। জীবনে শিরিন ছিলেন ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের প্রতীক। মৃত্যুতে তিনি হয়ে উঠেছেন গাজা ও রামাল্লায় বিভক্ত ফিলিস্তিনি আন্দোলনের ঐক্যের বন্ধন। রামাল্লায় ফিলিস্তিনিদের দুর্বলচিত্তের অধিকারী প্রেসিডেন্ট যখন শিরিনের কফিনে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলেন, তখন তাঁর পাশে ছিলেন ফিলিস্তিনের শীর্ষ খ্রিষ্টধর্ম পুরুষেরাও।

শিরিনের শোকে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যে ঐক্যের জাগরণ দেখা যাচ্ছে, তাদের দাবিকে যেভাবে দুনিয়ার সামনে ধর্মনিরপেক্ষ চেহারায় হাজির করেছে, যেভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ পশ্চিমা সম্প্রদায়ের নেতারা এর প্রতিবাদ করতে বাধ্য হচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে জীবনের মতো মৃত্যু দিয়েও শিরিন ইসরায়েলি বর্বরতাকে উন্মোচিত করে গেলেন।

শিরিন জন্মসূত্রে ফিলিস্তিনি হলেও নাগরিকতায় আমেরিকান। জন্মভূমির প্রতি কর্তব্যের টান তাঁকে ফিলিস্তিনে ফিরিয়ে এনেছে, দূরে সরিয়েছে উচ্চশিক্ষিত আমেরিকান নাগরিকের লোভনীয় জীবন থেকে। এ রকম একজন মার্কিন নাগরিকের হত্যাকাণ্ড পাশ কাটানো আমেরিকার জন্য কঠিনই বটে। আগামী মাসে ইসরায়েল সফর করার কথা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। অথচ কিনা এখন তাঁকে সমালোচনার সুরে কথা বলতে হচ্ছে পরম মিত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে।

এই মে মাস পর্যন্ত অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনিরা একাই লড়ে যাচ্ছিল আল আকসা মসজিদ অবমাননার বিরুদ্ধে। গাজায় হামাস ব্যস্ত ছিল তাদের ওপর আরোপিত অবরোধ সরানোর এন্তেজামে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস নিজেকে টিকিয়ে রাখা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। শিরিনের হত্যাকাণ্ড তাদের আবার দাঁড় করাচ্ছে প্রতিবাদের সারিতে।

এই মে মাসেই শিরিনের জন্ম। আবার ১৯৪৮ সালের মে মাসের ১৫ তারিখেই ব্রিটিশ মদদে ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূখণ্ড থেকে উচ্ছেদ করেছিল ইসরায়েল। দেশ হারানোর সেই ‘নাকবা’ দিবসের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে শিরিনের শেষকৃত্য। কী রকম মর্মান্তিক, কী রকম অর্থবহ এবং কীরকম এক আশ্চর্য কাকতাল শিরিনের জীবন ও মৃত্যুর ঘটনা।

আধুনিক দুনিয়ায় সবচেয়ে দীর্ঘ স্বাধীনতাসংগ্রামের দাবিদার ফিলিস্তিনিরা। স্বাধীনতার জন্য তাদের জেদ, মাতৃভূমি রক্ষার জন্য তাদের জীবনদান, জেরুজালেমের জন্য তাদের ভালোবাসা এতই অটল যে সাত দশকে সাতটা প্রজন্ম মরে গেলেও তা এখনো চলমান। দেশ থেকে তাড়িয়ে, গণহত্যা করে, খাঁচার মতো ক্যাম্পে আর অবরুদ্ধ জনপদে আটকিয়েও তাদের লড়াকুদের সংখ্যা কমানো যায়নি। ফিলিস্তিনি শিশুরা কখনো বলে না, মা, ‘আমাকে তুই আনলি কেন ফিরিয়ে নে’। বোমা-বারুদ আর মৃত্যুর আবহে নারী-পুরুষের মিলন তবু হয়, সন্তানের আশায়। হায় সন্তান! এত জন্মায় তবু কমে যায় জাতির আকার। ধ্বংসপ্রায় ফিলিস্তিনি জাতিকে টেকাতে, অজস্র মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিতে তাই আরও আরও জন্ম চাই; শহীদদের শূন্যস্থান ভরাট করার জন্য। তার জন্যই বোধ হয় সেখানে তরুণ-তরুণীরা ফি বছর গণবিয়ের অনুষ্ঠান করে। তাদের কেউ বাঁচে কেউ মরে। তখন আরও তরুণ এসে দাঁড়ায়। জন্ম আর মৃত্যুর এ কোন অঙ্ক কষে যাচ্ছে ফিলিস্তিন! কোনো কালো অক্ষর, কোনো সংখ্যা দিয়ে কি সেই হিসাব করা যাবে?

সন্ধ্যার বাতাসে ঝরে যাওয়া জলপাই পাতা তুমি, শিরিন, আলতো করে শয়ান নিলে মাটিতে। কিন্তু মা পৃথিবী জানবে আরও একটি শোকের পাহাড় বসল তার বুকে। ওই মাটি আর ওই মা তোমাকে টেনে নেবে তার মায়ার কন্দরে। ওই বাতাস তোমার সব শহীদ ভাইদের অন্তিম নিশ্বাসের দমক হয়ে আছড়ে পড়বে তোমার কবরে। বিধবা বোনদের হুতাশন মরুর লু হওয়া হয়ে তোমার শিয়রে জানাবে নালিশ। আর পৃথিবীর বুকের হাপর থেকে ঝড় আসবে: ইন্তিফাদা। অযুত অযুত হারানো-খোয়ানো মানুষদের হাড়-পিঞ্জিরার ডুগডুগির তালে বেজে উঠবে জেরুজালেমের সব মিনার, গির্জার সব ঘণ্টা। গলায় রক্ত উগলানো গিরি গর্জনে তারা ডাকবে: শিরিন শিরিন!

তারা তোমাকেই ডাকবে। কেননা তুমিই, তুমিই তো দখলের থাবার নিচে পড়ে থাকা তোমার দেশের কান্না পৃথিবীকে শুনিয়েছিলে।

এই শুক্রবার শিরিনকে সেখানেই শেষশ্রদ্ধা জানানো হবে, যেখান থেকে চিরবিদায় নিয়েছিলেন ইয়াসির আরাফাত। ইসরায়েলি চেকপয়েন্ট ডিঙিয়ে চতুর্দিক থেকে মানুষ আসবে কণ্ঠে ‘শিরিন’ ডাক নিয়ে। শহীদের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে বড় কোনো অমরত্ব নেই। কে তবে মরে গেল…কে?

 

ফারুক ওয়াসিফ লেখক এবং প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *