প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থামানো না গেলে এবং শিল্পক্ষেত্রে পরিবেশ বান্ধব নীতি ও কর্মপদ্ধতি প্রয়োগ না করলে অচিরেই পুরো পৃথিবী অত্যন্ত বিপদজনক পরিস্থিতির কবলে পড়বে।
উষ্ণতা বৃদ্ধি বা বিশ্ব উষ্ণায়ন এখন পৃথিবী নামক গ্রহটির সবচেয়ে বিপদজনক প্রাকৃতিক অসুখ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানুষ উষ্ণায়নের হুংকারের আঁচ তীব্রভাবে অনুভব করছে। বিশ্ব সৃষ্টির পর থেকে এর উষ্ণতা কখনো বেড়েছে কখনো কমেছে, কিন্তু গত কয়েক দশক হতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েই চলছে। এই দশকে দ্রুত প্রভাব পড়তে শুরু করেছে প্রকৃতিতে।
বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলেই বৃদ্ধি পাচ্ছে গড় তাপমাত্রা। জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটিওরোজিক্যাল অর্গানাইজেশন (WMO) বলেছে পৃথিবীর তাপমাত্রা আগামী ৫ বছরে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রীর উপরে উঠে যেতে পারে যা অত্যন্ত ভয়াবহ সংবাদ এই ধরিত্রীর জন্য, বিশেষ করে ২০০০ সালের পর থেকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার চরমভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় বিষয়টি গভীর আশংকাজনক।
আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন জলবায়ুতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চলছে এল-নিনোর প্রভাব যার কারণে তাপমাত্রা কিছু বছর বেশ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের শিল্প উন্নয়নের বিলাসিতা ও প্রতিযোগীতা। শিল্প ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়ে বাতাসের সাথে মিশে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গ্রিন হাউস মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস। পৃথিবীতে বর্তমানে এদের বার্ষিক নির্গমন হার যথাক্রমে ৪১০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), ১৯৬৬ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) ও ৩৩২ পিপিবি।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে নেচার কমিউনিকেশনস একটি গবেষণা নিবন্ধে বলেছে, দিন দিন উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে বাতাসের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা বাড়ার ফলে অতিবৃষ্টির হার বাড়ে ৭ ভাগ, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোনের হার ব্যাপক বেড়ে যায়।
পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লে প্রতি দশকে দুই থেকে তিনবার ভয়ংকর অতিবৃষ্টির কবলে পড়বে পৃথিবী একবার প্রচন্ড খরায় জমি শুকিয়ে যাবে এবং মাটি চারবার উর্বরতা হারাবে। ফলে ৮০ থেকে ৩০০ কোটি মানুষ তীব্র পানি সংকটে পড়তে পারে এবং ২৯ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটতে পারে।
উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৪ সাল সময়কালে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ ইঞ্চি পর্যন্ত বেড়েছে। আবহাওয়া ও প্রকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত ফলে কোথাও অতিবৃষ্টি, কোথাও অনাবৃষ্টি আবার কোথাও তীব্র শীত সহ তুষারপাত হচ্ছে। কিছু মরু এলাকায় শুরু হয়েছে প্রাকৃতিক সবুজায়ন আবার কিছু সবুজ সজীব এলাকায় শুরু হয়েছে মরুকরণ। পানিতে সংক্রমন দেখা দিচ্ছে, জীবজন্তুর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি পড়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠে ফলে সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বে উৎপাদিত গ্রিন হাউস গ্যাসের ৯০ ভাগ শোষণ করে সমুদ্র।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিট ওয়েভ বা তাপ প্রবাহের ঘটনা এর মধ্যেই বেড়েছে ২.৮ গুণ। পৃথিবীর তাপমাত্রা আরো ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লে তা ৯.৪ গুণ বাড়বে। ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৯ সাল এই ৩০ বছরে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে ১৪ দিন, কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৯ এই ১০ বছরে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ২৬ দিন।
গত ৮ মে ঢাকার তাপমাত্রা ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস উঠেছিলো এবং আর্দ্রতা বেশি হওয়ায় তা প্রায় ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মতো অনুভূত হয়েছিলো। এ বছর পুরো এপ্রিল ও মে মাস সারাদেশে তীব্র তাপদাহ বয়ে যায়। এই তাপদাহ পুরো এশিয়া জুড়ে চলছে। এ বছর ভিয়েতনামে ৪৪ দশমিক ২ ডিগ্রী এবং লাওসে ৪৩ দশমিক ৫ ডিগ্রী এবং থাইল্যান্ডে ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস উঠেছে যা দেশগুলোর সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ছুয়েছে।
বিশ্বের উষ্ণায়ন রোধ এবং উষ্ণায়নের প্রভাব ঠেকানোর জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলো এখনো নিত্য নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে, কিন্তু কার্যকরী ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। ১৯৯৭ সালের কিয়োর্টো প্রটোকলে বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি শিল্পোন্নত দেশকে ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা বেধে দেয়া হয় কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেটা হতে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয় বাকি দেশগুলোও লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়।
আশার দিক হলো উষ্ণতা রোধে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন আর সেটাতে বিশাল অর্থ সহায়তার ঘোষণা দিয়ে হাজির হয়েছেন বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের বিল গেটস। তিনি বিখ্যাত হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের প্রজেক্ট Stratospheric Controller Perturbation Experiment (SCoPEx) অর্থ যোগান দিচ্ছেন। এটা এমন এক প্রযুক্তি যার সাহায্যে পৃথিবীতে এসে পড়া অতিরিক্ত সূর্য রশ্মিকে আবার মহাকাশেই ফিরিয়ে দিয়ে পৃথিবীকে শীতল রাখা যাবে।
প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থামানো না গেলে এবং শিল্পক্ষেত্রে পরিবেশ বান্ধব নীতি ও কর্মপদ্ধতি প্রয়োগ না করলে অচিরেই পুরো পৃথিবী অত্যন্ত বিপদজনক পরিস্থিতির কবলে পড়বে যা খুবই দ্রুত পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলকে অসহায় আত্মসমর্পনে বাধ্য করবে।