বিশ্বকাপের ট্রফি তুলে দেওয়ার আগে মেসিকে পরিয়ে দেওয়া হয় আরবের মর্যাদাপূর্ণ পোশাক ‘বিশত’। লম্বা এই পোশাকটি পরা হয় সাদা আলখাল্লার ওপর। তৈরি করা হয় খুবই হালকা সুতা দিয়ে। থাকে খাঁটি সোনার কাজও। আরব বিশ্বে মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয় বিশত। এমন বহু কাজ দিয়ে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ হিসেবে পরিচিত ফিফার কাতার বিশ্বকাপ আলোচিত। পারস্য উপসাগরের ছোট্ট উপদ্বীপ কাতার এ বিশ্বকাপ আয়োজন করতে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে শুরু থেকেই ছিল নানা ধরণের সমালোচনা। কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল আয়োজক সংস্থা ফিফাকেও। কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজন আদৌ সম্ভব কিনা এ নিয়ে ছিল সংশয়। পশ্চিমা বিশ্বের বড় একটি অংশ এর বিরোধিতা করছিল। এমনকি বিশ্বকাপ শুরুর আগেও সমকামিতা, মদপান নিষিদ্ধ, নারীদের পোশাক স্বাধীনতা, বিদেশি শ্রমিকদের মৃত্যুসহ নানা বিষয় সমলোচনা ও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল কাতার প্রশাসনকে। এ সময় অবশ্য কাতারের পাশে থেকে তাদের সমর্থন দিয়েছে ফিফা।
সব বাধা পেরিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ এক বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। বিশ্বকাপের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একের পর এক অভাবনীয় ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ফুটবলবিশ্ব। ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফ্যান্তিনো বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন বিশ্বকাপ উপলক্ষে কাতারে এসে আরব বিশ্বকে আবিষ্কার করেছেন, যা আগে তারা জানতেন না কিংবা মানুষের কাছ থেকে শুনেছেন মাত্র।”
কাতারের গোছানো আয়োজনে মুগ্ধ সকলেই। যে ইউরোপীয়রা কাতার বিশ্বকাপ বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন, তাঁরাও এখন কাতার নিয়ে প্রশংসায় মেতেছেন। এবারের বিশ্বকাপে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। সৌদি আরবের কাছে আর্জেন্টিনার পরাজয়, মরক্কোর কাছে বেলজিয়াম, স্পেন ও পর্তুগালের মতো হেভিওয়েট দলের পরাজয়; জাপানের কাছে স্পেন ও জার্মানির এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে পর্তুগালের পরাজয় ছিল কাতার বিশ্বকাপে আলোচিত, চমকপ্রদ ঘটনা। নকআউট পর্বে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দলের অংশগ্রহণ এ বিশ্বকাপকে জমজমাট করে তোলে।
এছাড়া প্রথমবারের মতো পুরুষদের ফুটবলে কোনো নারী রেফারির অংশগ্রহণ আরবে অনুষ্ঠিত এবারের বিশ্বকাপকে দিয়েছে স্বতন্ত্র এক পরিচিতি। ফিফা প্রধান ইনফ্যান্তিনো বলেন, “সবক’টি মহাদেশ থেকে নকআউট পর্বে অংশগ্রহণ ছিল, যা থেকে আমরা সত্যিকার অর্থে বলতে পারি, ফুটবল প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক হয়েছে। আমি মনে করি, মরক্কোর পারফরম্যান্স ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা, অবিশ্বাস্য। তারা হৃদয় দিয়ে খেলেছে, একই সঙ্গে তাদের দক্ষতাও অনস্বীকার্য। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে কিন্তু ভাগ্যের জোরে ওঠা যায় না।”
২০২২ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বরের এ টুর্নামেন্টের খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হয় কাতারের পাঁচটি শহরের মোট আটটি ভেন্যুতে। এতে অংশ নেয় পাঁচটি কনফেডারেশনের ৩২টি দেশ। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে শিরোপার লড়াইয়ে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স। যাতে শেষ হাসি হাসে মেসির আর্জেন্টিনা। লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে ফ্রান্সকে হারিয়ে আর্জেন্টিনা ফিফা ২২তম বিশ্বকাপ আসরের চ্যাম্পিয়ন হয়। এবার অপেক্ষা ছাব্বিশের। এ বার আর চার বছর নয়, সাড়ে তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। কারণ পরের বিশ্বকাপ ফিরে যাবে সেই জুন-জুলাই মাসেই।
ফুটবল বিশ্বকাপের ৯২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম নিয়ম পরিবর্তন করে নভেম্বর-ডিসেম্বরে মাঠে গড়ায় বিশ্বকাপের আসর। অবশ্য এর পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। জুন-জুলাইয়ের সময়টাতে মরুর দেশ কাতারের আবহাওয়া থাকে উত্তপ্ত। তাই সেখান থেকে বাঁচতে বিশ্বকাপের আসরের সময় পরিবর্তন করে নেয়া হয় নভেম্বর-ডিসেম্বরে।
কাতার বিশ্বকাপই ৩২ দলের খেলা শেষ বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৩২ দলের অংশগ্রহণের প্রথা ভেঙে ২৩তম আসরে অংশ নেবে ৬টি অঞ্চলের ৪৮টি দল। যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডা তিন দেশের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হবে ফিফা বিশ্বকাপের ২৩তম আসর। এই প্রথমবারের মতো তিন দেশে আয়োজিত হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপ। তিনটি দেশের মোট ১৬টি শহরে হবে প্রতিযোগিতা। তিন দেশের মধ্যে দৌড়ে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন মুলুকের ১১টি শহরে আয়োজিত হবে বিশ্বকাপ। মেক্সিকোর তিন ও কানাডার দুই শহরে বিশ্বকাপের বাকি ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হবে।
শহরগুলোর নাম এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক- যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা (মার্সিডিজ-বেঞ্জ স্টেডিয়াম), বোস্টন (জিলেট স্টেডিয়াম), ডালাস (এটি অ্যান্ড টি স্টেডিয়াম), হিউস্টন (এনআরজি স্টেডিয়াম), কানসাস সিটি (অ্যারোহেড স্টেডিয়াম), লস অ্যাঞ্জেলস (সোফি স্টেডিয়াম), নিউইয়র্ক/ নিউজার্সি (মেটলাইফ স্টেডিয়াম), মায়ামি (হার্ড রক স্টেডিয়াম), ফিলাডেলফিয়া (লিঙ্কন ফিন্যান্সিয়াল স্টেডিয়াম), সান ফ্রান্সিসকো বে (লিভাইস স্টেডিয়াম), সিয়াটল (লুমেন ফিল্ড স্টেডিয়াম)। মেক্সিকোর গুয়াদালাহারা (এস্তাদিও আকরোন), মেক্সিকো সিটি (এস্তাদিও আজতেকা), মন্তেরেই (এস্তাদিও বিবিভিএ বানকোমার)। কানাডার টরন্টো (বিএমও ফিল্ড), ভ্যাঙ্কুভার (বিসি প্লেস)।
মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল যে স্টেডিয়ামে আয়োজিত হয়েছিল, লস অ্যাঞ্জেলসের সেই রোজ বোল স্টেডিয়ামকে নির্বাচন করা হয়নি। তার জায়গায় শহরের আরেক মাঠ সোফি স্টেডিয়াম নির্বাচিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ ভেন্যুতে আয়োজিত হবে ৬০ ম্যাচ, মেক্সিকো আর কানাডার ভেন্যুগুলো আয়োজন করবে ১০টি করে ম্যাচ। এর পূর্বে কোনো বিশ্বকাপ এতো বেশি শহরে কখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। মেক্সিকোই প্রথম দেশ যেখানে তিন বার বিশ্বকাপ হচ্ছে (১৯৭০, ১৯৮৬ এবং ২০২৬)। আমেরিকায় দ্বিতীয় বার (১৯৯৪, ২০২৬)। কানাডা এই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজক দেশের তালিকায় নাম লেখাচ্ছে।
ফুটবল বিশ্বকাপ মানে বহু সংস্কৃতির মেলবন্ধন, বিবিধ আনন্দের উপলক্ষ্য সুতরাং তিন দেশের সমন্বয়ে আগামী বিশ্বকাপ আয়োজন হবে বৈচিত্র্যময় এটা অনায়াসে বলা যায়। তবে এবার দেখার পালা তিন দেশের আয়োজন ফুটবলপ্রেমীদের মন ভরাতে পারে কিনা !
মন্তব্য করুন