আজ ফরাসি প্রজাতন্ত্রের জাতীয় দিবস। দিনটি বিশ্ববাসীর নিকট বাস্তিল ডে হিসেবে সুপরিচিত। জাতীয় দিবস হচ্ছে ফ্রান্সের সবচেয়ে মনোজ্ঞ উৎসবের দিন। ১৪ জুলাই সারা দেশে থাকে সরকারি ছুটি। এই দিন লাল, সাদা ও নীল রঙে রাঙিয়ে যায় পুরো ফ্রান্স। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতিগুলোর একটি হচ্ছে ফ্রান্স। বিভিন্ন দিবস উদযাপনে ফ্রান্স বরাবরই এগিয়ে। নানা রকমের দিবস পালনের মধ্যদিয়ে সারা বছরই কেটে যায় ফরাসি লোকজনের। কিন্তু বাস্তিল ডে পালনের ক্ষেত্রে রয়েছে আলাদা তাৎপর্য, ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন। করোনা মহামারি একটু দমিয়ে দিয়েছিল ঠিকই তাই বলে জাতীয় দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে তো আর পিছিয়ে থাকা যায় না। করোনা আবারও চোখ রাঙাচ্ছে কিন্তু সেই চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে ফ্রান্স বেশ আয়োজনের মধ্যদিয়ে এবারের জাতীয় দিবসটি উদযাপন করছে। ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই কী ঘটেছিল আসুন একটু জেনে নেই। ইংরেজ আক্রমণ থেকে প্যারিসকে রক্ষা করার জন্য ১৩৭০ সালে বাস্তিল দুর্গ নির্মাণ করা হয়। ১৭শ শতক থেকে বাস্তিল বন্দীশালা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে যেখানে রাজার আদেশে বিনা বিচারে বহু মানুষকে বন্দী করে রাখা হতো। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্স বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। খাদ্যের অভাব, উচ্চ কর ও রাজা ষোড়শ লুইয়ের শাসনে অসন্তুষ্টি এই বিপ্লবের মূল কারণ হয়ে ওঠে। ফরাসি বিপ্লব ইউরোপ এবং পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই বিপ্লব ছিল তদানীন্তন ফ্রান্সের শত শত বছর ধরে রাজতন্ত্রের দ্বারা নির্যাতিত ও বঞ্চিত সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। বাস্তিল দুর্গ ছিল নির্যাতন ও জুলুমের প্রতীক। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের সর্বস্তরের মানুষ বাস্তিল দুর্গ অভিমুখে রওনা হয়। রক্তক্ষয় এড়াতে দুর্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে শান্তিপূর্ণ আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়াতে বিক্ষুব্ধ জনতার ঢেউ বাস্তিল দুর্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুর্গের সৈন্যরাও ভিতর থেকে কামান দাগাতে থাকে। চারিদিক থেকে উত্তেজিত বিক্ষুব্ধ জনতা বাস্তিল দুর্গ ধ্বংস করে। জয় হয় ফরাসি জনতার। আধুনিক ফ্রান্সের জনগণ এ দিনটিকে স্মরণ করে প্রতি বছর জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করে।
এই বিপ্লবের মধ্যদিয়ে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে, গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। ঐতিহাসিকরা এই বিপ্লবকে মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করেন। এই বিপ্লবের ফলে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়, উদারপন্থী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় ফ্রান্সে। ‘স্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্ব’ মূলনীতিতে পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্রের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ফ্রান্স নিজেদের একটি জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। ষড়ভুজাকৃতির ফ্রান্সের উত্তর–পূর্বে বেলজিয়াম ও লুক্সেমবুর্গ, পূর্বে জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও ইতালি, দক্ষিণ–পশ্চিমে অ্যান্ডোরা ও স্পেন, উত্তর–পূর্বে ইংলিশ চ্যানেল, পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর, উত্তরে উত্তর সাগর, এবং দক্ষিণ–পূর্বে ভূমধ্যসাগর।
এই বিপ্লবের মধ্যদিয়ে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে, গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। ঐতিহাসিকরা এই বিপ্লবকে মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করেন। এই বিপ্লবের ফলে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়, উদারপন্থী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় ফ্রান্সে।
আমেরিকার স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে ফ্রান্স খুব গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসনদের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামে বিজয় লাভ করে আমেরিকা। সেই বিজয়ে আমেরিকার ভূখণ্ড হতে ব্রিটিশদের উৎখাত করতে সহায়ক শক্তি হিসেবে ইউরোপের কয়েকটি দেশ উল্লেখযোগ্যভাবে ভূমিকা রাখে। সেই সময়ে ফ্রান্সের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। আমেরিকান বিপ্লবে ফরাসিদের সাহায্য সহযোগিতার প্রতি মার্কিনিরা সবসময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। সেক্ষেত্রে অনেক উদাহরণই রয়েছে, বিশেষ করে ১৮৮৬ সালে ফ্রান্সের দেওয়া তামার তৈরি ৯৩ মিটার উঁচু ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ আজ যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার শতবর্ষপূর্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মধ্যকার সম্পর্ককে দুই দেশেরই স্বাধীনতা ও মুক্তির আদর্শের একটি প্রতীক দ্বারা সমৃদ্ধ করতে ফ্রান্স তৈরি করে এই ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ নামক নান্দনিক ভাস্কর্যটি যা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের লিবার্টি আইল্যান্ডে হাডসন নদীর মুখে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এই জুলাই মাসের ৪ তারিখ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও জাতীয় দিবস। ১৭৭৬ সালের জুলাই মাসে পরাধীন দেশটিতে এসেছিল মুক্তি ও স্বাধীনতার বার্তা।ইয়র্কটাউনে ব্রিটিশদের আত্মসমর্পণের পর ফ্রান্স আরো একবার কূটনৈতিক সহায়তার হাত আমেরিকার প্রতি বাড়িয়ে দেয়। ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তির প্রাক্কালে ব্রিটেন উভয় পক্ষকে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব করে। ফ্রান্স এবং আমেরিকা উভয়েই ব্রিটিশদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। শেষপর্যন্ত ব্রিটিশরা আমেরিকা অঞ্চলটিকে স্বাধীন ঘোষণা করতে বাধ্য হয় এবং প্যারিস চুক্তিতে সাক্ষর করে মিসিসিপি নদীর পূর্বদিকের বেশিরভাগ অঞ্চলের দখল ছেড়ে দেয়। ফ্রান্সের হস্তক্ষেপ বা ভূমিকায় প্যারিস চুক্তির মধ্যদিয়েই ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন আমেরিকা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে ঐ ভূখণ্ডটি যা পরবর্তীতে ইউনিয়ন অব আমেরিকা তথা আজকের ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা হিসেবে সবার নিকট পরিচিত।
স্মরণকালের ভয়াবহ তাপদাহে ধুঁকছে ইউরোপ। ফ্রান্সে এবারের জাতীয় দিবস পালনেও তীব্র গরম আবহাওয়া বিরাজমান থাকবে। সবাইকে এই বিষয়ে সতর্ক থাকার কথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বারবার জানিয়ে দিচ্ছেন। দেশের সর্বত্র ছুটি থাকায় দিনটি সকলের নিকট উৎসবে পরিণত হয়। ১৮৮০ সালে দিনটি জাতীয় দিবসের মর্যাদা লাভ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটিতে জাতীয় ছুটির দিন কার্যকর হয়। কঠোর রাজতন্ত্রের পতনের আনন্দে মাতোয়ারা হতে দিনটিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে আতশবাজি হয় যা সকলেরই নজর কাড়ে। রাজধানী শহর প্যারিসের ডিজনিল্যান্ডসহ অসংখ্য স্থানে অনুষ্ঠিত হবে বাহারি রঙের আতশবাজি। ফরাসি জাতীয় দিবসের জন্য প্যারিস সিটি কর্তৃক সবচেয়ে জমকালো আতশবাজি প্রদর্শন হয় বিশ্বখ্যাত আইফেল টাওয়ারে, একারণে ১৪ জুলাই আইফেল টাওয়ার সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ থাকবে। ১৫ জুলাই শুক্রবার, দুপুর ২ টায় আবার খুলে দেওয়া হবে। আতশবাজির অনুষ্ঠান সকলে সরাসরি উপভোগ করতে পারবেন। তাছাড়া ফ্রেঞ্চ টিভি চ্যানেল পর্দায় এই আয়োজন সম্প্রচার করা হয়।
জাতীয় দিবসের অন্যতম আয়োজন সামরিক কুচকাওয়াজ। ১৪ জুলাই সকালে বার্ষিক সামরিক কুচকাওয়াজ আয়োজন ফরাসি সংহতির একটি দেশপ্রেমিক প্রদর্শন। ইউরোপের প্রাচীনতম ও সর্ববৃহৎ সামরিক কুচকাওয়াজ প্যারিসের চ্যাম্পস–এলিসিস (Champs-Elysées)-এ অনুষ্ঠিত হয়। এবারের জাতীয় দিবস কুচকাওয়াজের থিম, “শেয়ারিং দ্য ফ্লেম“। বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন দেশের সৈন্যরা কুচকাওয়াজে অংশ নিচ্ছেন। এই বছর কুচকাওয়াজে নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনী, সামরিক পুলিশ, পুলিশ এবং নয়টি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ – এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়া থেকে সৈন্যরা অংশ নেবে। এই দেশগুলোর অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সংহতি প্রকাশ করতে চায় ফ্রান্স। প্যারিস ফায়ার ব্রিগেড দিয়ে কুচকাওয়াজ শেষ হয়। কুচকাওয়াজের সময় সামরিক বিমান প্যারেড রুটের উপর দিয়ে উড়ে যায়। ফরাসি প্রেসিডেন্ট কুচকাওয়াজ উদ্বোধন করেন, সৈন্যদের পর্যালোচনা করেন এবং হাজার হাজার মানুষ রুটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু দিক থেকে এটি যুক্তরাষ্ট্রের ৪ জুলাই প্যারেডের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
বাস্তিল ডে আগেকার ফরাসি উপনিবেশ এবং ফ্রান্সের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কযুক্ত দেশগুলোও পালন করে। এবারের দিবসটি যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ টিরও বেশি শহরে উদযাপিত হবে। পুরো ফ্রান্স জুড়ে নানা আয়োজনে উৎসব অনুষ্ঠিত হলেও এই বছর দক্ষিণ ফ্রান্সের কিছু শহর দাবানলের উচ্চ ঝুঁকির কারণে আতশবাজিসহ ঝুঁকিপূর্ণ অনেক আয়োজন বাতিল করেছে। তবে বাস্তিল দিবসকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সের লোকজন নিজস্ব সংস্কৃতিতে নাচ, গান এবং বিনোদনের আয়োজন জুলাই মাস জুড়ে করে থাকেন। ১৯২৪ সাল হতে বাস্তিল দিবস বার্ষিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়। এখন ঐতিহাসিক বাস্তিল দিবসটি কেবল একটি ছুটির দিন নয়, এটি ফরাসি সংস্কৃতির সর্ববৃহৎ উদযাপন। ফ্রান্সে কোন আয়োজন সুস্বাদু, বিলাসী খাবার ছাড়া চিন্তা করা যায়না, তাই এই দিন এক শহর হতে অন্য শহরে ঘুরে বেড়ানো সেইসাথে বিভিন্ন প্রকারের খাবারের স্বাদ নেওয়া হয়ে থাকে ফরাসি লোকজনের। ফ্রান্সের অনেক অঞ্চলে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে বেশ ব্যতিক্রমী ধরণের প্রতিযোগিতামূলক আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়।
এবারের জাতীয় দিবস এমন এক সময়ে উদযাপিত হচ্ছে যে সময়ে নানামূখী চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সের বর্তমান সরকার। গত মাসে ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর জোট। প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত হলেও ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে ভালো ফলাফল করতে পারেননি এমানুয়েল মাখোঁ। বেশ চমক দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাম–গ্রিন জোট ও কট্টর ডানপন্থীরা। এতে ফরাসি রাজনীতি আরও ভাগ হলো। অন্যদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ পুরো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সঙ্কট তৈরি করেছে তার প্রভাব ফ্রান্সেও পড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষায় কী কী উদ্যোগ গ্রহণ করে ইউরোপের অন্যতম ক্ষমতাধর দেশের সরকার সেটাই দেখার অপেক্ষায়।
মন্তব্য করুন