গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য য়োগ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক। তিনি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিরও উপ-উপাচার্য ছিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার। সিলেটে অবস্থিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এ এম সরওয়ারউদ্দিন চৌধুরী। টাঙ্গাইলে অবস্থিত মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল আজীম আখন্দ।
রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের অধ্যাপক মো. শওকত আলী এবং ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য। তার মানে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বাকি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা।
প্রশ্ন হলো, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার জন্য এখানে কোনো শিক্ষক নেই? শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার মতো কোনো শিক্ষক কি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই? বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বানানোর জন্য ঢাকা থেকে ফলিত গণিত বিভাগের একজন অধ্যাপককে নিয়ে যেতে হবে? কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও নিয়োগ দিতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে?
যে বিশ্ববিদ্যালয় নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে একজন ভিসি বানানোর মতো দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক তৈরি করতে পারে না, সেটিকে আদৌ বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় কি না? এটি কি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সংকট, নাকি রাষ্ট্রীয় নীতি? কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে কি বলা আছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ভিসি নিয়োগ করতে হবে? নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এ কারণে বাকি সব প্রতিষ্ঠানের ওপর এটি তার খবরদারির বহিঃপ্রকাশ?
প্রশ্নটা হয়তো খুব শোভন নয়। কিন্তু এই প্রশ্নগুলো তোলা দরকার। যে প্রশ্নটি তুলেছেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত যেকোনো জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে ভিসি হিসেবে নিয়োগের দাবিতে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিও পালন করেছেন। তাদের এই দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। এখান থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং এই দাবি করা উচিত যে, অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। উপাচার্য হবেন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন শিক্ষক বরিশাল-চট্টগ্রাম-রংপুর-ময়মনসিংহ বা সিলেটে দুই-তিন বছরের জন্য নিয়োগ পান, কিন্তু তাঁর মন পড়ে থাকে ঢাকায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় অবস্থান করেন। তিনি বৃহস্পতিবার দুপুরেই ঢাকায় রওনা হন। তা ছাড়া, হঠাৎ করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তার আবহাওয়া, তার প্রতিবেশ ও কর্মপরিবেশ এবং সর্বোপরি সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের মন বুঝতেও বেশ সময় লাগে। কিন্তু অনেক বছর ধরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন, প্রশাসনিক নানা কাজে যুক্ত এমন কেউ যখন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হন, তখন তাঁর জন্য প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানো অনেক সহজ হয়। সবকিছু তাঁর নখদর্পণে থাকে।
পরিচিতজনদের সঙ্গে নিয়েই তিনি সহজে কাজগুলো করতে পারেন। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি নিয়োগের নিয়ম থাকলে শিক্ষকদের মধ্যে প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানোর একটা নীরব প্রতিযোগিতাও শুরু হতে পারে। কিন্তু এখানে হয়তো বাদ সাধবে শিক্ষকরাজনীতি ও গ্রুপিং। সেটি অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি হায়ার করলেও থাকবে।
ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া যে কী ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনে, তার অনেক উদাহরণ আছে। ফলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন সংশোধন করে এখন নতুন করে এ দুটি বিষয় যুক্ত করা উচিত।
১. ক্যাম্পাসে কোনো শিক্ষক সরাসরি দলীয় রাজনীতি করতে পারবেন না। শিক্ষকদের নির্বাচন বা অন্য কোনো সংগঠন নিশ্চয়ই করতে পারবেন। কিন্তু সেটি দলীয় ব্যানারে নয়। অতএব, শিক্ষকদের নির্বাচনও হবে নির্দলীয়। সাদা দল মানে বিএনপি আর নীল মানে আওয়ামী লীগ—এই পদ্ধতি শিক্ষকদের মধ্যে যে বিভাজন তৈরি করেছে; শিক্ষকতার মতো একটি মহান পেশাকে যেভাবে কলুষিত করেছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি আইন করেই নিষিদ্ধ করা উচিত।
২. উপাচার্যসহ সব প্রশাসনিক পদে নিয়োগ করতে হবে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো শিক্ষককে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এই দাবিতে এখন সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ঐকমত্যে আসা জরুরি বলে মনে করি।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদেও এমন সব ব্যক্তিকে বসানো হয়, যাঁরা ওই কাজের জন্য যোগ্য নন বা যাঁদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন, এমন একজনকে যদি এমন কোনো প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের প্রধান করা হয়, যেখানে কাজগুলো সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো নয়, সেটি ওই প্রতিষ্ঠানের কাজ স্থবির করে দেয়।
ধরা যাক জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের কথা। এটি একেবারেই একটি টেকনিক্যাল ও সৃষ্টিশীল প্রতিষ্ঠান, যেখানে গণমাধ্যমকর্মী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গণমাধ্যমের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সুতরাং, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক পদে এসব প্রতিষ্ঠানেই বহু বছর ধরে কাজ করছেন—এমন কাউকে নিয়োগ দেওয়া উচিত। প্রশাসন ক্যাডারের লোক মানেই তিনি সবজান্তা এবং সব সুযোগ-সুবিধা তাঁরাই ভোগ করবেন; সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে তাঁরাই অগ্রাধিকার পাবেন—এই সামন্ততান্ত্রিক চর্চার অবসান হওয়া দরকার।
৫ আগস্টের পরে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দগুলোর একটি হলো ‘সংস্কার’। সুতরাং রাষ্ট্রে যদি সত্যিকারের সংস্কার করতে হয়, তাহলে সেটি শুরু করতে হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদে নিয়োগের পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে। যে পরিবর্তন হবে যৌক্তিক, আধুনিক ও সময়োপযোগী। যে পদ্ধতি কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো বিশেষ ক্যাডারকে প্রিভিলেজ দেবে না। ভিসি হতে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক হতে হবে; মহাপরিচালক হতে গেলে প্রশাসন ক্যাডারেরই লোক হতে হবে—এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে যেকোনো সংস্কার অসম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক
মন্তব্য করুন