ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু-র পাঠানো একটি নৈশভোজের আমন্ত্রণ পত্র এবং প্রধানমন্ত্রীর ইন্দোনেশিয়া সফরের বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত এক সরকারি নথিতে ইংরেজিতে ‘ভারত’ নামটি ব্যবহার করায় শুরু হয়েছে বিতর্ক।
সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা।
আলোচনার শুরু জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু আয়োজিত একটি নৈশভোজের আমন্ত্রণ পত্র নিয়ে। সেখানে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’। এই আমন্ত্রণ-পত্রটি দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান ও গিরিরাজ কিশোর
সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেন। আবার বিজেপির মুখপাত্র সম্বিত পাত্র নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন ইন্দোনেশিয়া সফরের একটি সরকারি নথি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেন মঙ্গলবার রাতে, সেখানেও মি. মোদীর পরিচয় লেখা হয়েছে ‘প্রাইম মিনিস্টার অফ ভারত’।
ইংরেজিতে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি ব্যবহার না করে কেন ‘ভারত’ ব্যবহার করা হল, তা নিয়ে কোনও ব্যাখ্যা রাষ্ট্রপতি ভবন বা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে দেওয়া হয় নি।
তবে বিরোধী দলগুলি বলছে, ‘ইন্ডিয়া’ নামে যে বিজেপি বিরোধী জোট তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে সাযুজ্য থাকার কারণেই সরকারি ভাবে ‘ভারত’ নামটি ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন বিজেপি বলছে ‘ভারত’ নামটি তো সংবিধানেই রয়েছে, তাই সেটি ব্যবহার করা হলে বিতর্ক কেন হবে।
ঘটনাচক্রে মাস দুয়েক আগে ভারতের বিরোধী দলীয় যে জোট গঠিত হয়েছে, তার নামও রাখা হয়েছে ‘ইন্ডিয়া’।
‘ইন্ডিয়া’ নাম পরিবর্তনের পুরনো দাবি
সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদে লেখা আছে যে “India, that is Bharat, shall be a Union of States”।
ভারতীয় জনতা পার্টি ও আরএসএসের নেতারা আগেও ‘ইন্ডিয়া’ নামটি বদল করে ‘ভারত করার দাবি তুলেছে।
সম্প্রতি, সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে বিজেপির সংসদ সদস্য নরেশ বনসাল বলেছিলেন যে ‘ইন্ডিয়া’ নামটি ‘ঔপনিবেশিক দাসত্বের’ প্রতীক এবং এটি সংবিধান থেকে মুছে ফেলা উচিত।
গত বছরের জুন মাসে, সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছিল যাতে ‘ইন্ডিয়া’-র নাম পরিবর্তন করে ‘ভারত’ করার দাবি জানানো হয়েছিল।
আবার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবত গুয়াহাটিতে একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন যে ইন্ডিয়া নাম বদলিয়ে ভারত নামটি ব্যবহার করা শুরু করা উচিত।
ভারত নামটির উৎস কী?
ভারতবর্ষ নামে যে ভূখণ্ড, সেটিকে প্রাচীনকাল থেকে নানা নামে চিহ্নিত করা হয়ে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে জম্মুদ্বীপ, ভারতখণ্ড, হিমবর্ষ, অজনাভবর্ষ, আর্যাবর্ত, হিন্দ, হিন্দুস্তান আর ইন্ডিয়া নামগুলি। সংস্কৃত বর্ষ শব্দটির অর্থ ভূখণ্ড।
সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে জম্মুদ্বীপের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
আবার বিষ্ণুপুরাণে পাওয়া যায় ভারতের সীমারেখার বর্ণনা :
‘উত্তরং যৎ সমুদ্রস্য’ হিমাদ্রেশ্চৈব দক্ষিণম্
বর্ষং তদভারতং নাম ভারতী যত্র সন্ততিঃ
অর্থাৎ, সমুদ্রের উত্তরে এবং হিমালয় পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত অঞ্চলের নাম হল ভারত, যেখানে ভরতের সন্ততিরা বসবাস করে।
তবে এই সব নামগুলির মধ্যে ভারত নামটিই সবথেকে বেশি প্রচলিত।
আবার এই নামটি নিয়েই রয়েছে সবথেকে বেশি মতবিরোধ।
ভাষাবিদ অজিত ওয়াডনের্কর বলছেন, “হিন্দ, হিন্দুস্তান বা ইন্ডিয়া – এই নামগুলির সঙ্গে সিন্ধু নদের যোগ আছে। কিন্তু সিন্ধু শুধু একটি নদ নয়, এর অর্থ যেমন নদ বা নদী হয়, তেমনই সাগরও এর আরেকটি অর্থ। সেদিক থেকে বিচার করলে দেশের উত্তর-পশ্চিম অংশটি কোনও এক সময়ে সপ্তসিন্ধু বা পাঞ্জাব বলা হত। ওই অঞ্চলটি খুবই উর্বর ছিল তাই সেখান দিয়ে বহমান সাত অথবা পাঁচটি নদীই ছিল এলাকার পরিচয়।“
তার কথায়, “প্রাচীন ফার্সি ভাষায় সপ্তসিন্ধুকে ‘হফ্তহিন্দু’ বলা হত।“
আবার ইন্ডিয়া এবং ইন্ডাস নাম পাওয়া যায় গ্রীক ইতিহাসবিদ মেগাস্থিনিসের বর্ণনায়।
পুরাণে একাধিক ভরত
বলা হয়ে থাকে যে পৌরাণিক চরিত্র ভরতের নাম থেকেই ভারত শব্দটি এসেছে। আবার ইতিহাসে ভরত নামে একাধিক চরিত্র পাওয়া যায়।
এঁদের মধ্যে একজন যেমন ছিলেন রামচন্দ্রের ভাই, আরেক ভরতের খোঁজ পাওয়া যায় যিনি শকুন্তলা ও দুষ্মন্তের পুত্র ছিলেন। অন্য আরেক ভরত ছিলেন নাট্যশাস্ত্র বিশারদ।
আবার মগধের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের রাজসভাতেও একজন ভরত ঋষির কথা জানা যায়।
পদ্ম পুরাণ ও মৎস পুরাণেও ভরতের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ভাষাবিদ অজিত ওয়াডনের্করের মতে ঋগ্বেদের একটি শাখা ‘এতরেয় ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থ অনুযায়ী শকুন্তলা-দুষ্মন্তের পুত্র ভরতের নামানুসারেই ভারত নাম এসেছে বলে মনে করা হয়।
হিন্দু পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী, সেই ভরত ‘চক্রবর্তী সম্রাট’ ছিলেন, অর্থাৎ যিনি চার দিকের জমি দখলে নিয়ে বিশাল এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনিই অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন বলে জানা যায়। সেই থেকেই তার সাম্রাজ্যের নাম ভারতবর্ষ।“
অন্যদিকে জৈন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রথম তীর্থঙ্কর ভগবান ঋষভদেবের জ্যেষ্ঠপুত্র মহাযোগী ভরতের প্রসঙ্গও রয়েছে।
এখন কোন ভরতের নামে গড়ে উঠেছিল ভারত? তা কি আদৌ কোনও এক ব্যক্তি ‘ভরত’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না কি ভরত আসলে একটি জনগোষ্ঠী?
ভরত কি ব্যক্তি না জনগোষ্ঠী?
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সংস্কৃতের দিকপাল অধ্যাপক মনিয়র উইলিয়ামস, যিনি সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধান লিখেছিলেন, তার মতে বেদে ভরত বা ভরথ শব্দটির অর্থ অগ্নি, লোকপাল বা বিশ্ব-রক্ষক, এক অর্থে রাজা।
এই রাজা ‘ভরত’ প্রাচীন সরস্বতী-ঘগ্গর নদী অঞ্চলে রাজত্ব করতেন।
মি. ওয়াডনের্কর বলছেন, “বৈদিক যুগের এক প্রসিদ্ধ জনগোষ্ঠী ভরতের উল্লেখ অনেক প্রাচীন পুঁথিতে রয়েছে। এই গোষ্ঠী সরস্বতী নদী তট, যেটি বর্তমানের ঘগ্গর, ওই অঞ্চলে বসবাস করত। এদের নাম অনুসারেই ওই ভূখণ্ডের নাম হয় ভারতবর্ষ।“
তিনি যে সরস্বতী, বর্তমানে ঘগ্গর নদী অঞ্চলের কথা বলছিলেন, সেই অঞ্চলটি আবার হরপ্পা সভ্যতা যেখানে গড়ে উঠেছিল, সেই সরস্বতী-ঘগ্গর নদী অববাহিকা, এমনটাই মনে করেন কোনও কোনও পণ্ডিত।
শকুন্তলা-দুষ্মন্ত পুত্র ভরত
ভাষাবিদ পবিত্র সরকার বলছেন, শকুন্তলা ও দুষ্মন্তের পুত্র ভরতের নাম থেকেই তার রাজ্যের নাম হয় ভারত, এটাই প্রচলিত ধারণা।
এই ধারণার পিছনে রয়েছে মহাভারতের আদিপর্বের একটি কাহিনী।
মহর্ষি বিশ্বামিত্র এবং অপ্সরা মেনকার কন্যা শকুন্তলা এবং পুরুবংশীয় রাজা দুষ্মন্তের মধ্যে গান্ধর্বমতে বিবাহ হয়। তাদের ছেলের নাম ছিল ভরত।
মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী, ঋষি কণ্ব আশীর্বাদ করেছিলেন যে ভরত পরবর্তীকালে ‘চক্রবর্তী সম্রাট’ হবেন এবং সেই ভূমিখণ্ডের নাম ভারত হিসাবে বিখ্যাত হবে।
ভারত নামের উৎপত্তির এই কাহিনীটি অত্যন্ত জনপ্রিয়।
মহাভারতে বর্ণিত এই ঘটনা নিয়েই পরবর্তীকালে কবি কালিদাস অভিজ্ঞান শকুন্তলম নামের মহাকাব্য রচনা করেন।
ইন্ডিয়া নাম যেভাবে হয়েছিল
মুঘল আমলে তাদের শাসনাধীন অঞ্চলকে হিন্দুস্তান বলা হত, তবে ঐতিহাসিক ইয়ান জে ব্যারো লিখছেন যে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ মানচিত্রগুলিতে ইন্ডিয়া নামটির প্রচলন হতে থাকে। তার আগে, মুঘল আমলে তাদের শাসনাধীন এলাকাটিকে হিন্দুস্তান বলে চিহ্নিত করা হত।
মি. ব্যারো জার্নাল অফ সাউথ এশিয়ান স্টাডিসে প্রকাশিত তার প্রবন্ধ ‘ফ্রম হিন্দুস্তান টু ইন্ডিয়া’-তে লিখেছেন “ইন্ডিয়া শব্দটির প্রতি আকর্ষণের কারণ সম্ভবত ছিল তাদের গ্রীক-রোমানদের সঙ্গে নৈকট্য, ইউরোপে এটির দীর্ঘ ব্যবহার এবং সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মতো বৈজ্ঞানিক ও সরকারি সংস্থাগুলির কাছে এই নামটির গ্রহণযোগ্যতা।“
আবার ভারতের সংবিধান রচনার সময়েও বিতর্ক হয়েছিল যে ইন্ডিয়া নামটা আদৌ রাখা হবে কী না তা নিয়ে। এ নিয়েও মতবিরোধ হয়েছিল যে সংবিধানে দেশের নামকরনের ক্ষেত্রে আগে ভারত, যেটিকে বিদেশি ভাষায় ইন্ডিয়া বলা হয়- এইভাবে রাখা হবে না কি এখন সংবিধানে যেভাবে আছে, অর্থাৎ ‘ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত’ সেভাবে রাখা হবে।
আরও পড়ুনঃ নরেন্দ্র মোদী ৯ বছরে নেননি ছুটি
মন্তব্য করুন