তিন দশক ধরে বিশ্বের জলবায়ু সংকট মোকাবিলার প্রধান আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত পেয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন-কপ। COP এর পূর্ণ রূপ হলো Conference of the Parties। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (UNFCCC) আওতায় প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় এই সম্মেলন। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় যৌথ সিদ্ধান্ত নিতে এখানে বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশ একত্র হয়। এর মূল উদ্দেশ্য, গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো, অভিযোজন বাড়ানো এবং ন্যায্যভাবে জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করা।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্প্রসারণ, জলবায়ু তহবিল বৃদ্ধি এবং বহু দেশের নীতি সংস্কারের মতো সাফল্য অবশ্যই আছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের গতি, তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রবণতা দেখলে স্পষ্ট-কপ সম্মেলনগুলো প্রত্যাশিত কার্যকারিতা অর্জন করতে পারছে না। ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০ সেই সীমাবদ্ধতাকে আরও প্রকট করেছে। সম্মেলনের আগে বিশ্বজুড়ে ছিল উচ্চ প্রত্যাশা। প্রায় ৯০টি দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি পরিত্যাগের একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ দাবি করেছিল।
জলবায়ুবিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করেছিলেন-২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে উষ্ণায়ন ধরে রাখতে হলে বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পদ অবিলম্বে ‘পরিত্যাজ্য’ ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু হতাশার বিষয়, কপ৩০-এর চূড়ান্ত নথি থেকেই ‘জীবাশ্ম জ্বালানি’ শব্দটি উধাও হয়ে যায়। পরিত্যাগের ঘোষণা তো দূরের কথা-এ নিয়ে কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতিও নেই। এ ব্যর্থতার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক দ্বিধা ও কৌশলগত দ্বন্দ্ব।
রাশিয়া, সৌদি আরবসহ তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর কঠোর আপত্তির মুখে বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবতার গুরুত্ব গৌণ হয়ে পড়ে। তাদের যুক্তি-অতীতে শিল্পায়নকারী দেশগুলো যেভাবে জ্বালানি সম্পদ ব্যবহার করেছে, আমরাও সে অধিকার রাখি। কিন্তু এই যুক্তি পরিবেশগত সত্যকে অস্বীকার করে; কারণ আজকের নির্গমনই আগামীর দুর্যোগকে ত্বরান্বিত করছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই আজ তাপপ্রবাহ, পানিসঙ্কট ও মরুকরণের করাল বাস্তবতায় রয়েছে-তবুও জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমাতে তারা প্রস্তুত নয়।
সম্মেলনের দুর্বলতা বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অনু পস্থিতি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জলবায়ু-বিরোধী অবস্থানের কারণে বৈশ্বিক আলোচনা গুরুত্ব হারাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো কার্যত একক লড়াই করে যাচ্ছে। আলোচনার কাঠামোতেও সমস্যা প্রকট; প্রায় ২০০ দেশের পূর্ণ ঐকমত্য ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়-ফলে উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রস্তাবগুলো একে একে ভেস্তে যায়। বহু বিশেষজ্ঞ মনে করেন-সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যবস্থা ছাড়া কপ আর কার্যকর হতে পারবে না।
ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০ চূড়ান্ত চুক্তিতে জীবাশ্ম জ্বালানি পরিত্যাগের কোনো বাধ্যতামূলক বিধান নেই; শুধু ‘স্বেচ্ছায় ব্যবহার কমানোর’ আহ্বান রয়েছে-যা বাস্তবে প্রায় অর্থহীন। কারণ স্বেচ্ছায় ক্ষতিকর জ্বালানি পরিত্যাগ করতে কেউই আগ্রহী নয়। ফলে ৮০টিরও বেশি দেশ প্রকাশ্যে হতাশা জানিয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সীমায় বিশ্বকে রাখা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
এদিকে আদিবাসী ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের উদ্বেগও উপেক্ষিত হয়েছে। অ্যামাজন সংলগ্ন জনগোষ্ঠীর অভিযোগ-তেল উত্তোলন, বন উজাড় ও নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাদের মত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয়নি। আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো-সম্মেলনের মাঝপথে ভেন্যুতে আগুন লাগায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বিঘ্ন ঘটে। কেউ কেউ রসিকতা করে বললেও সত্যটি নির্মম-জলবায়ুর উত্তাপ ঘরের ভেতরেও অনুভূত হয়েছে।
তবে সবই ব্যর্থ নয়। দরিদ্র দেশগুলো অভিযোজন ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বাড়তি অর্থায়নের আশ্বাস পেয়েছে। ব্রাজিল অ্যামাজন রক্ষায় নতুন তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে তাদের অফশোর তেল অনুসন্ধানের পরিকল্পনা এই নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
পরিস্থিতি স্পষ্ট-জলবায়ু সংকট আর ভবিষ্যতের হুমকি নয়, এটি বর্তমানের বাস্তবতা। খরা, বন্যা, অগ্নিকাণ্ড, খাদ্যসংকট ও বাস্তুচ্যুতি প্রতিদিনই বাড়ছে। এমন সময়ে কপ সম্মেলন যদি শুধু আলোচনার আনুষ্ঠানিকতায় আটকে থাকে, তবে মানবজাতিকেই তার কড়া মূল্য দিতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, সময় কমে এসে দরকষাকষি আরও ধীর হলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার লক্ষ্যটাই হয়তো ঐতিহাসিক প্রত্নবস্তু হয়ে উঠবে। জলবায়ু নিয়ে ব্রাজিলের বেলেমে জাতিসংঘের আরেকটি ব্যর্থ সম্মেলন শেষ হলো। হতাশার ছায়াই যেন দিন দিন গাঢ় হয়ে উঠছে। আলোচনার আগুনে পুড়ছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ, ধোঁয়ার আড়ালে হারাচ্ছে সমাধানের সব পথ!
মন্তব্য করুন