পেশাগত কারণে প্রতিদিন বহু পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বারবার একটি সাধারণ সমস্যা চোখে পড়ে-আমাদের বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেক অভিভাবক কিশোর সন্তানদের নিয়ে উদ্বেগে আছেন। তাঁরা দেখছেন, সন্তানদের আচরণ ও মানসিকতায় অজানা পরিবর্তন আসছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যখন অভিভাবকরা এই পরিবর্তন বুঝতে পারেন, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।
কৈশোর-এক সংবেদনশীল পরিবর্তনের সময়, কৈশোর হলো জীবনের এমন একটি ধাপ, যখন শিশুর মধ্যে দ্রুত শারীরিক, মানসিক, আবেগিক ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। এ বয়সে কিশোররা নিজেদের পরিচয় খুঁজে পেতে চায়, স্বাধীনতা কামনা করে, আবার একই সঙ্গে বিভ্রান্ত হয়। এই সময় বাইরের প্রভাব-বিশেষ করে খারাপ সঙ্গ, সামাজিক মাধ্যমের অযাচিত প্রভাব, বা ভুল দিকনির্দেশনা-তাদের সহজেই বিপথে নিয়ে যেতে পারে।
কিছু কিশোর নেশা, গ্যাং বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে; আবার কেউ কেউ অতিমেধাবী ও অতিউৎসাহী হয়ে দ্রুত বড় কিছু হতে চায়। বাস্তবতার সঙ্গে নিজের আকাঙ্ক্ষার ভারসাম্য না রাখতে পারায় হতাশা, আত্মসম্মানবোধের হ্রাস ও মানসিক বিপর্যয় দেখা দেয়। অনেক সময় এই হতাশা থেকে তারা একাকিত্বে ভোগে, আত্মক্ষতি বা আত্মহত্যার চিন্তায় নিমজ্জিত হয়।
সমস্যা নতুন নয়, তবে পরিস্থিতি এখন আরও জটিল কৈশোরকালীন মানসিক ও সামাজিক সংকট নতুন কিছু নয়। তবে প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান জীবনে বিষয়টি বহুগুণ বেড়েছে। কিশোররা এখন মোবাইল, গেমস ও সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকে। ভার্চুয়াল সম্পর্ক বাস্তব সম্পর্ককে দুর্বল করছে। পরিবারে ব্যস্ত অভিভাবকরা সময় দিতে না পারায় সন্তানরা মানসিকভাবে একা হয়ে পড়ছে। এর ফলে তারা ভুল দিকনির্দেশনার শিকার হচ্ছে এবং সমাজে একটি নীরব হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে।
অভিভাবকদের উচিত সন্তানের আচরণে পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য রাখা। কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো- দীর্ঘ সময় একা থাকা বা দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকা, পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলা বা স্কুলে অনুপস্থিতি, পরিবারের সঙ্গে খাবার না খাওয়া, সামাজিকতা এড়িয়ে চলা, হঠাৎ মেজাজ পরিবর্তন, চুপচাপ থাকা বা রাগারাগি করা, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার বা গোপনে কিছু লুকানো।
এই লক্ষণগুলো উপেক্ষা করা বিপজ্জনক হতে পারে। এমন সময় অভিভাবকের করণীয় হলো-সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা, তার অনুভূতি বোঝা, এবং প্রয়োজনে কাউন্সেলর বা মনোবিদের সহায়তা নেওয়া।
ইসলামে কিশোরদের সঠিক পথে গড়ে তোলার জন্য সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন-‘প্রত্যেক অভিভাবক একজন রক্ষণাবেক্ষক এবং তাঁর দায়িত্ব হলো অধীনস্থদের সঠিকভাবে পরিচালিত করা।’
অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের সৎ ও ধার্মিক বন্ধুত্বে উৎসাহিত করা, সময়কে অর্থবহ কাজে ব্যবহার শেখানো এবং বিবাহযোগ্য হলে বিবাহে উৎসাহ দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-“যে বিবাহ করতে সক্ষম, সে যেন বিবাহ করে; এটি দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও পবিত্রতা রক্ষা করে।” (সহীহ বুখারি ৫০৬৬)
একইসঙ্গে সন্তানদের জন্য নিয়মিত দোয়া করা, নামাজ, রোজা ও নৈতিকতার চর্চায় উৎসাহিত করা জরুরি। প্রযুক্তি ব্যবহারে অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে-কম্পিউটার বা স্মার্টফোন যেন খোলা জায়গায় ব্যবহৃত হয় এবং ব্যবহার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়।
শুধু পরিবার নয়, কমিউনিটিকেও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। বাস্তবসম্মত কিছু পদক্ষেপ হতে পারে-অভিভাবক ও কিশোরদের নিয়ে নিয়মিত সচেতনতামূলক সভা আয়োজন, যেখানে বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও আলেমরা দিকনির্দেশনা দেবেন। শিক্ষার্থীদের ফলাফল, আচরণ বা সামাজিক অবদানে স্বীকৃতি ও পুরস্কার প্রদান। ইসলামের মহান ব্যক্তিত্বদের জীবন থেকে শিক্ষণীয় আলোচনা ও আদর্শ তুলে ধরা। কমিউনিটি সেন্টার বা মসজিদে কিশোরদের জন্য বিনোদন, পাঠচক্র ও নেতৃত্ব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ইতিবাচক ইসলামী বই, ভিডিও ও নৈতিক গল্পের মাধ্যমে মানসিক বিকাশে সহায়তা করা।
কৈশোর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময় অভিভাবক, শিক্ষক ও সমাজের দায়িত্ব হলো-তরুণদের ভালোবাসা, দিকনির্দেশনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে গড়ে তোলা। ইসলামী আদর্শে শিক্ষিত, আত্মনিয়ন্ত্রিত ও নৈতিক প্রজন্মই পারে এক দৃঢ়, সচেতন ও আলোকিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। তাই এখনই সময় আমাদের সম্মিলিতভাবে এই প্রজন্মকে রক্ষা করার-কারণ তারাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।
মন্তব্য করুন