বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রযুক্তির ব্যবহারকে কেবল আধুনিক কৌশল নয়, বরং নেতৃত্বের অন্যতম শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডনে অবস্থান করেও তিনি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। নিষেধাজ্ঞা, সরকারি বাধা কিংবা প্রচলিত গণমাধ্যমের দরজা বন্ধ থাকলেও প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে তিনি দলের কর্মী-সমর্থক ও প্রবাসীদের একত্রিত করেছেন। এভাবেই লন্ডন থেকে গড়ে উঠেছে প্রযুক্তিনির্ভর নেতৃত্বের এক যুগান্তকারী অধ্যায়।
২০১৫ সালে হাইকোর্ট বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য, বিবৃতি ও কর্মকাণ্ডের প্রচার ও প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সরকারের ধারণা ছিল তাঁর বার্তা সীমিত রাখা গেলে রাজনৈতিক প্রভাবও কমবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টো। লন্ডন থেকে তিনি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গণআন্দোলনের আহ্বান ও গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরতে থাকেন। তাঁর এই উদ্যোগ সরকারের পরিকল্পিত চাপ ও বাধাকে ব্যর্থ প্রমাণ করে।
সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় নানা ধরনের বাধা, জটিল নিয়মকানুন ও কৌশল ব্যবহার করে তারেক রহমানের বার্তা সীমিত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তিনি এসব প্রতিবন্ধকতার বিষয় আগে থেকেই ভেবে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সরকারি চেষ্টার পরও তাঁর নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের কাছে পৌঁছে যায়—যা প্রমাণ করে, প্রকৃত নেতৃত্ব কোনো ভৌগোলিক বা প্রশাসনিক বাধায় থেমে থাকে না।
২০১৪ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার মূলধারার গণমাধ্যমগুলোকে কঠোরভাবে তারেক রহমানের সংবাদ প্রচার থেকে বিরত রাখার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। একই সময়ে যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বাংলাদেশি মিডিয়াতেও সেই চাপের প্রভাব পড়ে। এ পরিস্থিতিতে বিকল্প গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুক্তরাজ্যে তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি টিমের সঙ্গে পরামর্শ করে নিজস্ব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তারেক রহমানের সরাসরি পরামর্শে এর নামকরণ করা হয় “ইউএনএন অনলাইন টিভি”, আর স্লোগান নির্ধারণ করা হয়—“গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার কথা বলে।”
২০১৪ সালে তারেক রহমানের পরামর্শে তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি টিম নিজস্ব মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপের উদ্যোগ নেয়। তখনো ফেসবুক, ইউটিউব বা টিকটকের মতো লাইভ স্ট্রিমিং সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছেনি। প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ‘ইউএনএন অ্যাপ’ চালু করে লন্ডন থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের পথ তৈরি করা হয়। এটি ছিল শুধু একটি প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নয়; বরং দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইতালিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লাইভ স্ট্রিমিংয়ের চুক্তি করে, লন্ডন থেকেই অনলাইন টিভির প্ল্যাটফর্ম এবং অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএস অ্যাপ তৈরি করা হয় যা ছিল যুগান্তকারী ও সাহসী পদক্ষেপ।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ২০১৪ সালের আগে কোনো বাংলাদেশি চ্যানেল অ্যাপল অ্যাপস্টোরে ডাউনলোডের সুযোগ পায়নি। সেই সময় অ্যাপল অ্যাপে লাইভ স্ট্রিমিং চালুর জন্য প্রয়োজনীয় প্লেয়ার কোড নিয়ে দেশে কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করত না। ফলে ইউএনএন টিভির আইওএস সংস্করণের জন্য লাইভ স্ট্রিমিং প্লেয়ার কোড বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেয় অনলাইন ভিত্তিক যুক্তরাষ্ট্রের এক আইটি বিশেষজ্ঞ। তাঁদের সহায়তায় প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধান সম্ভব হয় এবং লন্ডন থেকে সরাসরি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় লাইভ সম্প্রচার নিশ্চিত করা যায়। এর মাধ্যমে লন্ডন থেকে সরাসরি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।
২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যে বিএনপির একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মীসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তারেক রহমান। পুরো অনুষ্ঠানটি ইউএনএন অনলাইন টিভি সম্প্রচার করেছিল, যদিও স্থানীয় কোনো মিডিয়া সেই সময় কভার করতে আসে নি।
পরবর্তীতে এই আর্কাইভ ভিডিওটি বিএনপির প্রচারণায় অমূল্য সম্পদে পরিণত হয়। এছাড়াও, যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত আরও অনেক অনুষ্ঠান সরাসরি অনলাইনে সম্প্রচার করা হয়েছে, যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীরা ঘরে বসেই দেখতে পেরেছেন।
দেশের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে লন্ডন থেকে তারেক রহমানের সমাবেশের বক্তব্য অনলাইন টিভির স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইটিভিতে সম্প্রচারিত করা হয়েছিল। এটি আওয়ামী সরকারের চোখে কাঁটার মতো ছিল, ফলে বাংলাদেশে ইটিভি হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এই বাধা-বিপত্তি তাকে থামাতে পারেনি, বরং বিএনপির কর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে।
তারেক রহমানের এই ডিজিটাল কৌশল কেবল দলের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে রূপান্তরিত করেনি, প্রবাসী বাংলাদেশির মধ্যেও নতুন রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করেছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা একই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়েছে। তিনি অদৃশ্য এক সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন, যা ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে ঐক্যের স্রোত বইয়ে দেয়।
মেটা ও ইউটিউব লাইভ চালু হওয়ার পর তাঁর এই বৈশ্বিক যোগাযোগ আরও শক্তিশালী হয়। প্রতিটি সভা, সমাবেশ ও আলোচনা তিনি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিচালনা করেন। তাঁর নেতৃত্ব প্রমাণ করে—যেখানে প্রচলিত গণমাধ্যমের দরজা বন্ধ, সেখানে বিকল্প পথ খুঁজে নেওয়ার সাহসই প্রকৃত নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য।
আজও তিনি জুমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে দলের কেন্দ্রীয় ও প্রবাসী নেতৃত্বকে সক্রিয় রাখছেন। প্রযুক্তিকে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে তিনি শুধু রাজনীতি পরিচালনা করছেন না, নতুন প্রজন্মকেও অনুপ্রাণিত করছেন—যে কোনো পরিস্থিতিতে দেশ ও দলের প্রতি দায়িত্বশীল থাকা সম্ভব।
তারেক রহমান শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বেই নয়, প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের ক্ষেত্রেও দূরদর্শী পরিকল্পনাকারী। ২০০১–২০০৫ সালের বিএনপি সরকারের সময় তিনি দেশের প্রযুক্তি উন্নয়ন ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে শক্তিশালী করার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফরে তিনি মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসকে বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানান, যা দেশের প্রযুক্তি খাতের জন্য এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে ওঠে।
বিল গেটসের সেই সফর বাংলাদেশের জন্য ছিল এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সহযোগিতার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। বিল গেটস বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মকে আইসিটি শিক্ষায় অগ্রসর হওয়ার পরামর্শ দেন এবং বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির সম্ভাবনা তুলে ধরেন।
২০০৪ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি অনলাইন কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। এই কনফারেন্সটি আয়োজন করেছিল ওয়েবভিত্তিক সংগঠন “কবিতা ও গান ডটকম”। তারা প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে প্রথম অনলাইন বৈঠকের ব্যবস্থা করে। নিউইয়র্কে বসে সংগঠনটির পক্ষ থেকে নানা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা হয় তারেক রহমানকে, আর তিনি বনানীতে চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে সরাসরি প্রশ্নগুলোর উত্তর দেন। এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বার্তা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়।
২০০৫ সালে জেলা পর্যায়ে প্রোগ্রামারদের উৎসাহিত করতে এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যমকে প্রসারিত করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হলো “মাই পাবনা ডটকম”, যা ছিল পাবনা জেলার একটি অনলাইন সংবাদ ও তথ্যভিত্তিক ওয়েবসাইট।
নির্ভর নেতৃত্ব দিয়ে তারেক রহমান প্রমাণ করেছেন, প্রকৃত নেতৃত্ব কোনো ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ থাকে না। তিনি বিএনপিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের একত্রিত করছেন এবং তরুণদের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে উদ্বুদ্ধ করছেন। নিঃসন্দেহে, তারেক রহমানের এই দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক যুগান্তকারী অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। এছাড়া বিশ্লেষকরা মনে করেন, লন্ডন থেকে প্রযুক্তিনির্ভর নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে তারেক রহমান যে উদাহরণ স্থাপন করেছেন, তা ভবিষ্যতের বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করবে।
লেখক : সাংবাদিক
মন্তব্য করুন