মার্কিন বিচারক ফ্র্যাঙ্ক ক্যাপ্রিও ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি ন্যায়বিচারের পাশাপাশি মানবিকতা ও সহানুভূতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার আদালতের প্রতিটি রায়ই যেন শুধু আইন নয়, মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা দুঃখ-দুর্দশা ও বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার এক অসাধারণ পাঠ ছিল। সাধারণ মানুষের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা, দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি সহমর্মিতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস-এই গুণগুলো তাঁকে বিচারক হিসেবে অন্য সবার থেকে আলাদা করেছে। আইনের কাঠামোবদ্ধ ধারা মেনে চলেও কিভাবে একজন বিচারপতি মানবিকতার দৃষ্টান্ত রাখতে পারেন, ফ্র্যাঙ্ক ক্যাপ্রিও সেই উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মানবিক রায় ও কর্মময় জীবন আজও বিশ্বের কোটি মানুষের মনে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।
জন্ম ও শৈশবকাল
ফ্র্যাঙ্ক ক্যাপ্রিও ১৯৩৬ সালের ২৪ নভেম্বর প্রভিডেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আন্তোনিও ক্যাপ্রিও ছিলেন ইতালির অভিবাসী, যিনি ফল ও দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রি করে সংসার চালাতেন। মা ফিলোমেনা ক্যাপ্রিও ছিলেন নেপলস বংশোদ্ভূত। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া ছোট্ট ফ্র্যাঙ্ককে শৈশবেই জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। তিনি স্কুলে পড়ার পাশাপাশি পিতার সঙ্গে ফল বিক্রেতার দোকানে কাজ করতেন, জুতো পালিশ ও স্কার পরিষ্কার করার কাজও করতেন। আর্থিক সংকট থাকলেও তিনি শিক্ষার প্রতি ছিলেন ভীষণ অনুরাগী।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নেতৃত্বগুণ ও বক্তৃতায় দক্ষতা প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি রোড আইল্যান্ডের রাজ্য-স্তরের বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন। পরে তিনি Providence College থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
শিক্ষা ও প্রারম্ভিক পেশা
শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক ক্যাপ্রিও। Hope High School-এ তিনি আমেরিকান সরকার ও রাজনৈতিক ইতিহাস পড়াতেন। দিনে শিক্ষকতা এবং রাতে আইন অধ্যয়ন-এই কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে তিনি Suffolk University Law School থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন।
এদিকে ১৯৫৪ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সেনা রিজার্ভ বাহিনী Rhode Island Army National Guard-এ ৮৭৬তম Combat Engineer Battalion-এ দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষাদান, আইনচর্চা ও সামরিক বাহিনীতে সেবা-এই তিন অভিজ্ঞতা তাঁর ব্যক্তিত্বকে শক্তিশালী ভিত্তি দেয়, যা পরবর্তী সময়ে তাঁকে একজন মানবিক বিচারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
রাজনীতি ও জনসেবায় পদার্পণ
১৯৬২ সালে ফ্র্যাঙ্ক ক্যাপ্রিও Providence City Council-এর সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। জনসেবায় সক্রিয় হওয়ার মাধ্যমে তিনি স্থানীয় জনগণের আস্থা অর্জন করেন। এছাড়া তিনি Rhode Island Board of Governors for Higher Education-এর চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষা ও জনসেবার প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ছিল আজীবনের।
বিচারক হিসেবে দীর্ঘ কর্মজীবন
১৯৮৫ সালে তিনি Providence Municipal Court-এর প্রধান বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তী প্রায় চার দশক তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। সাধারণ মানুষ, বিশেষত দরিদ্র, প্রবাসী ও অভিবাসীদের নিয়ে তাঁর আদালত সর্বদা মানবিক রায়ের দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে টেলিভিশন অনুষ্ঠান “Caught in Providence”-এর মাধ্যমে। সেখানে ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারী বা ক্ষুদ্র অপরাধে অভিযুক্ত সাধারণ মানুষ যখন তাঁর সামনে দাঁড়াতেন, তিনি তাদের আর্থিক অবস্থা, পারিবারিক কষ্ট, জীবনের সংগ্রাম বিবেচনা করে সহানুভূতিশীল রায় দিতেন। কঠোর শাস্তির পরিবর্তে অনেক সময় তিনি ক্ষমা করে দিতেন বা শাস্তি কমিয়ে দিতেন। তাঁর এ ধরনের রায় ও মন্তব্যের ভিডিওগুলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে এবং কোটি কোটি মানুষ তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির ভক্ত হয়ে ওঠে। মানুষ তাঁকে ডাকত “The Nicest Judge in the World” বা “বিশ্বের সবচেয়ে দয়ালু বিচারক” নামে।
মানবিকতা ও সামাজিক অবদান
ফ্য্যাঙ্ক ক্যাপ্রিও শুধু একজন বিচারকই ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী সমাজকর্মী। শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি Antonio “Tup” Caprio Scholarship Fund প্রতিষ্ঠা করেন, যা অসংখ্য শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করেছে।
তিনি Boys Town of Italy, Nickerson House Juvenile Court, Rhode Island Food Bank সহ বহু সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
মৃত্যু ও শ্রদ্ধাঞ্জলি
দীর্ঘ কর্মময় জীবনের শেষে গত ২০ আগস্ট তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ডের প্রভিডেন্সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর তিনি না–ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন। জীবদ্দশায় তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, সাধারণ মানুষের প্রতি গভীর সহমর্মিতা ও ব্যতিক্রমধর্মী বিচারপ্রক্রিয়ার জন্য তিনি সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিলেন।
তাঁর মৃত্যুর সংবাদে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকে সামাজিক মাধ্যমে তাঁকে “মানবিকতার প্রতীক”, “একজন সত্যিকারের জনতার বিচারক” হিসেবে অভিহিত করেন।
রোড আইল্যান্ডের গভর্নর ড্যান ম্যাককী তাঁকে রাজ্যের এক মূল্যবান সম্পদ আখ্যা দেন এবং সম্মান প্রদর্শনের জন্য পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দেন। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলো তাঁকে স্মরণ করে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
চিরস্মরণীয়
ফ্র্যাঙ্ক ক্যাপ্রিওর মৃত্যুতে বিচার অঙ্গন হারালো একজন উদার, সহমর্মী ও মানবিকতার দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠা বিচারককে। তাঁর রায় শুধু কাগজে কলমে নয়, মানুষের হৃদয়ে পৌঁছেছিল। বিচারকের আসনে বসে তিনি প্রমাণ করেছিলেন-ন্যায়বিচার মানেই কঠোরতা নয়, বরং সহমর্মিতা ও মানবিকতাও বিচার প্রক্রিয়ার অপরিহার্য অংশ।
তাঁর জীবন ও কর্ম আগামী প্রজন্মের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তাঁকে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
মন্তব্য করুন