অখণ্ড বাঙালি চেতনা এবং বাঙালি জাতিসত্তা রক্ষার আহবান জানিয়ে করিমগঞ্জে সম্পন্ন হলো দুদিনব্যাপী সৈয়দ মুজতবা আলী সাহিত্য উৎসব। করিমগঞ্জসহ বরাক উপত্যকার তিন জেলায় নানা কার্যসূচিতে সৈয়দ মুজতবী আলীকে স্মরণ করা হয়। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কেন্দ্রীয় সমিতির উদ্যোগে এবং করিমগঞ্জ জেলা সমিতির ব্যবস্থাপনায় শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় শ্রদ্ধাঞ্জলি ও স্মরণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উৎসবের সূচনা হয়। বিপিন চন্দ্র পাল স্মৃতি ভবনে শনিবার দিনে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। কেন্দ্রীয় সমিতির সভাপতি রাধিকারঞ্জন চক্রবর্তীর পৌরহিত্যে অনুষ্ঠিত সভায় মুখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. তপোধীর ভট্টাচার্য। তিনি নিজের ভাষণে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘অবিশ্বাস্য’ থেকে শুরু করে অনেক গ্রন্থের কথা উল্লেখ করলেও বারবার প্রশংসা করেছেন ‘শবনব’ এর ।
‘সৈয়দ মুজতবা আলীর অখণ্ড বাঙালি চেতনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বারবার তিনি সাহিত্য চর্চা করবেন না বলে কথা দিয়েও দর্শক শ্রোতাদের মন মানসিকতাকে সেই সাহিত্যের দিকেই টেনে নিয়ে যান। তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনার কথা উঠে আসে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, যেখানে মহিলার অন্তর্বাস নিয়ে প্রকাশ্যে খেলা হয়, মুজিবের মূর্তি ভাঙ্গা হয়, সেটা আর যাই হোক, বিপ্লব হতে পারে না। বাংলাদেশে যা ঘটেছে সেটা গণতন্ত্র বৈ ফ্যাসিবাদের আস্ফালন বলে মন্তব্য করেন তপোধীর বাবু। তিনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে গিয়েছেন এবং তখন সেখানে গিয়ে যা উপলব্ধি করেছেন আজকের বাংলাদেশে সেই অবস্থা নেই বলেও আক্ষেপ করেন তিনি। তাঁর ভাষণে অসমের বর্তমান পরিস্থিতির কথা উঠে আসে। যেখানে উগ্র জাতীয়তাবাদের থাবায় ভাষা আগ্রাসনের ঘটনা প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে। তিনি বলেন, এই ভাষিক আগ্রাসন থেকে বাঁচতে এবং জাতির অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন সবার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। কেননা, আজকের দিনে ধর্মের আঁধারে বাঙালি জাতিকে পৃথক করে রাখার এক প্রয়াস চলছে। আর এতে ক্রমশ বাঙালি জাতি হিসেবে পরিচয় দেওয়ার ইচ্ছা এবং ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। যে বাঙালি গর্ব করে নিজদের পূর্বসূরি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মুজতবাসহ আরো অনেককে নিয়ে, সেই বাঙালির অস্তিত্ব আজকের দিনে সত্যিকার অর্থেই সমস্যার সম্মুখীন। আজ বাঙালিরা শেকড় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে বলেই নানাভাবে আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। তিনি তাঁর তাত্ত্বিক ভাষণে সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর সমাজ দর্শনের বিভিন্ন দিক উল্লেখ করে বলেন, ধর্ম দিয়ে কখনো নিজের জাতির পরিচয় দেননি সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি বাঙালি জাতিসত্তাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। জীবদ্দশায় সৈয়দ মুজতবা ৩১ টি কাব্যগ্রন্থ লিখে গেছেন। তিনি ১৫ টি ভাষায় কথা বলতে জানতেন। এমন এক আশ্চর্য ব্যক্তি ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তাঁর সাহিত্য কর্মে ফুটে ওঠেছে সমাজজীবনের সাম্যবাদ।
সঞ্জীব দেব লস্করের সঞ্চালনায় আয়োজিত এই আলোচনা সভায় সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষাপ্রেম,বাঙালি চেতনা এবং দেশ ভেদে ভাষা বিবর্তনের ইতিহাসের কথা তুলে ধরেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ বিবেকানন্দ মোহন্ত। সঞ্চালক নিজেও সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে সারগর্ভ ভাষণ রাখেন। সভাপতির ভাষণে রাধিকা রঞ্জন চক্রবর্তী এদিনের আলোচনা সভার বক্তাদের বক্তব্যের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ভালো বক্তা হলে সময় কেটে যায়। তপোধীর ভট্টাচার্য সে মাপের বক্তা। এদিন শুরুতে আলোচনার বিষয়বস্তুর উপর আলোকপাত করেন কেন্দ্রীয় সমিতির সম্পাদক গৌতমপ্রসাদ দত্ত।
সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্য সম্পাদক দীপক সেনগুপ্ত, জেলা সমিতির সভাপতি অরবিন্দ পাল প্রমুখ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন করিমগঞ্জ জেলা সমিতির সম্পাদক নন্দকিশোর বণিক। এখানে উল্লেখ্য, ১৯০৪ সালের ঠিক (১৩ সেপ্টেম্বর) এই দিনেই করিমগঞ্জ শহরেই জন্মেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি প্রাবন্ধিক রম্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের করিমগঞ্জ শহর কমিটির ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় বিপিন চন্দ্র পাল স্মৃতি ভবনে সৈয়দ মুজতবা আলী সাহিত্য উৎসবের সূচনা হয় । প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রাধিকা রঞ্জন চক্রবর্তী। এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শহর সমিতির সভাপতি অরবিন্দ পাল, করিমগঞ্জ কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য , সংস্থার সম্পাদক নন্দ কিশোর বণিক প্রমুখ । শুরুতে স্বাগত ভাষণ রাখেন নন্দ কিশোর বণিক । এরপর সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে খুব সুন্দর বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য । তিনি তাঁর বক্তব্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবনে কিভাবে রাবীন্দ্রিক প্রভাব পড়েছিল, কিভাবে শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় কবিগুরুর সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবং বিশ্বজনীন মুজতবা হয়ে ওঠার একাধিক প্রেক্ষাপট খুব সুন্দরভাবে নিজের বক্তব্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন তিনি। বক্তব্যের আসর শেষে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । শনিবারের অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন মাশুক আহমেদ ।
মন্তব্য করুন