কারিনা অ্যামবার্টসউমিয়ান-ক্লফ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী একজন রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি।
অ্যামবার্টসউমিয়ান-ক্লফ ভিওএ-কে বলেছেন, “আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি, যেটির বর্তমানে আর কোনই অস্তিত্ব নেই।” যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (ডিএইচএস) অনুসারে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অ্যামবার্টসউমিয়ান-ক্লফ এর মতো বসবাসরত রাষ্ট্রবিহীন লোকদের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ১৮ হাজার। মঙ্গলবার হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বলেছে, তারা অভিবাসনের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রহীন মানে কী, তা স্পষ্ট করবে৷
অ্যামবার্টসউমিয়ান-ক্লফ বলছেন, এটি “এই দেশে আমাদের মতো লোকদের স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি বিশাল পদক্ষেপ।”
বৃহস্পতিবার, ডিএইচএস রাষ্ট্রহীনতা নীতির উপর এক অধিবেশনের আয়োজন করেছিল। ওই অধিবেশনে রাষ্ট্রহীন লোকেদের ব্যক্তিগত কথা শোনা হয়েছে।
বৈঠকে নেতৃত্ব দেন ডিএইচএস সেক্রেটারি আলেয়ান্দ্রো মায়োরকাস। ভিওএ-এর সাথে কথা বলা অংশগ্রহণকারীদের মতে, কথোপকথনটি ছিল পরবর্তী পদক্ষেপগুলি বের করার জন্য। আমেরিকান নাগরিকত্ব এবং অভিবাসন পরিষেবাগুলি এই নীতির উপর শীগগিরই একটি জনসভার আয়োজন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ডিএইচএস-এর ঘোষণা নতুন পদ্ধতির বিকাশ ও বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়, যাতে ইউএসসিআইএস কর্মকর্তারা কেউ রাষ্ট্রহীন কিনা, তা মূল্যায়ন করার জন্য আরও ভালভাবে প্রস্তুত হতে পারেন এবং প্রমাণের উদাহরণগুলি এই রূপরেখা দেয়, যা ইউএসসিআইএস কর্মকর্তাদের তাদের সেই সংকল্পে সহায়তা করতে পারে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর ওয়েবসাইট মতে, “যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে কেউ রাষ্ট্রহীন কিনা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় না। উপরন্তু, একজন ব্যক্তি যে রাষ্ট্রহীন, তা যুক্তরাষ্ট্রের আইনের অধীনে তাকে কোনো রকম সুবিধা কিংবা মর্যাদা প্রদান করে না।”
অ্যামবার্টসউমিয়ান-ক্লফের এখনও স্পষ্টভাবে মনে আছে, সেদিনের কথা যে দিন তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, তার মতো তার পিতামাতাও রাষ্ট্রহীন ছিলেন।
অ্যামবার্টসউমিয়ান-ক্লফ এর পিতা ছিলেন একজন আর্মেনিয়ান। তিনি জর্জিয়ার তিবিলিসিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং আর্মেনিয়িান গণহত্যা থেকে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাদেরই বংশধর ছিলেন। তার মা ইউক্রেন থেকে এসেছেন, তার জন্ম ওডেসার ঠিক বাইরে, ভোজনেসেনস্কে। অ্যামবার্টসউমিয়ান-ক্লফ -এর দাদা-দাদিও আঞ্চলিক অশান্তি এবং হলোকাস্ট থেকে পালিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন।
যখন তার বাবা-মা জন্মগ্রহণ করেন, উভয় অঞ্চলই সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। কিন্তু ৭০ বছর পর, ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে ১৫টি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যায়।
অ্যামবার্টসউমিয়ান-ক্লফ ১৯৮৮ সালে ওডেসায় জন্মগ্রহণ করেন, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন বহাল ছিল।
যখন তার বয়স ৩ বছর, পরিবার বুঝতে পেরেছিল যে ওডেসায় থাকা তাদের জন্য আর নিরাপদ নয়। তাই তারা ১৯৯২ সালে কানাডায় পাড়ি জমায়। সেখানে তারা চার বছর বসবাস করেছিল, কিন্তু কানাডা তাদের স্থায়ীভাবে বসবাস করতে দেয়নি। অগত্যা ১৯৯৬ সালে তারা সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে, এবং এখানে এসে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করে। তাদের বিষয়টি প্রায় পাঁচ বছর ধরে ঝুলে থাকার পর, অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রও তাদের স্থায়ীভাবে বাস করার অনুমতি দেয়নি।
১৩ বছর বয়সে, অ্যামবার্টসউমিয়ান-ক্লফ এবং তার বাবা-মাকে বলা হয়েছিল যে তাদের যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে যেতে হবে।
তখন পরিবারটি একটি জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। তারা যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যেতে চাইলেও, যেতে পারেনি। কারণ তাদের কোনও দেশেরই নাগরিকত্ব ছিল না।
রাষ্ট্রহীনতার ধারণাটি অনেক লোকের পক্ষে বোঝা কঠিন হতে পারে, বিশেষ করে আমেরিকানদের, এই কারণে আমেরিকান সংবিধান তার সীমানার মধ্যে জন্মগ্রহণকারী যে কাউকে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু অনেক দেশই তা করে না।
কোথাও যাওয়ার উপায় না থাকায়, অ্যামবার্টসউমিয়ান-ক্ল এবং তার বাবা-মা যুক্তরাষ্ট্রেই থেকে যান। এখানে তার বাবা ঘরবাড়ি রং করার কাজ শুরু করেন, আর মা ঘরবাড়ি পরিষ্কারের ব্যবসা।
তিনি বলেন, কিন্তু যখন আমার ১৮ বছর পূর্ণ হল, তখনই সবকিছু বদলে গেল। কারণ কোন দেশের বৈধ নাগরিকত্ব ছাড়াই আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠলাম।”
অ্যামবার্টসউমিয়ান-ক্লফ-এর কাছে একমাত্র দুটি নথি ছিল, যার মধ্যে একটি হল জন্ম সনদ, যে দেশের অস্তিত্বই আর নেই, আর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলের পরিচয় পত্র।
কিন্তু, যখন তিনি কোনও চাকরির আবেদন করতে, মোবাইল ফোন কিনতে, কিংবা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করতে, চাইতেন তার অবশ্যই একটা সরকারি পরিচয়পত্রের প্রয়োজন পড়তো।
অবশেষে অ্যামবার্টসউমিয়ান-ক্লফের সাথে পরিচয় হয় এক আমেরিকান নাগরিকের, পরিচয় থেকে প্রণয় এবং ২০১৩ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
তিনি বলেন, “বিয়ের পর আমরা পাঁচ বছর একসাথে ছিলাম। এবং আমরা আসলে বিয়ে করতে মেরিল্যান্ড গিয়েছিলাম, কারণ মেরিল্যান্ড রাজ্যে বিয়ে করার জন্য বৈধ পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয় না। তাই আমরা মেরিল্যান্ডের এলকটনে গিয়েছিলাম এবং একটি বিয়ের সনদ পাই, আর সেটাই ছিল আমার প্রথম কোন বৈধ নথি, যেটাতে আমার নাম লেখা ছিল।”
১৯৬৫ সালের ইমিগ্রেশন এবং ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে, কংগ্রেস পারিবারিক অভিবাসন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছে যা আমরা আজ জানি। এই আইনের অধীনে, কংগ্রেস একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছে যা আমেরিকান নাগরিকদের কোনো রকম সীমাবদ্ধতা ছাড়াই স্বামী-স্ত্রী সহ নিকট আত্মীয়দের স্পনসর করতে পারে।
অ্যামবার্টসউমিয়ান-ক্লফ বলেন, তিনি আশা করেন, ডিএইচএস নির্দেশিকা অবশেষে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংজ্ঞার সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাষ্ট্রহীনতার একটি সংজ্ঞা স্থাপন করবে, যাতে অচলাবস্থায় থাকা ব্যক্তিদের সাহায্য করা সম্ভব হবে।
তিনি অন্যান্য রাষ্ট্রহীন মানুষের সাথে দেখা করেন এবং ইউনাইটেড স্টেটলেস নামে একটি কার্যক্রম শুরু করেন, যেটা রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিদের নেতৃত্বে একটি জাতীয় সংস্থা, যার লক্ষ্য তাদের মানবাধিকারের পক্ষে সমর্থন আদায় করা।
তিনি আরও আশা করেন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস অভিবাসন আইনে কোডিফাই করার জন্য আইন পাস করবে যে কীভাবে একজন রাষ্ট্রহীন অবস্থায় থাকা ব্যক্তি স্থায়ী বসবাসের জন্য আবেদন করতে পারেন।
বর্তমানে, তিনি তার স্বামী কেভিনের সাথে পেনসিলভানিয়াতে থাকেন। তার মা এখনও বেঁচে আছেন, কিন্তু ডিসেম্বরে তার বাবা মারা যান।
যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে আরও পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মন্তব্য করুন