রবীন্দ্রনাথের প্রেম
স্বামী নিখিলেশের প্রতি অনুরাগ সত্ত্বেও ‘ঘরে বাইরে’ কাহিনীর নায়িকা বিমলা বিপ্লবী সন্দীপের দ্বারা তীব্রভাবে আকর্ষিত। একদিকে বাইরে জাতীয় আন্দোলনের উত্তেজনা অন্যদিকে তিনটি মানুষের জীবনে টানাপোড়ন – রাজনীতি ও ব্যক্তিগত জীবনের দ্বন্দ্ব এই দুই মিলে উপন্যাস। ঘরে বাইরে উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ১৯১৬ সালে।
এটি চলিত ভাষায় লেখা উনার প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটি সবুজপত্র পত্রিকায় প্রকাশিতও হয় ১৯১৬ সালে। স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত এই উপন্যাসে একদিকে আছে জাতিপ্রেম ও সংকীর্ণ স্বাদেশিকতার সমালোচনা, অন্যদিকে আছে সমাজ ও প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নারী পুরুষের সম্পর্ক; বিশেষত পরস্পরের আকর্ষণ-বিকর্ষণের বিশ্লেষণ।
এতো সংক্ষেপে কী আর সাগরতলের ঐশ্বর্যের বর্ননা হয়? বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে কী করেছেন সেও সবাই জানে। আমি বরং তাঁর কিছু প্রেম কাহিনী বলি-
প্রেমের জগতে তাঁর বিচরণ অসীম। সে হোক নারী প্রেম ।সে হোক ঈশ্বর প্রেম।কোন অংশেই তিনি কম নন।কোনো অসীম প্রেমের জন্য ছিলেন ক্ষুধার্ত আবার কখনো অপরিসীম প্রেমের প্রাপ্তিতে ভেসেছেন।
জীবনে বেশ কয়েকবার প্রেমের উত্তাল সমুদ্রে ভেসেছেন বিশ্ব কবি।ব্যক্তিগত জীবনের প্রেমের রেশই যোগ হয়েছে তাঁর সৃষ্টিকর্মে।জীবনের দর্শন খুঁজে পেতে কবি প্রেমকে দেখেছেন ।তাঁর সঙ্গীত ও সাহিত্যকর্মের বড় অংশ জুড়ে প্রেম প্রেম। সেই প্রেম সবার জন্য এবং অতি পবিত্র।
১৪ বছর বয়সে কিশোর রবীন্দ্রনাথ প্রথম নারীর সান্নিধ্যে আসেন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর সাহচর্যে। রবীন্দ্রনাথের স্থপতি বলে অভিহিত করা হয় জ্যোতি দাদার সহধর্মিণী কাদম্বরী দেবীকে। কাদম্বরী এবং রবীন্দ্রনাথ দুজনে প্রায় সমবয়সী ছিলেন। বয়ঃসন্ধির সংবেদনশীল পর্যায়ে কিশোর মনে ছাপ ফেলতে কাদম্বরীর ভূমিকা ছিল অনন্য। নতুন বৌঠান সম্পর্কে দেবর রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল শুরু থেকেই। কবি তাঁর সাহিত্য চর্চার অনুরাগী ছিলেন। কবির অনেক সাহিত্য সৃষ্টি, কবিতা এই নিঃসঙ্গ, রিক্ত নারীটিকে ঘিরেই।
কবি তাকে নিয়ে ভারতী পত্রিকায় লিখলেন, ‘সেই জানালার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রু জলে সিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন, সে আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে। সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল। সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সে-ই তো যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল। তাহার সেই অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আর আমার রচিত গোটা কতক অর্থহীন হিজি-বিজি ছাপা হইয়া গেল।’
অনেক রবীন্দ্র গবেষকই মনে করেন, এই লেখা প্রকাশের পরেই ঠাকুর বাড়িতে আগুন জ্বলে উঠেছিল। আর সে কারণেই রবীন্দ্রনাথের বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। এর কিছু দিন পরেই ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে কবির বিয়ে হয়। কিশোরী বৌ দিদির সঙ্গে বালক রবির সম্পর্ক ছিল সৌখিন ও খুনসুটির। দু’জনের মধ্যে বোঝাপড়ার কারণেই এই সুসম্পর্ক দাঁড়িয়ে ছিল। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘চারুলতা’ আর নষ্টনীড়ে সেই ছাপই যেন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরে ‘ভগ্ন হৃদয়’ গীতি কাব্যের উৎসর্গপত্রে তাকে লক্ষ্য করে অনায়াসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডাকতেন ‘হেকেটি ঠাকরুন’ বলে। বৌঠান তাকে ডাকতেন ‘ভানু’ নামে। এ নামকরণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘আমরা যাহাকে ভালবাসি, তাহার একটা নতুন নামকরণ করিতে চাই।’ রবীন্দ্র জীবনে এ নিখাঁদ ভালোবাসাবাসি করুণ পরিণতি লাভ করে কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার পর। ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল কাদম্বরী দেবী জোড়া সাকোঁর ঠাকুর বাড়িতে আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন। অসংখ্য রবীন্দ্র রচনার মধ্যে অন্তত সাতটি গ্রন্থ একই ব্যক্তি কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এক লেখক তাঁর সাত-সাতটি গ্রন্থ একই ব্যক্তির উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন এ ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বোধ করি বিরল। রবীন্দ্র মানসে কাদম্বরী দেবী সেই বিরলতম ব্যক্তিত্ব।
মারাঠি তরুণী আন্না তড়খড় রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়েন। ১৭ বছরের তরুণ কবি মারাঠি তরুণীর রোমান্টিক প্রেমে সরবে না হলেও নীরবে যে সাড়া দিয়েছিলেন তাঁর প্রমাণ মেলে যথেষ্ট। প্রেমিকা আন্না তড়খড়ের নতুন নাম দিলেন রবীন্দ্রনাথ ‘নলিনী’। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে বড় আন্না তড়খড় অসামান্য সুন্দরী, বিদূষী, বুদ্ধিমতি, রূপ লাবণ্যে ভরপুর এবং বিলাত ফেরত তরুণী। এর কাছে ইংরেজি বলা-কওয়ার পাঠ নেয়ার সঙ্গে বোধ করি প্রেমের পাঠও রবীন্দ্রনাথ নিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, নলিনী নামটি রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় ছিল।
কবির প্রথম জীবনে রচিত বহুকাব্য-কবিতায়-নাটকে এই নামের উল্লেখ পাওয়া যায় সে কারণেই। আন্নার জন্য কবি কাব্যের ‘গাথুনি’তে রচনা করেছিলেন- ‘শোন গো নলিনী খোল গো আঁখি’। অচেনা মহল থেকে আপন মানুষের যে দূতী এসে প্রথম প্রথম হৃদয় দখলের সীমানা বড় করে দিলেন- তিনি নিঃসন্দেহে আন্না। প্রায়ই তিনি আসতেন তরুণ কবির কাছে। কত ছুতো করেই না কবির কাছে আসতেন। কবিকে বিমর্ষ দেখলে দিতেন সান্ত্বনা।
আর প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে জড়িয়ে চোখ টিপে ধরতেন। পরে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন দিলীপ কুমার রায় কে (দ্র: তীর্থ শঙ্কর)- আন্না বলে বসলেন- ‘আহা কী এতো ভাবো আকাশ পাতাল’। অথবা কখনও বা প্রস্তাব পেশ করতেন, আচ্ছা আমার হাত ধরে টানোতো, টাগ-অফ-ওয়ারে দেখি কে জেতে? শেষে একদিন বলে বসলেন আচমকা, ‘জানো কোন মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার।’
আর তারপর আন্না রবীন্দ্রনাথের আরাম কেদারাটিতে ঢলে পড়লেন নিদ্রাবশে। এক সময় কপট নিদ্রা টুটল। করুণ বিপদে নয়ন পল্লব সিক্ত করে আন্না দেখলেন- তার দস্তানা দুটি তার হাতেই আছে, কেউ চুরি করেনি। কবির লজ্জা কুণ্ঠা স্বভাব আর ভীরুতা এগোতে দেয়নি তাঁকে প্রেমের অনাচরিত পথে। হায় ভীরু প্রেম! কিন্তু কখনও ভোলেননি তাঁকে।
আন্না তড়খড় ছিল ডা. আত্মারাম পান্ডুরংয়ের কন্যা। আন্নার সঙ্গে কবির প্রেম ছিল মাত্র এক মাসের সামান্য কিছু বেশি সময়, জানা যায় বহুদিন তাঁর সঙ্গে কবির যোগাযোগ ছিল পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে।
নলিনী সম্পর্কে গত বছর আমি আরেকটা লেখা দিয়েছি। মূল বিষয় ঠিক থাকলেও কোথায় যেন ভিন্নতাও আছে। এ শুধু প্রেমের শুরু …. সব একবারে বলতে গেলে শেষ হবে না পাঠকের।