মায়ের জন্য একদিন; প্রতিদিন
ধরাধামে সবচেয়ে মধুরতম উচ্চারণ হলো ‘মা’, এ নিয়ে কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। পৃথিবীতে মায়ের তুলনা কেবলই মা। পরম মমতামাখা এই মা শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ের অতল গহীনে যে আবেগ ও অনুভূতির সৃষ্টি হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। মাকে সকল ধর্মই দিয়েছে মহান মর্যাদা।
ইসলাম ধর্মের এই বাণী সকলেই জ্ঞাত আছেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত‘। রাসুল (সা.)-এর জমানায় বিখ্যাত এক আশেকে রাসুলের ঘটনা অনেকেই জানেন। যিনি প্রিয় নবীজি (সা.)-কে দেখেননি। সেই আশেকে রাসুলের নাম হজরত ওয়াইস আল করনি (রা.)। প্রিয় নবীজি (সা.)-এর জমানায় বসবাস করেও তিনি সাহাবি হতে পারেননি কেবল মায়ের সেবা করার কারণে। তবে এতে করে তাঁর মর্যাদা কমেনি; বরং তিনি সম্মানিত হয়েছেন। একবার ওয়াইস করনি (রা.) প্রিয় নবীজির কাছে এই মর্মে খবর পাঠালেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আপনার সঙ্গে আমার দেখা করতে মন চায়; কিন্তু আমার মা অসুস্থ। এখন আমি কী করতে পারি?’ নবীজি (সা.) উত্তর পাঠালেন, ‘আমার কাছে আসতে হবে না। আমার সাক্ষাতের চেয়ে তোমার মায়ের খেদমত করা বেশি জরুরি ও বেশি ফজিলতের কাজ।’ শুধু তা-ই নয়, নবীজি (সা.) তাঁর গায়ের একটি জুব্বা ওয়াইস আল করনির জন্য রেখে যান এবং বলেন, ‘মায়ের খেদমতের কারণে সে আমার কাছে আসতে পারেনি; আমার ইন্তেকালের পর আমার এ জুব্বাটি তাকে উপহার দেবে।’ নবীজি (সা.) জুব্বাটি রেখে যান হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে এবং তিনি বলেন, ‘হে ওমর! ওয়াইস আল করনির কাছ থেকে তুমি দোয়া নিয়ো।’ কেবল মায়ের সেবা ও খেদমত করার মাধ্যমে রাসুলের নিকট এমন সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হন।
খ্রিষ্টধর্মের পবিত্র বাইবেলে রয়েছে মায়ের সমাদরের কথা। “তোমার পিতাকে ও তোমার মাতাকে সমাদর করিও।”-যাত্রাপুস্তক ২০:১২। পবিত্র বাইবেলে বলা হয়, প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের উচিত, “তারা যেন প্রথমে নিজ নিজ পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করার” বা যত্ন নেওয়ার “মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি দেখায়। তারা যেন বাবা-মাকে তাদের প্রাপ্য প্রদান করে। কারণ এটা ঈশ্বরের দৃষ্টিতে প্রীতিজনক।” (১ তীমথিয় ৫:৪)।
সনাতন ধর্মে মায়ের মর্যাদা অনেক উঁচুতে। চণ্ডীতে বলা হয়েছে-“যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।” সন্তানের নিকট মায়ের স্থান কোথায় হবে সে বিষয়ে সনাতন শাস্ত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। “উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য্য আচার্য্যণাং শতং পিতা। সহস্রন্ত্ত পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে।” (মনুসংহিতা, ২/১৪৫) অর্থ্যাৎ দশজন উপাধ্যায় থেকে একজন আচার্যের গৌরব বেশি। একশত আচার্যের থেকে পিতার গৌরব বেশি এবং সহস্র পিতা অপেক্ষা মাতা সম্মানীয়া।
বৌদ্ধধর্মে পঞ্চ অনন্ত গুণীর গুণের সাথে মাতা পিতার গুণ তুলনা করা হয়েছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সেই সেরা জীবের সৃষ্টিকর্তা হল তাঁর মাতা পিতা। আবার পূর্বাচার্যগণ পিতা মাতাকে আদি গুরু হিসেবে বর্ণনা করেন এবং ব্রহ্মার সাথে তুলনা করা হয়েছে। শাস্ত্রে আছে – ব্রহ্মাতি মাতাপিতরো পূব্বাচরিযাতি বুচ্চরে, আহুনেয্যা চ পুত্তানং পহায অনুকম্পকা। -সন্তানের নিকট মাতা পিতা সর্বজীবের হিতাকাঙ্খী ব্রহ্মতুল্য। মাতা পিতা আদি গুরু এবং সর্বদা পূজনীয়। শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে যে মাতা পিতা সন্তান সন্ততির নিকট সাক্ষাৎ দেবতা বা স্বয়ং ব্রহ্ম। মাতা পিতাই শিক্ষার আদি উৎস, আদি গুরু রুপে বর্ণিত। তাঁদের প্রাথমিক শিক্ষাই সন্তানেরে আজীবন প্রাধান্য লাভ করে।
মা শব্দটি মাত্র একটি অক্ষরে গঠিত হলেও এর ব্যাপকতা অনন্য। এই শব্দের চেয়ে অতি আপন শব্দ আর নেই। জন্মের পর মানুষের মুখে এই শব্দই বেশি উচ্চারিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবস উদযাপন করা হয়। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দিনে দিবসটি উদযাপন করে। সাধারণত মার্চ কিংবা মে-তেই পালিত হয় ‘মাদার’স ডে’। এই দিনটিতে মায়ের জন্য বিশেষ কিছু করেন সন্তানরা। ‘মাদার’স ডে’ কীভাবে এলো? কেন পালন করা হয় এই মা দিবস? এর গুরুত্ব কী, তা হয়তো অনেকেরই অজানা।
আমেরিকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটন শহরে ১৯০৭ সালের ১২ মে প্রথমবার পালিত হয় ‘মাদার’স ডে’ বা মা দিবস। এই দিনটি পালনে রয়েছে এক ইতিহাস। ভার্জিনিয়ায় অ্যান নামে এক শান্তিবাদী সমাজকর্মী ছিলেন। তিনি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। তিনি ‘মাদার’স ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব বানিয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতেন। নারীদের স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করতেন। অ্যান ছিলেন খুবই ধর্মপ্রাণ। অ্যানের একটি মেয়ে ছিল, যার নাম আনা মারিয়া রিভস জার্ভিস। একদিন ছোট মেয়ের সামনেই অ্যান হাত জোড় করে বলেছিলেন- ‘আমি প্রার্থনা করি, একদিন কেউ না কেউ, কোনো মায়েদের জন্য একটা দিন উৎসর্গ করুক। কারণ তারা প্রতিদিন মনুষ্যত্বের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন। এটি তাদের অধিকার।’ মায়ের সেই প্রার্থনা হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায় অ্যানার। অ্যানের মৃত্যুর দিনটিকে সারাবিশ্বের প্রতিটি মায়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন তিনি। তারপর থেকে মায়েদের প্রতি সম্মানে পালিত হয়ে আসছে মা দিবস।
১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা দিবস’ ঘোষণা করেন। এ বছর ১৪ মে দ্বিতীয় রোববার তারিখ হওয়ায় এদিন পালন করা হবে মা দিবস। যদিও মাকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে কোনো দিনক্ষণের প্রয়োজন হয়না তারপরও একদিনের আনুষ্ঠানিকতা অজস্র গুরুত্ব বহন করে। মায়ের জন্য প্রতিদিনই সন্তানের ভালোবাসা থাকে হৃদয়ের অতল থেকে।
মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস পালনের পেছনের কারণ কী?
কারণ হলো আনা জার্ভিস নিজের মায়ের মতো দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সব মাকে স্বীকৃতি দিতে এই দিবস পালনের প্রচার শুরু করেন তাঁর মায়ের মৃত্যুর দিনটিকে কেন্দ্র করে। ১৯০৫ সালে তিনিই প্রথম মা দিবসকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য লড়াই শুরু করেছিলেন। তার এই প্রস্তাব শুরুর দিকে খারিজ করে দিয়েছিল মার্কিন কংগ্রেস। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। সময়ের পরিক্রমায় যুক্তরাষ্ট্রের সকল প্রদেশ তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে ওই দিন ছুটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস পালন করে আসছে। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে মা দিবস পালিত হয় সেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ দিনে। গ্রিসে মা দিবস পালন করা হয় ফেব্রুয়ারি মাসে ২ তারিখে। ব্রিটেনে মা দিবস পালিত হয় মার্চ মাসের চতুর্থ রোববার। থাইল্যান্ডে রানি সিরিকিটের জন্মদিনে আগস্ট মাসে পালন করা হয় মা দিবস। তবে বাংলাদেশ সহ অধিকাংশ দেশেই মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস পালন করা হয়।
দেশ ও সংস্কৃতিভেদে মা দিবস উদযাপনে ভিন্নতা দেখা যায়। দিনটিতে নানা বয়সী মানুষ মা ও মাতৃস্থানীয়দের স্মরণ করেন। মাতৃস্থানীয় বলতে বোঝায় সৎমা, শাশুড়ি কিংবা মাতৃতুল্য কোনো অভিভাবক। তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে পশ্চিমা দেশগুলোতে কার্ড, ফুল বা কেক উপহারের প্রচলন আছে। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মায়েদের জন্য উৎসর্গ করে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়।