একজন আলী ভাইয়ের গল্প
মার্কিন মুল্লুকের ব্যস্ত জীবনে প্রতিটি ‘মুহূর্ত’ যেন রুটিনবাঁধা। জীবনযুদ্ধে ক্যালেন্ডারের প্রতিটি ‘দিনক্ষণ’ থাকে যেন পূর্বনির্ধারিত।
প্রতিটি মানুষ জীবন আর জীবিকার তাগিদে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে স্ত্রী-সন্তান আর পরিবারের সদস্যদের জন্য। রুটিনবাঁধা জীবন ব্যবস্থায় নিজের কাজকর্ম আর নিজের সংসারের সুবিধা-অসুবিধায় আবদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী বাংলাদেশি পরিবারগুলো।
আত্মকেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থায় নিজের পরিবার-পরিজন ছাড়াও অনেকে কমিউনিটির বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন কমিউনিটির অতিপরিচিত মুখ সজল আলী।
কমিউনিটিতে যিনি ‘আলী ভাই’ হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘ দুই দশক ধরে নীরবে-নিভৃতে মিশিগান স্টেটে বাংলাদেশি কমিউনিটির বিপদগ্রস্ত মানুষের ‘মুশকিল আসানে’ আর্বিভূত হয়েছেন মানবতার ফেরিওয়ালা খ্যাত একজন ‘আলী ভাই’।
বিপদগ্রস্ত যে কোনো ব্যক্তি বা পরিবার সেলফোনে কল দিলেই বিপদগ্রস্তদের ঠিকানায় হাসিমুখে ছুটে আসছেন সবার প্রিয় আলী ভাই। সাধ্যমতো সহযোগিতা করে আবার অন্য বিপদগ্রস্তের ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে যাচ্ছেন অন্যখানে। এভাবে কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়েছে আলী ভাইয়ের মানবতার গল্প। প্রাথমিক বিপদগ্রস্ত মানুষদের চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের চেম্বার, গুরুতর অসুস্থতাজনিত কারণে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া বিভিন্ন কাজের জন্য জব এজেন্সির সঙ্গে মিট করে দেওয়াই তার কাজ।
সাশ্রয়ী রেন্টে বাসাবাড়ি খুঁজে দেওয়া, যাদের গাড়ি নেই তাদের ফ্রি রাইড দিয়ে সহযোগিতা করা। অভাবগ্রস্ত পরিবারের কেউ মারা গেলে দাফন কাজের আনুষ্ঠানিকতাসহ সাধ্যমতো সহযোগিতা প্রতিনিয়ত করে থাকেন। এছাড়া মিশিগানে একাধিক মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার পেছনে রয়েছে তার অন্যতম বিশেষ অবদান। সজল আলীর এই মানবিক কর্মকাণ্ড কমিউনিটির মানুষের কাছে প্রশংসা কুড়াচ্ছে । সজল আলীর মানবিক এই কর্মকাণ্ড স্টেটজুড়ে হলে হ্যামট্রামিক ও ডেট্রয়েট সিটিতে বসবাসকারী বাংলাদেশি কমিউনিটির বিপদগ্রস্তদের মাঝে তার এই মানবিক সেবা অব্যাহত রয়েছে।
বিশেষ করে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে ‘আলী ভাই’ হিসেবে খ্যাত মানবতাবাদী আলী ভাইয়ের পুরো নাম শেখ সজল আলী। বাড়ি বাংলাদেশের সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার রাজনপুর গ্রামে। ১৯৪৪ সালে অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্র আসেন তিনি। নিউইয়র্ক একযুগ বসবাস করলেও ব্যবসায় লসের কারণে নিউইয়র্ক শহরে পরিবার নিয়ে বসবাস কঠিন হয়ে উঠলে ২০০০ সালে নিউইয়র্ক থেকে মিশিগানে মুভ করেন সজল আলী।
প্রথম অবস্থায় মিশিগানে ফ্যাক্টরিতে কাজ করলেও পরে ট্যাক্সি চালনাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি। পাশাপাশি কমিউনিটির বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে শুরু করেন। দীর্ঘ দুই দশক ধরে কমিউনিটির বিপদগ্রস্ত মানুষের কল্যাণে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন সজল আলী। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী, তিন কন্যা ও একপুত্র সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। বর্তমানে দুই মেয়ে নার্সিং পেশায় যুক্ত রয়েছেন। একমাত্র পুত্র কুরআনে হাফেজ। ছোট মেয়ে মাধ্যমিক স্কুলে অধ্যায়নরত।
সজল আলীর মানবতার কথা বলতে গিয়ে নিউইয়র্কে বসবাসকারী আলী মিয়া বলেন, এই বৃদ্ধ বয়সে কাজের সন্ধানে পরিবারকে নিউইয়র্ক রেখে মিশিগানে ছুটে আসি। বাসাভাড়া নেই আত্মীয়ের বেইজমেন্টে।
একদিন রাতে বুকে ব্যথা শুরু হলে আলী ভাইকে কল দিলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে আসেন। আলী ভাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে আমার বাইপাস সার্জারি হয়। আমার পরিবার নিউইয়র্ক থেকে আসার আগপর্যন্ত আলী ভাই আমার দেখভাল ও সেবায় ব্যস্ত ছিলেন।
মিশিগানে বসবাসকারী শুকুর আলী বলেন, ব্যস্ত জীবনে আলী ভাই একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। মানুষের উপকার করা তার নেশায় পরিণত হয়েছে। ছেলেমেয়েদের তার মতো করেই গড়ে তুলেছেন।
কমিউনিটি লিডার ইঞ্জিনিয়ার আহাদ আহমেদ বলেন, সজল আলী কমিউনিটির জন্য অনেক দিন ধরে কাজ করছেন। সজল আলীর মতো সমাজের কল্যাণে সবাইকে মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
এ বিষয়ে সজল আলী বলেন, কোনো মানুষই সারা জীবন বিপদগ্রস্ত থাকে না। যে কোনো নতুন পরিবেশে খাপখাইয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে। মানব জীবনে যদি মানুষের বিপদে আপদে পাশে না থাকলাম সে জীবন মূল্যহীন।
মানুষের জন্য কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই। সবই আল্লাহর ইচ্ছা, নবী ও রসুলের দেখানো পথে আমাদের চললে ইহকাল ও পরকালে আমাদের কল্যাণ সম্ভব। আল্লাহ পাক সবাইকে মানুষের কল্যাণে কাজ করার তওফিক দান করুন।