‘আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যত বেশি অস্থির হয় এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ যত বাড়ে, চীন-ইইউ সম্পর্কের বৈশ্বিক তাত্পর্যও তত বাড়ে।’
বৃহস্পতিবার চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বেইজিংয়ে ইউরোপীয় পরিষদের প্রেসিডেন্ট মিশেলের সাথে বৈঠক করেন। প্রেসিডেন্ট সি চীন-ইইউ সম্পর্কের উন্নয়নের বিষয়ে চার দফা দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেন।
তিনি আশা করেন যে, ইইউ চীনের আধুনিকীকরণের পথে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হবে। মিশেল বলেন, ইইউ চীনের একটি নির্ভরযোগ্য ও অনুমানযোগ্য অংশীদার হতে ইচ্ছুক। এর মধ্য দিয়ে চীন-ইইউ সম্পর্কের উন্নয়নে দু’পক্ষের ইতিবাচক আশা-আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র কুড়িতম জাতীয় কংগ্রেসের পর, চীনা শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও ইইউ’র শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে এবারই প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক হলো।
এটি ইউরোপীয় পরিষদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মিশেলের প্রথম চীন সফরও বটে। সম্প্রতি ইউরোপীয় পরিষদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, উত্তেজনাপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের প্রেক্ষাপটে, এই সফর ইইউ-চীন যোগাযোগের জন্য একটি ‘সময়োপযোগী সুযোগ’। ফরাসি ‘লা ফিগারো’ পত্রিকা বলেছে, মিশেলের সফর চীন ইস্যুতে ইউরোপের অবস্থানসম্পর্কিত।
চীন ও ইউরোপ হল বিশ্বশান্তি বজায় রাখার জন্য দুটি প্রধান শক্তি, অভিন্ন উন্নয়নের জন্য দুটি প্রধান বাজার এবং মানবজাতির অগ্রগতির জন্য দুটি প্রধান সভ্যতা। চীন সবসময় চীন-ইইউ সম্পর্ককে কৌশলগত উচ্চতা এবং দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে আসছে।
বৈঠকের সময়, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সিপিসির কুড়িতম জাতীয় কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল এবং চীনা বৈশিষ্ট্যময় আধুনিকায়নের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে, চীনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন।
ব্যাখ্যায় চীনের নিজস্ব ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার কথা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি আন্তর্জাতিক সমাজকে একটি ইতিবাচক ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে। চ্যালেঞ্জ ও সংকটের মুখোমুখি বিশ্বের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে ইউরোপসহ আন্তর্জাতিক সমাজের জন্য এটা যেন চীনের ‘আশ্বাস’।
ইউরোপের কোনো কোনো রাজনীতিবিদ চীনের সাথে ইউরোপের প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্বকে বাড়িয়ে দেখতে অভ্যস্ত। তাঁরা চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন এবং এমনকি, চীনের সাথে একটি ‘নতুন শীতলযুদ্ধ’ শুরুর কথা বলেন। এ ধরনের আচরণ চীন-ইইউ সম্পর্কের ক্ষতি করেছে এবং ইউরোপের নিজস্ব স্বার্থেরও ক্ষতি করেছে।
‘সঠিক বোঝাপড়া বজায় রাখা’, ‘সঠিকভাবে মতবিরোধ নিয়ন্ত্রণ করা’, ‘উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা চালানো’, ‘আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও সহযোগিতা জোরদার করা’ হচ্ছে এবারের বৈঠকে চীন-ইইউ সম্পর্কের উন্নয়নের বিষয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট সি’র উত্থাপিত চার দফা প্রস্তাব। উভয় পক্ষের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এ প্রস্তাবে।
বৈঠকের সময় মিশেল প্রতিশ্রুতি দেন যে, ইইউ ‘এক-চীন নীতি’ মেনে চলবে, চীনের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করবে এবং চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। সরাসরি সংলাপ ও সহযোগিতা জোরদার, ভুল বোঝাবুঝি কমানো এবং সংলাপ ও সহযোগিতা জোরদার করার মাধ্যমে চীনের সঙ্গে পরবর্তীতে উচ্চ পর্যায়ের বিনিময় জোরদার করতে ইইউ ইচ্ছুক বলেও জানান তিনি। এসব প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হলে চীন ও ইউরোপের সম্পর্ক দৃঢ় হতে পারে।
অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা সর্বদাই চীন-ইইউ সম্পর্কের মূল বিষয়। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে, চীন ও ইউরোপের বাণিজ্যের পরিমাণ ৭১১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬.৩ শতাংশ বেশি। ইইউ’র বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার চীন এবং ইইউ চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার।
বিশ্বের দুটি বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দায়িত্ব রয়েছে সত্যিকারের বহুপাক্ষিকতা বজায় রাখা এবং বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নকে যৌথভাবে রক্ষা করার। প্রকৃতপক্ষে, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্যের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের বিষয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। চীন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে উন্নয়ন কৌশলের সংযুক্তিকে স্বাগত জানায়।
ইউক্রেন সংকটের প্রতিক্রিয়ায়, চীন একটি ভারসাম্যপূর্ণ, কার্যকর ও টেকসই ইউরোপীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে। সব মিলিয়ে চীন-ইউরোপ সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও জোরদার হবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
(ওয়াং হাইমান ঊর্মি, সাংবাদিক, বাংলা বিভাগ, চায়না মিডিয়া গ্রুপ, বেইজিং, চীন।)
আরও পড়ুনঃ ‘এশীয় মানবাধিকার ফোরাম: পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকার’ প্রসঙ্গ
মন্তব্য করুন