ইসলামে সফর মাসের ফজিলত
ইসলামি হিজরি চান্দ্রবর্ষের দ্বিতীয় মাস সফর? আরবি ‘সিফর’ মূল ধাতু থেকে উদ্ভূত হলে ‘সফর’ মানে হলো শূন্য, রিক্ত। আর ‘সাফর’ ক্রিয়া মূল থেকে উৎপন্ন হলে অর্থ হবে হলুদ, হলদেটে, তামাটে, বিবর্ণ, ফ্যাকাশে, ঔজ্জ্বল্যশূন্য, দীপ্তিহীন, রক্তশূন্য ইত্যাদি।
সফর মাসের নামকরণ : সফর আরবি শব্দ। এর অর্থ খালি, শূন্য। মহররম মাসে যুদ্ধ বন্ধ থাকায় আরবরা এ মাসে দলে দলে যুদ্ধে যেত। ফলে তাদের ঘর খালি হয়ে যেত। আর আরবিতে ‘সফরুল মাকান’ বলতে এমন জায়গা বুঝায় যা মানুষ শূন্য। এজন্য এ মাসের নামকরণ করা হয় ‘সফর’।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২টি, যা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী সেই দিন থেকে চালু আছে যে দিন আল্লাহ তায়ালা আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। এটাই দ্বীন (এর) সহজ সরল (দাবী)।’-( সুরা তাওবা,৩৬)
ইসলাম পূর্ব জাহেলি যুগে আরবে সফর মাস ঘিরে নানা কুসংস্কার প্রচলিত ছিল, এবং এ মাসকে অশুভ মনে করা হতো। অথচ আল্লাহর সৃষ্ট প্রতিটি দিন ও মাসই অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। কোনও সময় বা মাসের সঙ্গে মঙ্গল অমঙ্গলের সম্পর্ক নেই। ইসলামি বিশ্বাস মতে, কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ভর করে মানুষের বিশ্বাস ও কর্মের উপর।
এ বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘রোগে সংক্রমিত হওয়া বলতে কিছুই নেই, কোনো কিছু অশুভ নয়। প্যাঁচার মধ্যে কুলক্ষণ নেই এবং সফর মাসেও কোনো অশুভ কিছু নেই।’-(বুখারি, হাদিস: ৫৭৬৯)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তারা বলল, তোমাদের কর্ম দোষের দুর্ভাগ্য তোমাদের সঙ্গেই আছে।’- (সূরা ইয়াসিন: আয়াত ১৯) অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির কল্যাণ ও অকল্যাণের পরোয়ানা আমি তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছি।-(সূরা বনী ইসরাঈল, ১৩)
অতএব কোনও বিশেষ সময়ের সঙ্গে অমঙ্গল বা অকল্যাণের সম্পর্ক নেই। তাই আল্লাহ তায়ালার রহমত ও বরকত পেতে হলে এ মাসেও বেশি বেশি ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত ইবাদতের পাশাপাশি নফল ইবাদতে মশগুল থাকা উচিত । আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (সুরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১-৩) অথার্ৎ কল্যাণ-অকল্যাণ ও ক্ষতি থেকে সেই ব্যক্তিরা নিরাপত্তা লাভ করবে, যারা চারটি বিষয় নিষ্ঠার সাথে পালন করে ঈমান, সৎকর্ম, অপরকে সত্যের উপদেশ এবং সবরের উপদেশদান। তারাই এই ক্ষতির কবল থেকে মুক্ত। কেননা, মানুষের পার্থিব জীবন যেমনভাবেই অতিবাহিত হোক না কেন, মৃত্যুর পর সে চিরস্থায়ী নেয়ামত এবং জান্নাতের চিরসুখ লাভ করে ধন্য হবে।
ফজিলত : প্রতিটি দিন ও মাসই ফজিলতপূর্ণ, মানুষের জীবন হলো সময়েরই সমষ্টি। সফর মাসও জীবনেরই অংশবিশেষ সুতরাং সফর মাসও ফজিলতময় ও বরকতপূর্ণ। অতএব আল্লাহ তাআলার রহমত ও বরকত পেতে হলে এ মাসেও বেশি বেশি আমল করতে হবে। ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত যথাযথ ভাবে আদায় করার পাশাপাশি নফল ইবাদতে মশগুল হতে হবে। কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, নফল ইবাদত, তাসবিহ-তাহলিল পাঠ করা এ মাসেও খুবই পুণ্যের কাজ ।
তবে ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে সফর মাসকে ঘিরে ছিল নানা ধরনের কুসংস্কারের ছড়াছড়ি। মানুষ মনে করতো, যত অশুভ, অকল্যাণ, বিপদাপদ সব নেমে আসে এ মাসে। এ মাসে বিয়ে শুভ হয় না, ব্যবসা মন্দা যায়, অন্যত্র যাত্রা অমঙ্গল হয়? এ ছাড়াও শিষ্ট-অনিষ্ট, সৎ-অসৎ, রোগ সংক্রমণ এবং আঞ্চলিক ভাষায় ছাঁৎ-কুছাঁৎ যাবতীয় বহু কুধারণার শিকার ছিল তারা। ইসলাম এসব কুসংস্কারের অবসান ঘটিয়েছে? আল্লাহ তাআলা বলেন, “এরপর যখন শুভদিন ফিরে আসে, তখন তারা বলতে আরম্ভ করে যে, এটাই আমাদের জন্য উপযোগী? আর যদি অকল্যাণ এসে উপস্থিত হয় তবে তাতে মুসার এবং তার সঙ্গীদের অলক্ষণ বলে অভিহিত করে।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ১৩১) আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে কুলক্ষণ, অশুভ সব বিষয়ের নিন্দা করেছেন এবং এসব অসার ধারণা যে সব যুগেই ছিল; তারও প্রমাণ মিলে আয়াত থেকে? নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সংক্রমক ব্যাধি, কুলক্ষণ, অনাহারে পেট কামড়ানো পোকা ও হামাহ- এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই ।” (মুসলিম)
প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য হলো, শিরক-বিদআত বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান লাভ করা এবং খুব সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। মনে রাখতে হবে, মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষণ অমূল্য রত্ন। দিন, মাস ও বছরের পিঠে চড়ে যা এগিয়ে চলছে অবিরত।
সময়কে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি মানুষ তার ঠিকানা করে নেয় জান্নাত বা জাহান্নাম। সুতরাং সময়ের ভেতর শুভ-অশুভের দেয়াল তুলে কখনও ইবাদতে মগ্ন হওয়া, কখনও ছেড়ে দেওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। প্রতিটি দিন ও মাসই ফজিলতপূর্ণ ও বরকতপূর্ণ ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফর মাসের শেষ দিকে প্রচন্ড অসুস্থ ছিলেন। সফর মাসের শেষ বুধবার তিনি অনকেটাই সুস্থতা লাভ করেন এবং এ দিনে সাত মশক পানি দ্বারা গোসল করেন। মসজিদে নববীতে হাজির হয়ে ইমামতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ খুশিতে অনেক সাহাবি বিভিন্নভাবে দান-সাদকা করছেন। এ দান-সাদকা নিঃসন্দেহে উত্তম কাজ। মুসলমানগণ এই দিবসটি আখেরি চাহার সোম্বার হিসেবে পালন করে থাকেন। সফর মাসের শেষ বুধবারটি আখিরী চাহার সোম্বার নামে খ্যাত ।
আখিরী চাহার সোম্বা কী?
আখেরী চাহার সোম্বা। এটি অতিপরিচিত একটি ফারসি বাক্য। আখের অর্থ শেষ। আর চাহার সোম্বা মানে বুধবার। মাহে সফরের সমাপনি বুধবারকে আখেরী চাহার সোম্বো হিসেবে বুযুর্গানেদ্বীন নামকরণ করেছেন। কেননা হিজরি ১১ সনের শেষ বুধবারটি পূণ্যবান মুসলমানদের জন্য একটি স্বরণীয় দিন হিসাবে বিবেচিত। কেননা এইদিনে মানবতার মুক্তির দূত রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুলে করিম সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ বারের মতো সুস্থতা বোধ করেছিলেন।
আখিরী চাহার সোম্বার কী হয়েছিলো?
এ দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘদিন অসুস্থতা অনুভব করার পর পবিত্র আখিরী চাহার সোম্বার (সফর মাসের শেষ বুধবার) সকালে সুস্থতা অনুভব করেন।।
এ মর্মে বর্ণনা রয়েছে যে- হাদিস পাকে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেছেনঃ-“নবি করিম সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে আসার পর রোগ আরো বেড়ে গেলো। তখন তিনি ইরশাদ করলেন, এমন সাতটি মশকের পানি আমার উপর ঢাল যে গুলোর বাঁধন খোলা হয়নি। তাহলে হয়তো লোকদেরকে আরো কিছু উপদেশ দিতে পারবো। অতঃপর নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তাঁর মহিয়সী স্ত্রী হযরত হাফসার গামলায় বসিয়ে আমরা তাঁর উপর মশকের পানি ঢালতে লাগলাম।
হুযুর ইশারা করে জানালেন, আমাদের কাজ শেষ। তিনি সুস্থ অবস্থায় লোকদের নিকট বের হয়ে গেলেন এবং তাদেরকে নামায পড়ালেন ও খুতবা দিলেন। (বুখারী, হাদিস: ৪৪৪২, আস-সুনানুল কোবরা, হাদিস: ৭০৪৬) ঐদিন তিনি উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) উনার হুজরা শরীফে ছিলেন। মাথা মুবারকে ব্যথা একটু কম অনুভূত হলে তিনি গোসল করেন? অতঃপর গোসল করতঃ তিনি খানা তৈরী আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন উন্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা জানালেন রুটি ও গোস্ত মজুদ আছে । তিনি তা পরিবেশন করলেন এবং আহলে বাইতগন ও উম্মুল মু’মিনীনরা সবাই সেখানে হাজির হলেন। তিনি সবাইকে সাথে নিয়ে নাস্তা করেন। অতঃপর হযরত সাহাবায়ে কিরামগণের খোঁজ-খবর নেন এবং খুশি প্রকাশ করে মসজিদে নববী শরীফে যান।
রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুস্থতা অনুভব করা দেখতে পেয়ে সাহাবীগণ অত্যন্ত আনন্দিত হন। এজন্য উনারা মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন এবং সে উপলক্ষ্যে সাধ্যমতো রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামর খেদমতে হাদিয়া তোহফা দেন। এছাড়া গরিব- মিসকিনদেরকেও দান সদকা করেন।
সেক্ষেত্রে: ১) হযরত আবু বকর সিদ্দিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সাত হাজার দিনার, ২) হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ৫০০০ দিনার, ৩) হযরত উছমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ১০ হাজার দিনার, ৪) হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ৩ হাজার দিনার এবং ৫) আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ১০০ উট ও ১০০ ঘোড়া হাদীয়া করেন?
(সীরাতে ইবনে হিশাম; দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা ৬৫৩, আদ দ্বীন ওয়াত তারীখুল হারামাইনিশ শারীফাঈন, পৃষ্ঠা ২৮১)
এই বিশেষ দিনের সুন্নতী আমলগুলি হলো:
১. নিয়ত করে গোসল করা,
২. পরিবার নিয়ে ভালো খাওয়া এবং অন্যদেরকে ভালো খাওয়ানো
৩. খুশি প্রকাশ করে সাধ্যমতো হাদিয়া পেশ করা,
৪. দান-ছদক্বা করা
তাজকেরাতুল আওরাত কিতাবে আরও উল্লেখ আছে, সফর মাসের শেষ বুধবার বা আখেরি চাহার সোম্বার দিন ফজর থেকে বা জামাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শেষে অর্থাৎ নিচের সাতটি আয়াত পড়ে শরীরে ফুঁ দিয়ে একটি পান পাতায় মিশক জাফরান দিয়ে এই আয়াত সাতটি লিখে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে সেই পানি কাউকে পান করালে সর্বপ্রকার বিপদ মুসিবত রোগবালাই থেকে নিরাপদ থাকবে।
আয়াত সাতটি হলো-
সালামুন ক্বাওলাম মির রাব্বির রাহিম। (সুরা ইয়াসিন: আয়াত ৫৮)
সালামুন আলা নূহিন ফিল আলামিন। (সুরা সফফাত: আয়াত ৭৯)
সালামুন আলা ইবরাহিম। (সুরা সফফাত: আয়াত ১০৯)
সালামুন আলা মুসা ওয়া হারুন। (সুরা সফফাত: আয়াত ১২০)
সালামুন আলা ইলইয়াসীন। (সুরা সফফাত: আয়াত ১৩০)
সালামুন আলাইকুম ত্বিবতুম ফাদখুলহা খালিদুন। (সুরা যুমার: আয়াত ৭৩) সালামুন হিয়া হাত্তা মাত্বলাইল ফাজ্রি। (সুরা কদর: আয়াত ৫) তাছাড়া প্রতি মাসে ৩টি রোজা পালনের কথা হাদিসে এসেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আ’মর ইবনে আ’স রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘প্রতি মাসে তিনটি করে সিয়াম পালন, সারা বছর ধরে সিয়াম পালনের সমান”। (বুখারীঃ ১১৫৯, ১৯৭৫), যেমন ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়ামে বিজের তিনটি রোজার প্রতি যত্নশীল হওয়া।
এছাড়াও প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার অভ্যাস করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুই দিন বিশেষ রোজা রাখতেন।
এ বিষয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- বৃহস্পতি ও সোমবার আল্লাহ তায়ালার সামনে বান্দার আমল উপস্থাপন করা হয়, তাই আমি চাই আমার আমল পেশ করার সময় আমি যেন রোজা অবস্থায় থাকি।-(সুনানে নাসায়ী, ২৩৫৮)
সর্বোপরি ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্কাদা যথাযথ পালন করার সাথে সাথে নফল দান সদকার প্রতি মনোযোগী হওয়া। নতুন মাসে বরকতের চাঁদ দেখে দোয়া পাঠ করা ।
আল্লাহ তাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি, হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা! তুমি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ নবির উম্মত হবার কল্যাণে আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে তোমার রহমতের বারিধারায় আমাদেরকে সিক্ত করো।
আল্লাহপাক আমাদেরও এই ফজিলতময় ও বরকতপূর্ণ সফর মাসে বেশি করে নেক আমল করার তাওফিকে রাফিক এনায়েত করুন ও সবাইকে প্রিয়নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তাওফিক দিন?