কমিউনিটিতে আলো ছড়াচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল ইসলাম

মিশিগানে বাঙ্গালি কমিউনিটির মধ্যে যে ক’জন আলোকিত ব্যক্তিত্ব আছেন তার মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার মো. সাইফুল ইসলাম অন্যতম। বহুগুণে গুনান্বিত এই ব্যক্তিত্ব দীর্ঘদিন থেকে কমিউনিটির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। সাদা মন আর বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই মানুষটি মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলা সংবাদ-এর। গল্প-আড্ডায় উঠে এসেছে তার জীবনের অনেক না জানা কথা। আর তা কাগজে তুলে এনেছেন ইকবাল ফেরদৌস।

› বাংলা সংবাদ-এ আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাঠকদের জন্য আপনার নাম পরিচয়টা তুলে ধরুন।
›› বাংলা সংবাদকে ধন্যবাদ। সকল পাঠককে জানাই সালাম এবং শুভেচ্ছা। আমি মো.সাইফুল ইসলাম। কাজ করছি মিশিগানের ইস্টার্ন মিশিগান ইউনিভার্সিসিটির সাথে। গত ১০ বছর থেকে জড়িয়ে আছি ওবামা কেয়ার-এর সাথেও। শুধু মাত্র বাংলাদেশি কমিউনিটির ভেতরেই আমার কাজ সীমাবদ্ধ।

› আপনার শিক্ষা জীবন কোথায় কিভাবে কেটেছে?
›› আমি ১৯৬৪ সালে এসএসসি পাস করেছি। তার পরে ১৯৬৬ সালে এইসএসসি পাশ করে বুয়েটে ভর্তি হই। তখন বুয়েটের নাম ছিলো ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি। সেখান থেকে ১৯৭০ সালে বের হবার কথা থাকলেও আমরা বের হয়েছি ৭১ সালে। তবে ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেটটি আমরা ফিরিয়ে দিয়ে পরে বুয়েটের সার্টিফিকেট নিয়েছিলাম। আমাদের ১টি পরীক্ষা বাকি থাকতেই আমাদের কিছু ক্লাসমেট মুক্তিযুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন, আমি পরীক্ষায় অংশ নিতে পেরেছিলাম। আমাদের সার্টিফিকেটে লেখা আছে ৭০ সালে বুয়েট থেকে পাস করে বের হয়েছি।
এরপরে আমি কোরিয়ান ও জাপানিজ কোম্পানিতে চাকরি করেছি। ব্যবসা করেছি দেশে বিদেশে। মালয়েশিয়াতে আমার একটা কনস্ট্রাকশন ফার্ম ছিল Daewoo-এর sub contractor হিসেবে কাজ করেছি। লিবিয়াতেও Daewoo-এর সঙ্গে আমি কাজ করেছি। তারপর চলে আসি আমেরিকায়। ২০০৪ সালে লাস ভেগাসে এবং ২০০৯ সালে মিশিগানে চলে আসি। এর পর থেকেই কমিউনিটির সাথে যুক্ত আছি।

› আপনার আমেরিকায় আসার গল্প শুনতে চাই
›› বড় মেয়ে রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছিল। ওর বিয়ের পরে এখানে এসে এপ্লাই করে আমাকে নিয়ে আসে ২০০২ সালে। তখন সে একটা ডিজাইন কোম্পানীর প্রজেক্ট মেনেজার ছিল। তবে ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত আমি যাওয়া-আসার মধ্যে ছিলাম। কিন্তু ২০০৯ এর জানুয়ারিতে আসার পরে আর দেশে যাইনাই। ছোট মেয়েটি ইঞ্জিনিয়ার, সে মিশিগানে কাজ করছে ১৫ বছর ধরে। সেই সুবাদে আমি এখানেই রয়ে গেলাম।

› আপনার পরিবারে সদস্য কতজন? তারা কে কি করছেন?
›› আমার দুই ছেলে দুই মেয়ে। বড় মেয়ে কানিজ ফাতেমা। সে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ছোট মেয়ে মারজিয়া ফাতেমা সে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বড় ছেলে সাজ্জাদুল ইসলাম ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করেছে। বর্তমানে লাস ভেগাসে একটা কন্সট্রাকশন ফার্মে কাজ করছে। ছোট ছেলে আব্দুল্লাহ ইসলাম একজন ডাক্তার, সে মিশিগান সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে কর্মরত আছে।

› আপনি লাস ভেগাস থেকে মিশিগানে আসলেন কেন?
›› লাস ভেগাসে থাকাকালীন সময় আমি যাওয়া আসা করতাম। ছোট মেয়েটি এখানে পরিবার নিয়ে থাকতো তাছাড়া তাকে একটু বেশিই ভালবাসতাম সেজন্যই মিশিগানে এসে থেকে গেলাম।

› আপনার কর্ম জীবনের শুরু কিভাবে?
›› আমি ৭২ সালে চাকরি শুরু করি মিলনার্স টিউবয়লস-এ ডেপুটি মেনেজার হিসেবে। তারপর আমি কোরিয়ান একটি কোম্পানির প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রায় চল্লিশ বছর কাজ করি। বাংলাদেশ বেইজেড কোম্পানীটি যখন যেখানে প্রজেক্ট করেছে তখন সেখানে আমাকে যেতে হয়েছে।
তারপর আমি ব্যবসা শুরু করেছি উধবড়িড় নামে একটা ইন্টারন্যাশনাল কোরিয়ান কোম্পানির সাথে।
এছাড়া সিলেটে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির Renovation সেই কাজও আমি করেছি কোরিয়ান হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সঙ্গে জয়েন ভেন্সারে।

› মিশিগানের কর্মজীবন সম্পর্কে বলুন।
›› মিশিগানে আসার পর প্রথমেই আল কুরআন একাডেমির প্রিন্সিপাল-এর দায়িত্ব গ্রহণ করি। প্রায় ৩ বছর দায়িত্ব পালন করেছি। এর পাশাপাশি আসলাম রিয়্যাল এস্টেট অ্যাডভান্টেজ-এর ফ্রন্ট ডেস্ক -এ কাজ করেছি প্রায় আট বছর।

› আল কুরআন একাডেমি মতো প্রতিষ্ঠানে সাধারণত ঈমাম বা ইসলামিক স্কলারা বড় দায়িত্বগুলো পালন করেন। একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আপনি কিভাবে এর সাথে যুক্ত হলেন?
›› আমার কিছুটা ইসলামিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। আমার আব্বা একজন মাওলানা ছিলেন তাই ছোটবেলা থেকেই ইসলামিক শিক্ষা পেয়েছি।
তাছাড়া পাকিস্তান ইসলামিক ছাত্র সঙ্গের সাথে স্টুডেন্ট পলিটিক্সে জড়িত ছিলাম। তখন আমি আহসানুল্লাহ হল-এর ভিপি হিসেবে কন্টেস্ট করেছিলাম। ফলে সংগঠনের পক্ষ থেকে আমি কিছুটা ইসলামিক জ্ঞান অর্জন করি।
এডমিনিস্ট্রিটিভ পজিশনে কাজ শুরু করলেও বাচ্চাদের ইসলামিক হিস্ট্রি’র বিষয়ে ক্লাস নিতাম, কারণ বাচ্চাদের সাথে মিশতে খুবই ভালোবাসি।

› একজন কমিউনিটি একটিভিটিজ হিসেবে এ পর্যন্ত কি কি কাজ করেছেন?
›› ২০১৩ সালে আমি ওবামা কেয়ার-এ এনরোলমেন্ট করেছিলাম ৫৪ জন। তারপর সিএমএস সার্টিফাইড নেভিগেটর হিসেবে ইস্টার্ন মিশিগান ইউনিভার্সিটির সাথে জড়িত হয়ে গেলাম। গত প্রায় ১০ বছর যাবৎ উনাদের সাথে কাজ করছি।
যেহেতু আমি কমিউনিটির মানুষদের সঙ্গে মিশি, তাদের সমস্যা বুঝতে পারি। সেহেতু আমাকে যখন যে কাজ দেয়া হয়েছে আমি তা আনন্দের সাথে সম্পন্ন করেছি।
বিভিন্ন এরিয়াতে বিভিন্ন সমস্যা আছে, আমি সেগুলি নিয়ে Access-এর সাথে কাজ করি।
আরো কিছু অর্গানাইজেশনের সঙ্গে আমি কাজ করছি যেমন কোলোরেক্টাল ক্যান্সার screening যেখানে Access এবং ইস্টার্ন মিশিগান ইউনিভার্সিটি জয়েন্ট ভেঞ্চার ছিল। হেপাটাইটিস বি ফাউন্ডেশন-এর সঙ্গে আমি কাজ করেছি আলাদা ভাবে। তারপর শিকাগোর ‘MAHA’ নামের একটি অর্গানাইজেশন কমিউনিটি বেইজেড এবং হেলথ সম্পর্কিত কিছু কাজ আমাকে দিয়ে করিয়েছিলো।

› আপনি বললেন যে ৫৪ জনকে সাথে নিয়ে ওবামা কেয়ার শুরু করেছেন এখন কি অবস্থা?
›› বর্তমানে এই সংখ্যা ২ হাজার পাড়ি দিয়েছে। আমরা আমাদের নেভিগেটরের সংখ্যাও বৃদ্ধি করেছি। এখন ফাতেমা চৌধুরী, তানভির চৌধুরী, নুরুজ্জামান এবং দেওয়ান হুজাইফা আমার সাথে আছেন। তাছাড়া ফয়সাল আহমেদ আছেন Access-এ। পুরো কাজটি ডিস্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে চলছে। এখন প্রায় ৫০০ থেকে ৫৫০ জন লোক প্রত্যেক বছর Enrollment হচ্ছে না।

› এটা কি কম্বাইন্ড হিসেবে চলছে?
›› না, ইস্টার্ন মিশিগান ইউনিভার্সিটি এবং Access আলাদা ভাবে কাজ করছে।

› আপনারা কি কি সেবা দিয়ে থাকেন?
›› Medicaid। কেননা (MDHHS) মিশিগান ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ হিউম্যান service-এর আমি একজন community পার্টনার। তাছাড়া সিএমএস সার্টিফাইড নেভিগেটর হিসেবে আছি।
অন্যান্য কিছু কাজ করার জন্যেও কিছু সার্টিফিকেট আছে যেমন ডায়াবেটিস প্রিভেনশন প্রোগ্রামে আমি সার্টিফাইড কোচ হেনরি ফোর্ড হাসপাতাল থেকে একটা কোর্স করছি এবং আরো কিছু ট্রেইনিং নেয়া আছে।

› আপনি পেশায় প্রকৌশলী কিন্তু মেডিকেল ফিল্ডে কনভার্ট হয়েগেলেন কেন ?
›› এখানে আমি যখন আসছি তখন আমার বয়স সিক্সটি আপ। এই বয়সে আমার (ইঞ্জিনিয়ারিং) প্রফেশনে যাবার স্কোপ ছিলনা। সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে আমার ভালো লাগে। কথা বলতে ভালো লাগে। তাদের সমস্যার সমাধান দিতে ভালো লাগে। সেই সব কারণে আমি এই ফিল্ড বেছে নিয়েছি।

› যদি বলি আপনার দৃষ্টিতে মিশিগানের ৫টি সমস্যার কথা বলুন তবে কি কি বলবেন?
›› প্রথমত ভাষাটা অনেক বড় সমস্যা, ইংরেজি ভাষা না জানার ফলে অনেকেই বাহিরে কথা বলতে পারেনা। নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত আমাদের কাছে এমন অনেক মেয়ে আসে যাদের বয়স ২০/২২ বছর। ১/২ বছরের বাচ্চা আছে, অথচ স্বামী নেই। এই সমস্যা সমাজে ভয়াবহ ভাবে বেড়েই চলছে।
তৃতীয়ত অনেকেই তাদের বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেশ থেকে এখানে নিয়ে আসেন। তাদের পুত্র-পুত্রবধুরা কাজে চলে যান। নাতী-নাতনীরা স্কুলে। সেই সময় এই বয়োবৃদ্ধরা সারাদিন বাসায় একা একা থাকেন। কোন কাজ করতে পারেন না। যা তাদের জন্যে খুব বিরক্তিকর।
এদেরকে অর্গানাইজ করার বিষয়টি নিয়ে আমি ইউনিভার্সিটিতে কথা বলেছি। আমি এবং আমার আইডিয়াকে তারা খুব এপ্রিশিয়েট করেছেন। কিন্তু এইটা বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। কেননা অর্থিক ফান্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। একবার করেই বন্ধ হয়ে গেলে চলবেনা। আমি অবশ্য হাল ছাড়িনি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দেখি মানুষগুলোকে কোনো কাজে লাগাতে পারি কি না।
অন্তত দিনে ৩/৪ ঘন্টা যদি তারা আমাদের সাথে কাটালে তারা কিছুটা হলেও ধর্মীয় ভাবে আপডেইট থাকতে পারবেন।

› আর কোন সমস্যা বা পরামর্শ?
›› হ্যা, সমস্যা আছে। আমি লক্ষ করেছি অনেক যুবক-তরুণরা বিয়ে করে এখানে আসছেন। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়েও এই দেশে এসে বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে কাজ করছেন। তাদের কেরিয়ারটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
যদি তাদের ডেকে নিয়ে তাদের কোর্স টাকে এদেশের ভার্সনে আপডেট করে সার্টিফিকেট নেয়া যায় তাহলে অনেক ভালো টাকা ইনকাম করতে পারবে।
অনেকে ১৫ বা ২০ বছর ফ্যাক্টরিতে কাজ করলে হাত-পায়ে সমস্যা চলে আসে। পরে ডিজেবিলিটি নিয়ে নেয় ইন্সুরেন্স থেকে। এরকম বহু কেইস আমি দেখেছি। এদেরকে মোটিভেশন দেয়া দরকার, উৎসাহ দিয়ে কাজে লাগানো দরকার।
বিশেষ করে এখন অনেক আইটি কোর্সের সুযোগ আছে। সেগুলো গ্রহণ করে সার্টিফিকেট নেয়ার বিষয়ে আমরা যারা পুরাতনরা তাদের উৎসাহিত করতে পারি। কেনোনা প্রফেসনাল সার্টিফিকেট ছাড়া এখানে ভাল কাজ করা সম্ভব না। এই বিষয়ে আমরা বাঙালিরা খুব পিছিয়ে আছি অন্যন্য ন্যাশনের তুলনায়। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু কাজ করার দরকার আছে। এ সব তরুণ-যুবকরা যদি টেকনিক্যাল সাইট গুলা থেকে যেমন ইলেক্ট্রিক্যাল, প্লাম্বিং এর কিছু কোর্স করে সার্টিফিকেট নিতে পারে তাহলে তারা অনেক টাকা উপার্জন করতে পারতো।
আরেকটা হলো রিলিজিয়াস লাইনে টোটাল একটা একোমোডেশন দরকার। যেমন মসজিদ বলতে এইটা তবলীগের মসজিদ, ওটা ফুলতলীর মসজিদ, সেটা পীরসাবদের মসজিদ, এটা জামাতের এই ধারণা গুলি পরিপূর্ণভাবে পরিহার করতে হবে।
এভাবে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে অসম্মান না জানিয়ে সকলে মিলে মিশে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার কাজ করতে হবে।

› পরিশেষে বাংলা সংবাদ-এর পাঠকদের উদ্দ্যেশ্যে যদি কিছু বলেন।
›› যারা এসাইলাম এপ্লাই করে কার্ড পেয়েছে তারা কাজ শুরু করেদিয়েছে এমাজনে। আমি তাদের বলেছি তোমরা কাজ কর টাকা আয় কর সমস্যা নাই। তবে কাজের পাশাপাশি বিভন্ন রকমের কোর্স করে সার্টিফিকেট নাও। চেষ্টা করো আরো ভাল এমাউন্টের টাকা ইনকাম করতে পারবে। তারা উৎসাহিত হয়েছে।
আমাদের সবারই উচিৎ এই দেশে নতুন আসা আত্মীয়-স্বজনদের নানা রকম প্রশিক্ষণ গ্রহণে আগ্রহী করে তোলা।

› আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
›› আপনাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ।


Posted

in

by

Tags: