হেলসিঙ্কি যেভাবে বিশ্বের মোবাইল গেমিং রাজধানী হয়ে উঠেছে
উদ্ভাবনী প্রযুক্তির হটবেড হিসাবে বিখ্যাত বিশ্বের শহরগুলির আলোচনা শুরু করলে প্রথমেই যে শহরের কথা আসে তা হলো ফিনল্যান্ডের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর হেলসিঙ্কি।
বর্তমানে এ শহরটি সফল ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী গেম নির্মাতাদের বসবাসের জন্য বিশ্বের মোবাইল গেমিং রাজধানী হয়ে উঠেছে।
অ্যাংরি বার্ড মোবাইল গেমের কথা সবারই মনে আছে। আপনিসহ হয়তো অনেকেই এই গেমটি খেলেছেন। সুন্দর কার্টুনের সাথে মজার মনোমুগ্ধকর এ গেম বড় থেকে ছোট বাচ্চা সবারই পছন্দের। এই অ্যাংরি বার্ড গেমটি হেলসিঙ্কিতে প্রথম প্রচার হয়।
এই গেমটি “ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যানস” এর মতো গেম নির্মাতা প্রতিষ্টান সুপারসেলের মতো স্টুডিওগুলির বাড়ি এবং সেই জায়গাটিও নেটফ্লিক্স তার প্রথম অভ্যন্তরীণ গেমিং স্টুডিও সেট আপ করার জন্য বেছে নিয়েছে৷ যার ফলস্বরূপ, ফিনিশের রাজধানী হেলসিঙ্কিকে অনেকেই মোবাইল গেমিংয়ের স্বর্গরাজ্য হিসাবে বিবেচনা করে। যা বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ১২০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের একটি শিল্প।
কীভাবে হেলসিঙ্কি এই খ্যাতি অর্জন করে
১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে ফিনল্যান্ডকে বিশ্বের ধনী দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হত না। এখানকার বেশিরভাগ ব্যবহারকারী এমন কম্পিউটারের উপর নির্ভর করত যেগুলি কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে অনেক দূরে ছিল।
পরবর্তীতে “ডেমোসিন” নামে খ্যাত – একটি উপসংস্কৃতি যা প্রোগ্রামারদের দেখিয়েছিল শিল্প উপস্থাপনা, সঙ্গীত এবং গেম তৈরি করতে যা সেই সময়ের প্রযুক্তিকে ঠেলে দিয়েছিল তার ক্ষমতার সীমাতে। এরফলে ফিনসরা খুব কম কিছু দিয়ে অনেক কিছু করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এবং তারপরে আসে নোকিয়া।
হেলসিঙ্কিতে অবস্থিত ফ্যান্টম গেমল্যাবস এর সিইও সোনজা অ্যাঙ্গেসলেভা বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানটি আজ শহরের গেম শিল্পের সম্প্রসারনে সাফল্যের সাথে কাজ করছে। এক্ষেত্রে নোকিয়া একটি উদাহরণ দেখিয়েছে যে আমরা এখান থেকে বড় কিছু তৈরি করতে পারি।”
গেম নির্মাতা হিসেবে, সফল কনসোল ডেভেলপার রেমেডি গেমসের বোর্ড সদস্য এবং একটি নতুন ডেভেলপমেন্ট স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা সোনজা ফিনিশ গেমস সেক্টর সম্পর্কে অভিজ্ঞ।
তিনি বলেন, নোকিয়া ফিনিশ ডেমোসিনের নিয়ে কাজ করেছে। যার মানে হল, বড় গেমের অভাব থাকা সত্ত্বেও সেই সময়ে গেমকে জনপ্রিয় করে।
রিঅক্টরের গেমিংয়ের প্রধান সার্টিতা রুনবার্গ বলেন: “ফিনরা চিরকাল থেকেই টেক গীক! এখানে সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি হল এমন যে আমাদের চেষ্টা করা এবং ব্যর্থ হলে তারপরে আবার চেষ্টা করা। আর এভাবেই অনেক গেমিং কোম্পানি শুরু করেছে, যখন আপনাকে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়ে চিন্তা করতে হবে না তখন আপনি অনেক সাহসী হতে পারেন।”
একটি গেম কোম্পানি সফল হওয়ার জন্য, তাদের সঠিক পরিকাঠামো প্রয়োজন। রিঅক্টর এমন ২০০টিরও বেশি গেম স্টুডিওকে তাদের উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন এবং প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করে।
রুনবার্গ আরও বলেন “আমরা জানি যে আমাদের কাছে সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক রয়েছে। আমাদের সরকার গেমিং কোম্পানিগুলিকে অনেক সহায়তা করছে। যাতে আপনি একটি কোম্পানি সেট আপ করতে আপনার নিজের বাড়ি বন্ধক রাখতে হবে না। আপনি তহবিল থেকে সহজেই অনুদান পেতে পারেন। বাজারে নতুন ধারণা কাজ করে কিনা তা চেষ্টা করা এবং ধারণার কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য যদি সেটা কোন নির্দিষ্ট বাজারে কাজ করে।
“সরকার লোকেদের এইখানে আসার জন্য অনুপ্রাণিত করছে, কিন্তু জলবায়ুর জন্য কেউ হেলসিঙ্কিতে যেতে চায় না।”
গেমিং স্পেসে শীর্ষে থাকার জন্য বিশ্বের সেরা ডেভেলপারদের আকৃষ্ট করাই হেলসিঙ্কির পরিকল্পনার একটি মূল অংশ। আর এটি হেলসিঙ্কি পার্টনার্স নামের সংস্থাটি সফলতার সাথে করে যাচ্ছে।
হেলসিঙ্কি পার্টনার্সের কৌশলগত উদ্যোগের পরিচালক জোহানা হুরে বলেন, “এখানের সকল কোম্পানি দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়া থেকে প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মী নিয়োগ করে। যাতে তারা এই গেমিং কে সামনে আগাতে পারে।”
কোম্পানি এবং ডেভেলপারদের হেলসিঙ্কিতে দোকান সেট আপ করার জন্য বড় ট্যাক্স ইনসেনটিভ বা উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চতর বেতন দেওয়া হয় না। ফলে এখানে গেমিং প্রতিষ্ঠান চালানো অনেক সহজ।
“এখানে জীবন অনেক সহজ। করোনা মহামারীর পরে এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাছাড়া এখানকার বাসিন্দারা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।”
হেলসিঙ্কির কারিগরি উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা রয়েছে।
হেলসিঙ্কির গেমিং স্টুডিও গুলি ২০২২ সালে ২.৮ বিলিয়ন পাউন্ড সমমূল্যের গেম তৈরি করেছে।
হেলসিঙ্কির সাফল্যের পিছনে আরও ভূমিকা রাখছে সুপারসেল। সম্প্রতি সুপারসেলকে চীনা কর্পোরেশন টেনসেন্ট অধিগ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। এই গেম নির্মাতার বাজার মূল্য ৯.২ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে বিখ্যাত বেস বিল্ডিং মোবাইল গেম “ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যানস” এর স্টুডিওতে কাজ করার জন্য স্টুয়ার্ট ম্যাকগা স্কটল্যান্ডে চলে এসেছেন। তিনি বলেন, “অনেক লোকের মতো আমারও মনে আছে মোবাইল গেম ‘স্নেক’ নোকিয়া ৩২১০-এ খেলে বড় হয়েছি”৷
তিনি আরও বলেন, “এখানে লোকেরা গেম কোম্পানিগুলির সাফল্যের গল্প সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছে।”
ফিনল্যান্ডের গেমস ডেভেলপমেন্টের খ্যাতিতে উৎসাহিত হয়ে ম্যাকগা তার কর্মজীবন শুরু করার পরে গেমিং তৈরির উপর মনোনিবেশ করেন।
তিনি মনে করেন যে স্থানীয় লোকেরা ডেভেলপারদের কাজ সম্পর্কে এখন আরও সচেতন এবং গেমিং এর ভবিষ্যতের জন্য শিল্পটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে৷
তথ্য সূত্র বিবিসি।