মিশিগান সংবাদ

ডেট্রয়েটের জোসেফ ক্যাম্পাউ এভিনিউতে এসেছে আমূল পরিবর্তন

সিলেট ফার্মের হাত ধরে পরিবর্তন ছোঁয়া লেগেছে ডেভিসনের জোসেফ ক্যাম্পাউ এভিনিউয়ে। প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা সিলেটের এ.কে.এম রহমান। একাধারে তিনি মসজিদ ফাতিমা হোপ সেন্টার ইনকের কর্ণধার। জুম্মাবারে তিনিই মসজিদ ফাতিমায় খতিবের ভূমিকা পালন করেন। যে এলাকাটিতে মাত্র দুই থেকে তিন বছর পূর্বেও অনেকেই বসবাসের জন্য নাক সিটকাতেন এখন তাদের মধ্যেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। দ্রুত গতিতে বাড়ছে এলাকার ঘরবাড়ির দাম। এই এলাকায় বাঙালিদের ঠিকে থাকা বেশ কষ্টসাধ্য একটি ব্যাপার ছিল কেননা যখন-তখন চুরি-ডাকাতির উপদ্রব ছিল পুরো এলাকা জুড়ে। মসজিদ ফাতিমা প্রতিষ্ঠার পর এই মসজিদে নামাজ পড়তে আসার পথেও অনেক মুসল্লির মোবাইল-মানিব্যাগ ছিনতাই হয়েছে। এখন সময়ের পথ পরিক্রমায় বদলে গেছে অনেককিছুই। এই বদলের নেপথ্যের কারিগর এ.কে.এম রহমান। শুরুতে এই এলাকায় তিনি কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেন। দুই একর জায়গার উপরে ২০১৩ সালে শুরু করেন সিলেট ফার্ম নামের প্রতিষ্ঠানটি। তাঁর এই উদ্যোগ প্রশংসনীয় হয়ে ওঠে সকলের কাছে। কৃষক আর ক্রেতার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে উভয় পক্ষ যেন লাভবান হয় এই উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয় পথচলা। সিলেট ফার্ম সম্পর্কে এ.কে.এম রহমান বলেন, এটি সম্পূর্ণ একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এখানে কাজ করার জন্য প্রতিবছর জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে আমেরিকার বিভিন্ন শহর এমনকি কানাডা থেকে অনেক স্বেচ্ছাসেবক (ভলান্টিয়ার) কাজ করতে আসেন। সিলেট ফার্ম মূলত একটি কমিউনিটি প্রজেক্ট। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কমিউনিটি প্রজেক্ট বলতে কমিউনিটির মানুষেরা এখানে বীজ বপন থেকে শুরু করে পানি দেওয়া পর্যন্ত সব কাজ নিজেরা করতে পারেন এবং উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে পারেন। চার ফুট বাই দশ ফুট জায়গা ছয় মাসের জন্য মাত্র বিশ ডলার অর্থমূল্য দিয়ে ক্রয় করে ফসল উৎপাদনের কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন।
এ.কে.এম রহমান নিজের অতীত স্মৃতিচারণ করে বলেন একসময় দেশে থাকাকালীন সময়ে সিলেটে গড়ে তোলেন মৌসুমী সমাজ কল্যাণ সংস্থা। সমাজের ভালো কিছু করা ছিল সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য। প্রত্যেক বাড়ির নাম্বারিং প্রথার প্রচলন শুরু করে এই সংস্থা যা সেই সময় বেশ প্রশংসা কুড়ায়।
সিলেট ফার্মের উৎপাদিত পণ্য খুবই সুলভ মূল্যে মসজিদ ফাতিমা প্রাঙ্গনে প্রতি শনি ও রবিবার বিক্রি করা হয়। মিশিগানের ডেট্রয়েট ও হ্যামট্রামিক সিটিতে বসবাসকারী একাধিক কৃষক নিজেদের বাড়ির আঙিনায় ফলানো শাকসবজি বিক্রির জন্যও এখানে সমবেত হন। ক্রেতা ও বিক্রেতার মিলনমেলার লক্ষ্য একটাই উভয়েই যেনো এখান থেকে উপকৃত হন।

এই কর্মযজ্ঞে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। সিলেট ফার্মে জায়গা নিয়ে ফসল ফলানোর জন্য অনেকেই আবেদন করে থাকেন। সেখান হতে লটারি করে নির্বাচন করা হয়। বর্তমানে দেড়শো পরিবার এই প্রজেক্টের সাথে যুক্ত আছেন। কেবল কৃষি কাজই নয় বরং কৃষি কাজকে উপলক্ষ্য করে এখানে কমিউনিটির মানুষজন আসেন, তাদের মধ্যে আলাপ হয় এবং একটি ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সিলেট কিংবা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষজনের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠে। সবাই সুসংগঠিত ভাবে একত্রে এই কর্মযজ্ঞে যুক্ত রয়েছেন। মূলত কমিউনিটিকে একত্রিত রাখা এই প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্য। সিলেট ফার্ম শিক্ষা, টেকসই এবং সম্প্রদায়ের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে, যাতে শহুরে সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন, ডেট্রয়েটের সম্মুখীন অনেক সামাজিক সমস্যার সমাধান করা এবং এই কর্মযজ্ঞ যাতে অন্যদেরও অনু্প্েররণা যোগায় সেই প্রচেষ্টা করে যাওয়া। সিটি অব ডেট্রয়েট থেকে আরও জায়গা বাড়িয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে যাতে করে বেশি মানুষ যুক্ত হতে পারে এ কার্যক্রমের সাথে।

উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে ব্যক্তিমালিকানাধীন সিলেট ক্যাফে
সম্প্রতি সিলেট ফার্মের অতি সন্নিকটে জমকালো আয়োজনে উদ্বোধন হয়েছে সিলেট ক্যাফে আমেরিকান হালাল কুইজিন। হালাল খাবারের শতভাগ নিশ্চয়তা নির্ভর প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ তরতাজা খাবার সরবরাহ করছে। জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ডেট্রয়েট সিটি মেয়র মাইক ডুগান, হ্যামট্রমিক সিটি মেয়র আমির গালিবসহ বিভিন্ন কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ব্যতিক্রমী কিছু দিক কেননা এখানকার খাবার বিক্রির আয়ের একটি অংশ মসজিদ ফাতিমা হোপ সেন্টার ইনকের তহবিলে প্রদান করা হবে যা মানবতার কল্যাণে ব্যয় করা হবে। আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে তরুণদেরকে সুপথে রেখে বিনোদন প্রদান করতে জিরো অ্যালকোহল বার। নতুন প্রজন্মের কথা চিন্তা করে এটি করা হয়েছে। রয়েছে পুল খেলার সুবিধা।
বিয়ের আয়োজন কিংবা যেকোনো সভা-সেমিনার আয়োজনে হলরুম সুবিধা রয়েছে। ১০০ জনের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এই হলরুমে রয়েছে মহিলা ও পুরুষদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা।
ক্যাফের খাবার তালিকায় গতানুগতিক খাবার বিদ্যমান রয়েছে, তবে এখানকার খাবারের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে সাতকরা তরকারি।

বাঙালি কমিউনিটির ছোঁয়ায় আলো পেয়েছে জোসেফ ক্যাম্পাউ এভিনিউ
একটা সময় এই এলাকায় কেউ ফ্রি ঘর পেয়েও বসত করতে চাইতেন না কেননা দিনে দুপুরে চুরি-ডাকাতি হর হামেশা ঘটতো। এদিকে কেউ আসলে আতঙ্কের মধ্যে থাকতেন। এখানে হাতেগোনা বাঙালির বসতি ছিল কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের পর সকলে এই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান, বলা যায় আমাদেরকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়ে এমনটাই বললেন এ.কে.এম রহমান। তিনি আরও জানান, এই এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল খুবই নাজুক। পতিতাবৃত্তি কিংবা চুরি-ডাকাতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে এখানে বসবাস যে কারও জন্য অসহনীয় হয়ে গিয়েছিল। বাঙালি কমিউনিটির অবস্থান একেবারে তলানীতে পৌঁছেছিল। অনেকটা যুদ্ধ করে এখানে নিজের অবস্থানের শক্ত ভিত রচনা করেন এ.কে.এম রহমান। এই লড়াইয়ে অনেকেরই সহায়তা পান। পুলিশ প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় এখান থেকে পতিতাবৃত্তি নির্মূল সহ চুরি-ডাকাতি বন্ধে নেওয়া হয় নানা মানবিক পদক্ষেপ। জায়গা কিনে মসজিদকে প্রদানের মাধ্যমে কমিউনিটির কল্যাণে বিশেষ অবদান রাখেন এ.কে.এম রহমান। এখন এদিকে ডেভিসন থেকে শুরু করে ঐ দিকে সেভেন্টি ফাইভ পুরো অঞ্চলজুড়ে শান্তির পরিবেশ বিরাজমান। এখন চুরি-ডাকাতি নেই বললেই চলে। এই সকল কাজে সার্বিক সহযোগিতার জন্য সিটি অব ডেট্টয়েটের মেয়র এবং পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ধন্যবাদ জানান এ.কে.এম রহমান।
হ্যামট্রামিকের সীমানা থেকে মাত্র কয়েক ধাপ দূরে ডেট্রয়েটের জোসেফ ক্যাম্পাউ এভিনিউতে সিলেট ফার্মের অবস্থান। বর্তমানে মিশিগানের মূলধারার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছে সিলেট ফার্ম। সিলেট ফার্ম অ্যান্ড ফার্মার্স মার্কেট সম্প্রসারণের কাজ করতে গিয়ে উদ্যোক্তা এ.কে.এম রহমান দুই একরের বেশি খালি জমি অধিগ্রহণ করে কমিউনিটি উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন।

সবুজ বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে
স্বেচ্ছাসেবকদের সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে গড়ে ওঠা সিলেট ফার্ম অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে মিশিগানে কৃষি বিপ্লবে। বাড়ির পাশের খালি জায়গায় এখন অনেকেই শখের বশে ফলের বাগান করছেন। উৎপাদিত ফল-ফসল বিক্রিরও ব্যবস্থা রয়েছে মসজিদ ফাতিমা হোপ সেন্টারের পাশে, সিলেট ফার্মের সার্বিক সহযোগিতায়। গ্রীষ্মকালীন সময়েই মূখর থাকে বাগান। ফল-ফসলে ভরা থাকে, কৃষকের আনাগোনা থাকে। গ্রীষ্মকালই সিলেট ফার্মের ব্যস্ত মৌসুম। মিশিগানের বিভিন্ন স্থানে কৃষকের ফলানো তরতাজা সবজি কেবল সিলেট ফার্মের কল্যাণেই সকলের নিকট পৌঁছে যাচ্ছে। আগ্রহী ক্রেতা কেবল বাঙালি কমিউনিটির নয় অন্যান্য কমিউনিটির লোকজনও বেশ আগ্রহ নিয়ে বাজার করতে আসেন।
অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কমিউনিটিতে অভিবাসী, উদ্বাস্তু এবং স্বল্প সম্পদের লোকদের জীবন উন্নত করার প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরি করছে সিলেট ফার্ম। সহযোগিতার অংশ হিসেবে মিশিগান ফার্মার্স এসোসিয়েশন সিলেট ফার্মকে বীজ সরবরাহ করে থাকে।

সফলতার সকল আলো যাঁর দিকে
লড়তে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন কল্যাণ ও সুচিন্তার মধ্যদিয়ে সময় কাটাতে। ইতিবাচক ভাবনার বীজ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। ইতোমধ্যে সকলেরই নিকট নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে নিয়েছেন নিজগুণে। ডেট্রয়েট ডেভিসনের জোসেফ ক্যাম্পাউ এভিনিউতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসে হয়ে উঠেছেন সকলের নিকট জনপ্রিয়, তিনি এ.কে.এম রহমান। কমিউনিটি এক্টিভিস্ট, মসজিদ ফাতিমার খতিব, হোপ সেন্টার এর সিইও, সিলেট ক্যাফের কর্ণধার। আরও অনেক বিশেষণ জুড়ে দেওয়া যাবে তাঁর নামের পাশে। জোসেফ ক্যাম্পাউ এভিনিউতে অন্ধকার তাড়াতে সকল আলো গিয়ে পড়েছে তাঁর দিকে। সময়ের সঙ্গে হেঁটে তিনিই হয়ে ওঠেছেন আলোর বাতিঘর।

অঞ্চলজুড়ে মানসিকতা এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন
মসজিদ ফাতিমার বাইরে দেওয়া হয় আজান। আল ফালাহ মসজিদের সাথে পারস্পারিক যোগাযোগ থাকায় ধর্মীয় বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে লোকজনের নিকট। সকল ধর্মের মানুষজনের সাথে হার্দিক সম্পর্কের মধ্যদিয়ে সত্যিকারের মানব সমাজ প্রতিষ্ঠা পুরো অঞ্চলে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের কল্যাণে তথা কমিউনিটির কল্যাণে কাজ করছে মসজিদ ফাতিমা, সিলেট ফার্ম।

পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার
অর্থ উপার্জনই মূখ্য নয় বরং কমিউনিটির শক্ত ভিত রচনাই মূল লক্ষ্য সিলেট ফার্মের। দিন দিন পরিবেশ দূষণের ফলে চারিদিকে ঘটছে জলবায়ুর পরিবর্তন তাতে করে পৃথিবী এখন পড়েছে হুমকির মুখে। সিলেট ফার্ম সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার করে থাকে। সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে পরিচালিত হয় নানান ধরণের কাজ। স্বল্প নয় দীর্ঘমেয়াদি নানা রকমের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সিলেট ফার্ম। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একটাই কমিউনিটির উন্নয়ন, মানুষের কল্যাণ।

Back to top button