মতামতসম্পাদকীয়

শিক্ষক আপনার সন্তানের স্বপ্ন সারথি

প্লেটো তাঁর “দ্যা রিপাবলিক” গ্রন্থে বলেন একটি রাষ্ট্র তার সকল নাগরিককে শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে তুলতে যদি না পারে, তবে সে রাষ্ট্র আর কি করলো বা নাই করলো, তাতে কিছুই যায় আসে না। জ্ঞানী-গুণী এবং মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর তা বাস্তবায়নে শিক্ষকের ভুমিকা অনন্য।

শিক্ষক হচ্ছেন গুরু আর বাকি সবাই শিষ্য এবং শিষ্যের উপর তাঁর প্রভাব থাকে জীবনভর। কাজেই বুঝা যাচ্ছে যে, একজন শিক্ষক কেমন হওয়া দরকার এবং তাঁকে কেমন করে তৈরি করা প্রয়োজন। বিশেষ করে স্কুল জীবনে শিক্ষার্থীদের উপর শিক্ষকের প্রভাব এতোই বেশি থাকে যে, যা এই স্বল্প লিখনে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

কোমলমতি শিশুরা মনে করে, এ জগতে তার শিক্ষকই সবচেয়ে বড় ও জ্ঞানী ব্যক্তি। শিক্ষক যা শেখান তারা মনে করে এটাই সঠিক। যেমন, আমার মেয়ে একদিন বললো, ম্যাডাম আজ শিখিয়েছেন “ম্যা আই গো টু টয়লেট।” আমি বললাম তারচেয়েও সুন্দর করে তুমি বলবে “ম্যা আই গো টু ওয়াশরুম।” কিন্তু তাকে কোনোভাবেই মানিয়ে নিতে পারলামনা।

ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বুঝালো তার ম্যাডাম যা বলেছেন সেটাই ঠিক। এক্ষেত্রে আমি অন্যটি শেখাতে পারিনি। এই বিষয় থেকে সহজে অনুমেয় শিক্ষার্থীর উপর শিক্ষকের প্রভাব কেমন থাকে। ফিনল্যান্ডকে বলা হয় সোনার ছেলে মেয়ে উৎপাদনকারী দেশ। কেননা, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কৃতিত্ব অর্জনকারীদের থেকে বাছাই করে তিন ক্যাটাগরির শিক্ষক নির্বাচন করেন এবং তা থেকে প্রথমটিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেন।

দ্বিতীয়টি মাধ্যমিকের জন্য এবং তৃতীয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিয়োগ দেন। শিক্ষক কোনো দফতরের কর্মকর্তা নন, তিনি শিক্ষার্থীর স্বপ্ন সারথি, আপনার সন্তানের বিনির্মাতা, তিনি শুধু ক্লাসের বই পড়ানোর জন্যই নন, তিনি হবেন শিক্ষার্থীর বন্ধু, পথ প্রদর্শক, দার্শনিক এবং অভিভাবক। কাজেই শিক্ষক তার ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে যখন শিক্ষার্থীর স্পর্শে আসেন, তখন মনে করতে হবে যে তিনি পুরো মানুষটিই শিক্ষার্থীর জন্য একটি মডেল।

তাঁর কথা, বাচনভঙ্গি, চাল-চলন, তাঁর রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, তাঁর নৈতিক ও মানবিক উদারতা সবই তাঁর শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষা এবং এর প্রভাব সে সারা জীবন বহন করবে। আমার ঢাবির সহপাঠী ও বন্ধু অধ্যাপক এম এ কুদ্দুস সাহেবের নিকট শোনা একটি গল্পের কথা বলছি। একদা বিলেতের এক রাজা একটি স্কুলের ক্লাস পরিদর্শনে আসেন। মহান রাজা শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের সাথে সাথে দেশের রীতি অনুযায়ী সব শিক্ষার্থীরা মাথার ক্যাপ নামিয়ে অবনত মস্তকে রাজাকে কুর্ণিশ করলো।

কিন্তু ক্লাস শিক্ষক মাথার হ্যাটটিও নামালেন না, রাজাকে কুর্ণিশও করলেন না, রাজাকে কেবল স্বাগতম জানালেন। শিক্ষার্থীরা দেখলো আর ভাবলো তাদের শিক্ষক রাজার মতই মহান, রাজার সমান। রাজা চলে গেলেন। পরের দিন ওই শিক্ষক রাজার দরবারে গেলেন রাজার সাথে দেখা করে ঘটনাটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে।

তিনি রাজাকে কুর্ণিশ করে বললেন, আপনি আমাদের দেশের মহামান্য রাজা, সকলের উপরে আপনার স্থান কিন্তু গতদিন আমি ছেলে মেয়েদের সম্মুখে আপনাকে কুর্নিশ করে বিশেষভাবে কোনো সম্মান জানাতে পারিনি, এজন্য আমি আপনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে এসেছি। রাজা সাথে সাথে তার কারণ জানতে চাইলে শিক্ষক বললেন, আমি যদি ঐদিন আমার শিক্ষার্থীদের সম্মুখে নত হয়ে আপনাকে কুর্নিশ করতাম, তবে আমার শিক্ষার্থীরা মনে করতো আমাদের শিক্ষক রাজার মতো বড় নন, তিনি রাজার চেয়ে অনেক ছোট্ট এবং তাদের জীবনে এই ছোট্ট প্রভাবটুকুই পড়তো, তাই আমি আপনাকে কুর্নিশ করতে পারিনি।

শুনে রাজা অভিভূত হয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বললেন তাহলে আমার সন্তানেরা সঠিক শিক্ষা পেয়েই বড় হচ্ছে। তারপর রাজা সারা দেশের শিক্ষকদের এক নোটিশে জানিয়ে দিলেন যে, এখন থেকে কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীর সামনে কাউকে কুর্নিশ করতে পারবেন না। একটি জাতির শিক্ষক সমাজ, যে আদল ও আদর্শের জনবল ও নাগরিক সমাজ তৈরি করবেন, একটি দেশের জনগণ সকল বিভাগ থেকে কেবল সেই মান ও আদর্শের মর্যাদা ও সেবা পাবে।

কাজেই শেষ কথা হচ্ছে, আমার সন্তানের প্রেরণা ও চেতনার উৎস যে শিক্ষক, তিনি হবেন মানবিক ও বহু গুণে গুণান্বিত একজন মর্যাদাবান মহান মানুষ। তাই রাষ্ট্রের সরকার ও সচেতন সমাজকে এই মূল্যবান মানুষটি তৈরিকরণের দায়িত্ব নিতে হবে।

Back to top button