সকাল আটটায় লাগার্ডিয়া এয়ারপোর্ট থেকে রওনা দিলাম মিশিগানের পথে। শিকাগো এয়ারপোর্টে প্লেইন চেঞ্জ।
এয়ারপোর্টের নামটাও ভারি সুন্দর ‘ও হেয়ার’-কোথায় শুনেছি নামটা? কোথায় শুনেছি? স্মৃতিশক্তি আমার এত দুর্বল যে নাম মনে রাখা আর গিলোটিনে মাথা দেয়া সমান।
অনেক মাথা ক্যালাবার পর মনে পড়ল ও আচ্ছা ‘ওহেনরি’ নামে আমেরিকান একজন রাইটারের ‘গিফ্ট অব দ্যা মেজাই’ নামক একটা গল্প পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি। তা হলে বৃত্তান্ত এই? যা হোক যাচ্ছি মিশিগানে এমার নানার বাড়িতে। এখন অবশ্য নানির।
এমার মা এনিও মিশিগানে এসেছেন অরেগন থেকে, বোন নাতালিরও আসার কথা সাথে পিচ্চি রেমী। ট্রফিক জ্যামের কারনে শিকাগো ইয়ারপের্টে আমাদের প্নান ট্যাক্সিওয়েতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সময় মজার জিনিস দেখলাম।
টেইকঅফ জোন থেকে সৈন্যদের মার্চপাস্টের মত মিনিটে মিনিটে প্লেন উড়ে গিয়ে আকাশে হারিয়ে যাচ্ছে। শিকাগো বাণিজ্যিক শহর তাই হয়তো বিমানের এমত মাতামাতি। ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে যাব মিশিগান।
গেইট বি-৫ তে বসে আছি। এমা আর রাসিম গেছে খাবার কিনতে। সামনেই রেস্টুরেন্ট। কত নামরে বাবা রেস্টুরেন্টের? ব্রুকলিন ডাইন, গ্রেন্ড আমেরিকান বার্গার এন্ড বেগল, ড্যা চুলা-চুলা? বাহ্ আমাদের ‘চুলা’ কি ফরাসি দেশ থেকে আমদানি নাকি? কোথা থেকে কি যে হয়ে গেছে যুগে-যুগে কে বলতে পারে? আমার দাদীর দাদী বা তার দাদীর দাদী ফরাসি দেশের কোন চুলাতেই রান্না করেছে নাকি? অথবা ফরাসি দাদা দেশি দাদিকে চুলাতে রান্না করতে শিখিয়েছে?
দ্বিতীয়টা হবার সম্ভাবনাই বেশি।
আমেরিকান বিমানের কিছু জিনিস দেখে আমার খুব মজা লেগেছে। মানুষকে ভরকে না দেয়ার জন্যই সম্ভবত আমেরিকান বিমানের সেফ্টি এডভারটাইজমেন্টগুলো খুব মজার।
পিছনে দুটো ইমারজেন্সি অক্সিট আছে বলে এয়ারহোস্টেস হাত দিয়ে যেই না দেখাতে গেল অমনি কাগজ ছিড়ার মত পিছনটাই ছিড়ে গেল বিনানবালা চোখ মটকে নিজেই হেসে ফেলে, তখন কি আর না হেসে পারা যায় নাকি? আরেকটাতে বিমানবালা ‘গন উইদ দ্যা উইন্ডের’ ভিভিয়ান সেহ এর মত সেফটি মেজারগুলো দেখায় বাচ্চাদের সাথে নেচে নেচে।
মজার না? আমেরিকান বিমানে আমাদের সাথে আরো দুটো পার্থক্য আছে। টেকঅফ করার সময় আমাদের বিমানের জানলা খোলা রাখতে বলে কিন্তু এখন বলে বন্ধ রাখতে, বারবার ঘোষনা দিয়ে আমাদের মোবাইল বন্ধ রাখতে বলা হয় এখানে এ ব্যাপারে কোন মাথাব্যাথা নেই ঘোষনা তো নেইই। বরং ফ্রি ওয়াইফাই দিয়ে দেয়। এটাও কি বৃটিশ আমেরিকান দন্দ্ব নাকি? ঘোষণা থাক বা না থাক সবার হাতে হাতে থাকে বই, অবসর সময় বইয়ে মুখ গুঁজে রাখাই দস্তুর।তাই কিনা কে জানে প্রত্যেকের মুখে আভিজাত্যের একটা ছাপ কিন্তু আছে বিশেষ করে সাদাদের। জনান্তিকে খাবার দাবারেরও একটা ভুমিকা আছে, তেনারা আবার ধনি কিনা।
মিশিগান এয়ারপোর্টে এমার মা এলেন আমাদের নিতে। বিশ মিনিটের গাড়ি চালিয়ে ‘উইদারিং হাইটসের’ মত একটা ফার্ম হাউজের সামনে এসে থামলেন। সিপ্লি স্ট্যানিং। সুইমিংপুলওয়ালা সেই বিশাল বাড়িটি পুরাই একটা এন্টিক। সামনে ফুলের বাগানসহ গাড়ি বারান্দা, পিছনে বিশাল লন, তারপর সারিবদ্ধ গাছ ও আগাছার বন, বামে সুইমিংপুল তারপর ঢেউ খেলানো মিডো পাড় ঘেষে হলুদ বুনো ফুল।
মনে হলো ঊনবিংশ শতাব্দির ভিতর ঢুকে পড়েছি। সারাদিন পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় নয় ছেলে মেয়ের ফার্মার বাবা ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে সামান্য বিয়ার খেতে খেতে খবরের কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে, মোটাসোটা সুখি গিন্নি তাঁর পাশে বসে সিলাই ফুরাইয়ের কাজটা সারছেন।
ছেলেরা বাইরে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডায় আর মেয়েরা নিজ নিজ রুমে ভবিষ্যৎ প্রিন্সচার্মিং এর স্বপ্নে বুঁদ-এমন একটা ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে।
বিভারলি গ্রাইনার রাস এবং উজিন রাস এর নয় ছেলে মেয়ে এনি মেরি, মাইক্যাল (মাইক), পল, থেরেস, লউরি, মার্গি, জন, জেরি, জোয়ানির জীবনটা হয় তো এমন ছিল অথবা অন্য রকম কিন্তু বিশাল ফার্ম হাউজটা পাহারা দেয়ার জন্য এমার নানি এখনও বেঁচে আছেন, সম্প্রতি ইমেডিয়েট ছোট বোন তাঁর সাথে এসে রয়েছেন। থেরেস এবং লেউরি মারা গেছে, অন্যেরা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পরেছে।
‘বেভারলি গ্রিনার রেচ’ এর বয়স নব্বই কিন্তু এখন এই নাম তাঁকে কেউ আর ডাকে না, সবাই বলে ‘গ্রেনি’। তা বলে ভাববেন না আমাদের নব্বই বৎসরের বুড়োদের মত আয়ার সাহায্যে একটা হুইল চেয়ার দখল করে সমস্ত ছেলে মেয়ের মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে যার প্রতি ছেলে মেয়েরা মনের কোনে টান অনুভব করলেও প্রতিদিন সেই একই মনে তাঁর মৃত্যুও কামনা করে কারন তাঁর নির্ভরতা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে, তাদেরও তো জীবন আছে পরিবার পরিজন নিয়ে তাদেরও জীবন কাটাতে হয়।
টট্টরে বুড়ি এই বয়সেও কারও উপরে নির্ভরশীল নয়। কুটকুট করে সমস্ত ফার্মটা প্রায় একাই দেখাশুনা করে। বাগান করে, পুল পরিস্কার করায়, বিশাল লনের ঘাষ কাটায়, ঘরের কোথায় কোনটা ঠিকঠাক আছে কিনা খেয়াল রাখে। গাড়ি চালিয়ে গ্রোসারি করে আনে। ছেলে জনি অবশ্য মাঝে মাঝে এসে মাকে সাহায্য করে। কোথাও কোন বিশৃংখলা নেই, ফাইভ স্টার হোটেলের মতই ম্যাইটেনেন্স। আমার মাথায় ধরে না কি করে সম্ভব!
গ্রেনি কাজ পাগল কিন্তু রোবট নয়। হেসেহেসে আড্ডায় যোগ দেয়, ফান করে, কানে একটু কম শুনে বলে মাঝে মাঝে কানের পিছনে হাত দিয়ে মিষ্টি হেসে আড্ডার পরতে পরতে মায়া ছড়িয়ে দেয়, ছোট্ট হাত তালি দিয়ে আন্তরিক আতিথেয়তা করে। এখনও জীবন থেকে মজা তুলে নিতে জানে।
চনমনে স্মার্ট এই মহিলার জড়তাহীন জীবন যাপন ও আত্মনির্ভরতা আমাকে একেবারে হকচকিয়ে দিয়েছে সেই সাথে চোখে এক রাশ আশার আলোও ফেলে দিয়েছে ‘ভয় পাওয়ার কি আছে এমনও তো হতে পারে শেষ জীবনে নির্ভরশীল না হয়ে নির্ভরতার আশ্রয়স্থলও তো হওয়া যায়, শান্তির খোঁজে যেখানে অনেক সময় অনেকে এসে আশ্রয় নিবে। সত্যি বলছি এখানে না আসলে আমি জানতামই না যে এমনও হতে পারে।
তারপরও গ্রেন্ড ফাদার্স ক্লকটা ঘন্টায় ঘন্টায় ঘন্টি বাজিয়ে কেন যে জানিয়ে দেয় সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। ১৯৬০ সালে তৈরী হওয়ার সময় নয় ছেলে মেয়ে নিয়ে বাড়িটি গমগম করতো আর এখন প্রানান্তিক প্রচেষ্টায় গ্রানি টিমটিমে বাতিটি জ্বালিয়ে রাখার আপ্রান চেষ্টা করছেন। তিনি মৃদু হেসে বলেন ‘হ্যাঁ সময় খুব দ্রুত পালিয়ে যায়।’
এমাদের ফ্যামিলি দীর্ঘজীবী কিন্তু স্বল্পাহারি। নানি এবং মা সামান্য সালাদের উপর বেঁচে আছেন। গ্রেনির মা খেতে খুব ভালবাসতেন, তাই খুব ‘টাইনি এইজে’ মাত্র সত্তুর বৎসর বয়সে মারা যান সে জন্যই তাদের এই সাবধানতা। গ্রেনির বড় বোন প্রায় একশত বৎসরে এখনও বেঁচে আছে।
ওদের আতিথেয়তা ঠিক আমাদের মত নয়। আমরা যেমন খাওয়া দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরি ঠিক তেমন নয়, যার যার খাবার নিজে তৈরী করে নিয়ে এক সাথে বসে গল্প করাটাই আসল। প্রচুর খাওয়ার জিনিস ছড়িয়ে আছে চারিদিকে, নিজেরটা শুধু তৈরী করে নাও।
তবে প্রথম প্রথম কোনটা কোথায় আছে জানা থাকে না বলে একটু খটকা লাগে। ওরাও আমাদের মত ফ্যামিলি ওরিয়েন্টেড। আলাদা থাকলেও সবার সাথে সবার আন্তরিক যোগাযোগ আছে। ফ্যামিলি প্রোগ্রামগুলোতে যত দূরেই থাকুক এক সাথে হয়। গ্রেনির নব্বইতম জন্মদিনে দারুন একটা গেটটুগেদার হয়েছিল।
সবাই মিলে সুন্দর একটা ফ্যামিলি এলবাম উপহার দিয়েছিল তাঁকে। সেটা দেখিয়ে গ্রেনি আমাকে তার বিশাল পরিবারের প্রত্যেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। মৃত দুই কন্যার ছবি দেখিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন,’It is heard to see a child’s death’- আমি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখান থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
মাতৃহৃদয় সব জায়গায়ই এক। মায়ের মত এনিও খুব সফ্ট। যে কোন ইমোশনাল এটাচমেন্টেই এনির চোখে পানি চলে আসে।আমরা যাব শুনে এমার খালাত বোন নেলি মেক্সিকো থেকে এসে উপস্থিত। রান্নাও করে রেখেছিল আমাদের জন্য।
এক বিকেলে এনির বোন মার্গি যিনি মিশিগানেই থাকেন ছেলে মেয়ে ছেলের বউ এবং আদরের কুকুর নিয়ে এসে দেখা করে গেলেন, পরে আমরা গেলাম এনির আরেক ভাই মাইকের সাথে দেখা করতে। যার ফার্ম সম্পর্কে পরে আরো বলব।