মিশিগান সংবাদ

ভ্রমণ : মিশিগান

(পূর্ব প্রকাশের পর)

বিকেলে এনি আমাদের নিয়ে গেল মিশিগান শহরটা ঘুরিয়ে দেখাতে। পুরানো ঐতিহ্যের সাথে ম্যাগাসিটির সব কিছুই এখানে বর্তমান কিন্তু বেশ নিরিবিলি। মানুষ কম, অনূঢ়া জায়গা পর্যাপ্ত পরে আছে। পাশ দিয়ে চলে গেছে গ্রেন্ড রেপিড রিভার লেক মিশিগান থেকে যার উৎপত্তি। দু’পাশে গাছপালা শুভিত খুব সুন্দর একটা পার্ক। নাম রেপিড রিভার পার্ক। নানা করনে ‘রেপিড রিভার’ এই নামটার প্রভাব এখানে বিশাল। জায়গার নাম, রাস্তার নাম, হোটেল-রেস্তোরার নাম, এমন কি বড় বড় স্কাইক্রেপারের নামও গ্রেন্ড রিপার। গ্রেন্ড রিপার পার্কের সামনে থামলাম আমরা। পার্ক পেড়িয়েই নদী, একটু ছুঁয়ে দিলাম তাকে, সুদূরের অজানা স্পর্শে সে কি কেঁপে উঠল একটু? তারপর চললাম এমার শৈশব খুঁজতে-কোন বাড়িতে সে জন্মালো, কোন রাস্তা দিয়ে চালিয়ে যেত সাইকেল, ওর হাইস্কুল কলেজ, কোথায় স্কুলের পয়সা বাঁচিয়ে খেতে গিয়েছিল প্রিয় আইসক্রিম অথবা চকলেট, কিশোরি বয়সে কোথায় দুটো পয়সা উপার্জনের জন্য আইক্রিমের দোকানের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম বিক্রি করতো। এনিও মাঝে মাঝে ফিরে যাচ্ছিল তার শৈশবে-দেখাচ্ছিল নিজের স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি যেখানে শিক্ষকতা করেছে অনেক দিন, দুই সময়ে মা ও মেয়ে একই শহরে বেড়ে উঠছে দেখতে দেখতে আমার কাছে মা মেয়ের শৈশব একই সাথে জড়িয়ে যাচ্ছিল, সেই সাথে আমার নিজের শৈশবটাও, যদিও কিছুটা ভিন্ন তবুও একই রকম নস্টালজিক। ইস অপর্ণা সেন যদি থাকতেন মা মেয়ের জীবন নিয়ে কি সুন্দর একটা সিনামাই না বানিয়ে ফেলতেন কিন্তু বিধাতা সেই ক্ষমতা আমাকে দেননি। তবে দেখবার চোখ দিয়েছেন? তাই দেখছি জায়গাটি ক্যাথলিক প্রধান, অনেক সুন্দর সুন্দর চার্চ, গির্জা, সিনোগগ, তাদের মধ্যে পার্থক্য কি জানিনা তবে

কেউ কারো চেয়ে কম নয়। দু-একটার ভিতরটা দেখাতে এমা খুব চেষ্টা করলো কিন্তু তখন সব বন্ধ হয়ে গেছে। মা মেরি হয়তো চাননা। শুধু চার্চ কেন এখানে মিউজিয়ামের ও ছড়াছড়ি। আছে মিউজিক স্কুল। একটার নাম তো খুব মনকারা-বেসিলিকা অব সেন্ট এডালবার্ট-সেখানকার হলগুলো নাকি মিউজিকের তাল অনুযায়ী তৈরী। জেরাল্ড ফোর্ডেরও খুব রমরমা। এখানেই তাঁর বেড়ে উঠা কিনা। এয়াপোর্টের নামও জেরাল্ড ফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।
পরেরদিন গেলাম লেক মিশিগানের পাড়ে নর্থবিচে। খুব সুন্দর বিচ। আসলে সেন্ড ডিউন। সাদা বালি সবুজ মিঠা পানি। সারাদিন কাটল সেখানে।

তারপর দিন অসাধারন দুটো জায়গায়। সকালে একাটা বিকালে আরেকটা। সকালে গেলাম ফ্রেডরিক মেজার গার্ডেনস এন্ড স্কাল্পচার পার্কে। বিকেলে রাচে’স চেরী ফার্মে-এটা এমার মামার চেরী এবং আপেল ফার্ম। বিশাল ফার্ম। সবই আমার কাছে নতুন এবং অত্যাশ্চার্য। দুটোতেই এনি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল, গাইডের কাজ করতে থাকল সেই সাথে। স্কুল টিচার ছিলেন তাই জানাশুনা অনেক। স্কাল্পচার পার্কটা ফ্রেডরিক মেইজার ও তাঁর স্ত্রী লেনা মেইজারের ডেডিকেট করা। বেঞ্চে বসা তাঁদের যুগল মূর্তিও আছে সেখানে। মাল্টিমিলিয়নিয়ার হলে কি হবে খুব সিম্পল জীবনযাপন করতেন তারাঁ। এক সময় এনিদের বাসার কয়েকটা বাসার পরেই নাকি থাকতেন।

পার্কটাতে ঢুকতেই বিশাল হল রুমে জউম প্লেন্সারের (ঔধঁসব ঝঢ়ষবহংধ) অটুপিয়া নামে একই মুখ চারটি দেয়ালেই আঁকা। বিশাল আকারের সেই মুখ। হল পেরিয়ে গার্ডেন। বিভিন্ন আকারের প্রকারের। আমেরিকানদের সবই বিশাল।বার্গার থেকে শুরু করে পার্ক সব। ক্যাকটাস গার্ডেন, জাপানিজ গার্ডেন, মরূভূমি গার্ডেন, বাটার ফ্লাই গার্ডেন, চিল্ড্রেন্স কর্নার সবই আছে কিন্তু ভারতীয় গার্ডেন দেখলাম না। মুঘলদের তৈরী ইন্ডিয়ান গার্ডেনগুলো যে কি সুন্দর। তেনারা এমেরিকানদের নজর হারালেন কেন? মালুম নেহি। বাচ্চাদের জন্য আলাদা সেকশন আছে। এখানেই আমি প্রথম পতঙ্গ খেকো গাছ দেখলাম অনেকটা উল্টানো ঘন্টি ফুলের মত। যাবার সময় আমি মোবাইল ফেলে গেছি, এনির মোবাইলে অনেক ছবি। পেলে আপনাদের দেখানো যাবে। তারপরই বনের মাঝে মাঝে বিভিন্ন রথি মহা-রথিদের তৈরী স্কাল্পচার। একদম প্রথমেই আছে লিউনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মানসপুত্র নিনা আকুমুর ‘দ্যা এমেরিকান হর্স’-নিনা লিউনার্দোর স্কেচ দেখে এই অশ্ব-যুবককে তৈরী করে তাঁকেই ডেডিকেট করেছেন। এরই আরেকটা ডুপ্লিকেট আছে খোদ লিওনার্দোর দেশ ইতালিতে। এখানে মোট পঞ্চাশটার মত বিখ্যাতজনদের স্কাল্পচার আছে। কোন কোনটা আমাদের মত সাধারন মানুষের বোধগম্য হয়, কোনটা কোনটা একদমই হয় না। দেখলে মনে হয় এইটা আবার কি? তারও নাকি গভীর মানে আছে। গাইডের কথায় কিছুটা আঁচ করা গেল বটে, কিছুটা বিশ্বাস হইল কিছুটা হইল না, তবে মনে হইল হইলেও হইতে পারে, এব্স্ট্রাক্ট আর্ট নাকি একেক জন একেক রকম বুঝে, হবে হয় তো, আমি কিছুই বুঝলাম না। মানুষের একটা কংকালকে রশিটশি দিয়ে বেঁধে গাঁধা আকৃতি দেয়া হয়েছে- এর নাম কেবিন ক্রিক-কেন? কি? আরেকটা মেটালের বিশাল স্পাইডার বুকের কাছে একটা ঝুড়ি-ওটা নাকি মাদার্স ওম্ব তাই এর নাম মাদার। মাদার ও তৎসংক্রান্ত বেশ কয়েকটা স্কাল্পচার আছে এখানে-সব কয়টাই এবস্ট্রাক্ট। মায়েরা এখানে একটা ফেন্টাসি। বন্ধুরা গল্প করতে বসলে মায়ের প্রসঙ্গ আসবেই কিন্তু কতজন তাঁকে ফিল করে আমার সন্দেহ আছে। তবে একটা আর্ট আমার মনে গেথে গেছে। গন্ধম ফল খেয়ে ফেলায় হাওয়া বিবি লজ্জায় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে আছেন, সিম্প্লি দারুন। আরেকটা স্কাল্পচার এত ভাল লেগেছে যে কি বলব। সিন হেনরির ‘লাইং ম্যান’-একজন বলিষ্ঠ যুবক পা মুড়ে হাত বুকের উপর রেখে রোদে শুয়ে আছে-এত রিয়েলিস্টিক যে মনে হয় কাছে গেলে উঠে বসবে। চাইলে আপনি এখানে কোন আর্ট, স্কাল্পচার, রাস্তা, প্যাভেলিয়ন, বেঞ্চ নিজের নামে অথবা প্রিয়জনের নামে ডেডিকেট করতে পারেন তবে তা অবশ্যই মান সম্মত হতে হবে।

বিকালে গেলাম এমার মামা মাইকের ফার্মে। ফার্মটা বিশাল। মামা-মাইক এবং মামী- ক্যালি মিলে ফার্মটা চালায়। এখানেই প্রথম চেরি গাছে উঠে চেরি পাড়ার অভিজ্ঞতা হলো। প্রথমে ফার্মটা শুরু করেছিলেন মাইকের বাবা। তাঁর আমলের ভগ্নপ্রায় একটা ফোর্ড গাড়ি ফার্মের সামনে রাখা। এটা দিয়েই এনিরা স্কুল কলেজে আসা যাওয়া করতো। গাড়িটা দেখে এনি খুবই নষ্টালজিক হয়ে পড়ে। বাড়ির সামনে শোরুম- পুরোনো আমলের স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে সাজানো। এন মেরি, তাঁর বাবা মা ও পরিবারের অন্যান্যদের ছবি আছে এখানে।পুরোনো কিছু আসবাব, সুটকেস, দৈনন্দিন ব্যবহার্য কিছু জিনিসও এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো তার মধ্যে এনির একটা পুরোনো সুটকেসও আছে। পুরোনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখার নির্দোষ প্রচেষ্টা। সুতরাং পুরোনো জিনিস দেখলেই আমার মত ফেলে দেবেন না, অধস্তনদের ঐতিহ্যের কাজে লেগেও যেতে পারে। আপেল ও চেরি সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস পাওয়া যায় এখানে। পাই থেকে সিরাপ সব। মাইকের ছেলে মেয়েরা মিলেই দোকানটা চালায়। সম্পন্ন বাবার ছেলে মেয়ে হলে কি হবে, কি অবলিলায় কাউন্টারের পিছনে দাঁড়িয়ে যায়-শুয়ে বসে নয় কাজ করেই খেতে হয় সবাইকে-এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আত্মীয় বলে বিনা পয়সায় চ্যারিটি করা হবে তা নয়-আত্মীয় অনাত্মীয় সবাইকেই ‘পাত্তি দিয়ে বাত্তি’ কিনতে হবে তানা হলে ফার্মের কোনায় কোনায় লালবাত্তি জ্বলতে বেশী সময় লাগবে না।
আমরা আমাদের পছন্দ মত জিনিস কিনে নিলাম। অবশ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা চেরিগুলোর দাম দিতে হয়নি। দশপদ রান্না করে সারাদিন ব্যাপি আতিথেয়তার সময় এদেশে নেই, আতিথেয়তা বলতে হায়, হেলো, দেখা হওয়া, খুশি হওয়া ব্যস। মামা বাড়ির আবদার এখানে চলে না তাতে অবশ্য আন্তরিকতার অভাব বোধ হয় না একটুও। মাইকের সাথে দোকানেই পরিচয় হলো কিন্তু তার স্ত্রী অসুস্থ বলে দেখা হলো না। শক্তসমর্থ সাকসেসফুল মানুষ মাইক। খুব আন্তরিক। দিনটা বড় আনন্দে কাটল। একটা অভিজাত আন্তরিক অতিথী পরায়ন পারিবারিক পরিবারের সাথে অসাধারন কয়েকটা দিন কাটিয়ে এলাম মিশিগানে। অনেক দিন মনে থাকবে এই সফর। ধন্যবাদ এমা ও তার পরিবারকে-আন্তরিক আতিথেয়তার জন্য এবং সেই সাথে সেই জন্য যা কিছু আমি তাদের কাছ থেকে শিখেছি।

Back to top button