বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বিজ্ঞানে বিশ্বরূপ

হাজার হাজার বছর ধরে, লোকেরা আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে, সূর্য, চাঁদ এবং গ্রহের গতিবিধি দেখে হাজার রকমের চিন্তাভাবনা ও মতামত ব্যক্ত করে গেছেন। দীর্ঘকাল ধরে মানুষজন পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করতেন। প্রাচীন ভারতীয়রা বিশ্বাস করতেন- “পৃথিবী সমতল এবং এটি বিশালাকার হাতির পিঠে বিশ্রাম নেয়। কেউ কেউ ভাবতেন- এটি ঘুরে ঘুরে কচ্ছপের উপর বিশ্রাম নেয়। এই বিশাল কচ্ছপটি আবার একটি সাপের উপর দাঁড়িয়ে আছে!”
টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর তীরে বসবাসকারী লোকেরা মহাবিশ্বকে ভিন্নভাবে দেখেছিল। তাদের মতে “পৃথিবী একটি পর্বত যা চারদিক থেকে সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত এবং তা বারোটি স্তম্ভে অবস্থিত।”
প্রাচীন গ্রীক বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। মহান গণিতবিদ পিথাগোরাস সর্বপ্রথম মতামত দিয়েছিলেন- “পৃথিবী মোটেও সমতল নয়, এর একটি বলের আকৃতি রয়েছে!” পরবর্তিতে আ্যারিস্টটল এই অনুমানটির প্রমাণ দিয়েছিলেন। অ্যারিস্টটল মহাবিশ্বের কাঠামো বিষয়ে মতামত দিয়েছিলেন যে – “মহাবিশ্বের কেন্দ্রে একটি গতিহীন পৃথিবী রয়েছে, যার চারপাশে আটটি কঠিন ও স্বচ্ছ মহাকাশীয় গোলক ঘোরে।”
অ্যারিস্টটলের সেই দৃষ্টিভঙ্গি সে সময়ে বিজ্ঞানে দৃঢ়ভাবে প্রভাব বিস্তার করে নিয়েছিল। প্রাচীন গ্রীক বিজ্ঞানী অ্যারিস্টারকাস অফ সামোস বিশ্বাস করতেন যে- “মহাবিশ্বের কেন্দ্র পৃথিবী নয়, সূর্য।” তিনি ভাবতেন “পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চারপাশে ঘুরছে।” অবশ্য এই উজ্জ্বল অনুমানটিও তখন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।
“বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে আছে পৃথিবী এবং এই পৃথিবী স্থির। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে এই স্থির পৃথিবীকেই কেন্দ্র করে।” – আ্যারিস্টটলের এই ধারণাটি দুই হাজার বছর ধরে পৃথিবীর মানুষের কাছে দাঁড়িয়েছিল শক্তভাবেই। বহুকাল পর নিকোলাস কোপার্নিকাস ঘোষণা করেন- “মহাবিশ্বের কেন্দ্রে আছে সূর্য, পৃথিবীজুড়ে অন্য গ্রহ-উপগ্রহগুলো নিজ নিজ কক্ষপথ ধরে ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে। কিন্তু প্রায় আধা শতক ধরে এই তত্ত্বে তেমন কেউ ভ্রুক্ষেপ করেনি। কারণ, তখন পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণাটি ধর্মীয় সমর্থন পেয়ে একটা ধর্মীয় মতবাদের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। তখন একথা প্রচলিত হয়ে যায় “পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থাপন করেছেন স্বয়ং ঈশ্বর; মানুষকে তিনি এই জ্ঞান দান করেছেন নিজের বাণীর মারফতে।” সে সময় স্থির পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের এই ধারণার প্রধান প্রতিপালক ছিল ক্যাথলিক গির্জা।
এরপর আর্বিভাব হলো ইতালীয় পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক গ্যালিলিও গ্যালিলেই এর। আধুনিক যুগে প্রকৃতি বিজ্ঞানের এতো বিশাল অগ্রগতির পেছনে এই ব্যক্তিটির চেয়ে বেশি অবদান আর কেউ রাখতে পারেননি।
তখনকার সময়ে গ্যালিলিও ছিলেন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক। কিন্তু তাঁর মস্তিষ্ক ও মন ছিল এতটাই কৌতূহলী ও পর্যবেক্ষণশীল যে, ঈশ্বরের বাণী হিসেবে প্রচারিত সব কথার প্রচলিত ব্যাখ্যা অন্ধের মতো বিশ্বাস করা ছিল তাঁর পক্ষে অসম্ভব। বিজ্ঞান ও অধিবিদ্যার জগতে গির্জার কাঠপুরোহিত ও বিদ্যাপীঠের ততোধিক কাঠপণ্ডিতদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই তাঁর মনে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা জেগেছে খুব অল্প বয়সে। তিনি ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে টেলিস্কোপ বানিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণে বৈপ্লবিক গতিবেগের সঞ্চারণ করে দেন। নিজের বাগানে টেলিস্কোপ বসিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন ছায়াপথ, চন্দ্রপৃষ্ঠের পাহাড় ও উপত্যকা, বৃহস্পতি গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণমাণ চারটি চাঁদ এবং আরও অনেক কিছু, যা তাঁর আগে কেউ কখনো পর্যবেক্ষণ করেননি। অতঃপর গ্যালিলিও নিশ্চিত উপসংহারে পৌঁছান যে – কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক ব্যবস্থার তত্ত্বটিই সঠিক।
মূলত, ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিলিওর স্বাধীনভাবে এবং উন্নত ধরনের এই দূরবীক্ষণ যন্ত্র নির্মাণ ও এই যন্ত্রকে জ্যোতির্বিদ্যায় সার্থকভাবে প্রয়োগের ফলেই মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের হাজার বছরের সকল ধারণা আমূল বদলে যায় । খালি চোখে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করার আদিম সকল পদ্ধতি লোপ পেয়ে যায় গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের ভেতর দিয়েই। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও যখন আকাশের দিকে টেলিস্কোপ তাক করে বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ আবিষ্কার করে ফেললেন, তখনই যেনো জ্যোতির্বিজ্ঞানের আকাশে নতুন সূর্যোদয় হলো। আড়াই হাজার বছরের জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার ধরণ বদলে গেলো এক নিমিষেই।
জোহানেস কেপলার ১৬১১ সালে একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র নির্মাণ করেন। তখনো প্রতিসরণ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের যুগ ছিল, যা লেন্সের সাহায্যে কাজ করতো। ১৯৩৩ সালে জেমস গ্রেগরি প্রতিসরণ দূরবীক্ষণের উন্নতি ঘটান। উদ্ভাবন করেন প্রতিফলন দূরবীক্ষণ যন্ত্র, যার মূল উপাদান হলো দর্পণ। প্রতিফলন দূরবীক্ষণ তৈরিতে অবদান আছে আইজ্যাক নিউটনেরও।
মহাবিশ্বের স্বরূপ বিষয়ে বাস্তবিক ধারণা সামনে নিয়ে আসার ফলে সেই সময়ে গ্যালিলিও নানাবিদ তিরস্কার লাভ করতে থাকেন। কেননা, পৃথিবী যে মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু নয় এই কথাটি প্রচার করা তখন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার শামিল। এ ধরনের কিছু লেখালেখি করে গ্যালিলিও তখন প্রচুর সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন।
১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে ‘লেটারস অন দ্য সোলার স্পটস’ শিরোনামে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করার পর তাঁর বিরুদ্ধে গির্জার পুরোহিত ও বিদ্যাপীঠের পণ্ডিতদের প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু হয়। তিনি সেসব আক্রমণের কিছু জবাবও দিয়েছেন। কখনো তিনি বলেছেন, “পুরোহিত ও পণ্ডিতেরা বাইবেলের সব কথার মানে করেন আক্ষরিকভাবে। তারা নিহিত অর্থ বা রূপক অর্থ বোঝার চেষ্টা করেন না।” ধর্মান্ধ ব্যক্তিগণ তখন তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ করে বসেন। ফলস্বরূপ, গ্যালিলিওকে সহ্য করতে হয় শাসকের ভর্ৎসনা ও তিরস্কার। অথচ আজ, এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে গ্যালিলিওই সেদিন সঠিক ছিলেন।
কেবলমাত্র বিশ্বাসের জোরে, যুক্তি কিংবা প্রমাণের তোয়াক্কা না করে যেকোনো সত্যকে গলাচাপা দেওয়ার এই প্রবণতা সুপ্রাচীনকাল থেকে মানুষের মাঝে এভাবেই বিরাজমান ছিল এবং অদ্যাবদি সেটা বিদ্যমান।
পর্ব (০১)

Back to top button